২৯ এপ্রিল ২০২৪ / ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ভোর ৫:৩০/ সোমবার
এপ্রিল ২৯, ২০২৪ ৫:৩০ পূর্বাহ্ণ

হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম একটি মহিমান্বিত রজনী পবিত্র লাইলাতুল কদর

     

আজ লাইলাতুল কদরের রাত। যাকে শবে কদর বলা হয়। শবে কদর ফারসি শব্দ। যার অর্থ হলো মহিমান্বিত রাত। মহান আল্লাহতায়ালা লাইলাতুল কদরের রাতকে অনন্য মর্যাদা দিয়েছেন। হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও এ রাতের ইবাদত উত্তম। এ রাতে আল্লাহর অশেষ রহমত ও নিয়ামত বর্ষিত হয়। মহান রাব্বুলআলামীন মানব জাতিকে অফুরন্ত নেয়ামত দান করেছেন তাদেরকে সর্বোত্তম ও শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন। পাশাপাশি আমাদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মাত হওয়ার গৌরব দান করেন। আর শ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল মুহাম্মদ (সা.)-এর খাতিরে তাঁর উম্মাতদের অনেক বৈশিষ্ট্য এবং মর্যাদা দান করেন লাইলাতুল কদর তার মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার। তাই প্রত্যেক মুমিনের উচিত এ রজনীর গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে সম্যক ধারনা লাভ করত : তা যথাযথভাবে পালনে সর্বোচ্চ সচেষ্ট হওয়া। আল্লাহতাআলা বলেন লাইলাতুল কদর হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। রাসূল (সা.)-এর ভাষায় : যে ব্যক্তি ঈমান ও সাওয়াবের আশায় লাইলাতুল কদর পালন করবে তার অতীতের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়। পবিত্র এ রাতে ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে আমরা মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারি। অর্জন করতে পারি তার অসীম রহমত,নাজাত,বরকত ও মাগফিরাত। পবিত্র শবেকদরের রাতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আল্লাহর নৈকট্য ও রহমত লাভের আশায় ইবাদত-বন্দেগি করবেন।
বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বরকতময় রাত হলো শবে কদর। লাইলাতুন শব্দের অর্থ রাত বা রজনী এবং কদর শব্দের অর্থ সম্মানিত মহিমান্বিত। এই দুটি শব্দ মিলিয়ে লাইলাতুল কদর অর্থ অত্যন্ত সম্মানিত বা মহিমান্বিত রজনী। লাইলাতুল কদর আরবি শব্দ। শবে কদর হলো লাইলাতুল কদরের ফারসি পরিভাষা। অর্থ সম্মানিত মর্যাদাপূর্ণ ও মহিমান্বিত, সম্ভাবনাময়, ভাগ্যনির্ধারণী রজনী। মুসলিম উম্মাহর কাছে লাইলাতুল কদর অতিশয় মর্যাদাপূর্ণ একটি পবিত্র রজনী। পবিত্র কোরআনে এই রাতের গুরুত্ব- তুলে ধরে সুরা কদর নামে একটি পূর্ণ সুরা নাজিল হয়েছে। তাতে এই মহিমান্বিত রাতকে হাজার মাসের চেয়েও উত্তম বলে ইরশাদ করা হয়েছে। এজন্য রাসূল (সা.)-রমজানের শেষ দশ দিন মসজিদে ইতেকাফে থাকতেন এবং ইবাদতে গভীর মনোনিবেশ করতেন। কোরআন এই রাতেই প্রথম নাজিল হয়েছিল। আল্লাহতাআলা বলেন নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাজিল করেছি মাহাত্ম্যপূর্ণ রজনীতে। পবিত্র কোরআন নাজিলের মাস রমজান মাস কোরআন নাজিলের রাত শবে কদর। এ রাতেই প্রথম পবিত্র মক্কা মুকাররমার জাবালে রহমত তথা হেরা পর্বতের গুহায় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি কোরআন কারিম অবতীর্ণের সূচনা হয়।

রহমত,মাগফিরাত ও নাজাতের মাস মাহে রমজান। প্রিয় নবী (সা.)-বলেন যে ব্যক্তি ইমানসহ সওয়াবের নিয়তে রমজানে রোজা পালন করে তার পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি ইমানের সহিত সওয়াবের আশায় রমজানে রাত জেগে ইবাদত করে তার পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় কদরের রাতে জেগে ইবাদত করবে তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। কোরআন নাজিলের মাস মাহে রমজানের শেষ ১০ দিনের বিজোড় রাতগুলোর কোনো একটিই এই পুণ্যময় লাইলাতুল কদর। তবে ওলামায়ে কেরাম মনে করেন রমজান মাসের ২৬তম দিনের শেষের রাতটিই লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা সর্বাধিক। সেই হিসাবে এই রাতটিকেই লাইলাতুল কদর ধরে ধর্মপ্রাণ মুসলিম নর-নারীরা সারা রাত নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, জিকির আসকারে মগ্ন থাকেন। এই এক রাতে ইবাদতের বিনিময়ে হাজার মাসের ইবাদতের সওয়াবের চেয়েও বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। একদিন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই ভেবে অস্থির হচ্ছিলেন যে আগের নবীর উম্মতেরা দীর্ঘ হায়াত পেত। ফলে তারা অনেক বেশি ইবাদত-বন্দেগির সুযোগ পেত। কিন্তু শেষ নবীর উম্মতের হায়াত খুবই সীমিত। অতএব তাদের পক্ষে উচ্চমর্যাদা লাভের সুযোগ কম। তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে সূরা কদর নিয়ে উপস্থিত হন হজরত জিবরাইল (আ.)। আল্লাহতায়ালা এ রাতেই কুরআন নাজিল করেছেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তেমনি এ রাতটির মর্যাদা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম বলেও ঘোষণা করেছেন। কিন্তু কদরের রাত কোনটি তা সুনির্দিষ্টভাবে বলে দেননি আল্লাহপাক। হাদিস শরিফেও নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি কোনটি কদরের রাত। রাসূলুল্লাহ (সা.)-ইরশাদ করেন তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে কদরের রাত অনুসন্ধান করবে। পবিত্র কুরআন ও সহিহ্ হাদিস দ্বারা লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শবেবরাত নিয়ে হাদিস বিশেষজ্ঞ ও ফকিহদের মধ্যে যে সংশয় রয়েছে-লাইলাতুল কদরের ব্যাপারে তার কোনো অবকাশ নেই। পবিত্র কুরআন নির্ভরযোগ্য হাদিস এবং রাসূল (সা.)-এর লাইলাতুল কদরের জন্য গ্রহীত কর্মতৎপরতা লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সম্মানিত রজনীর গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন আমি এ (কুরআনকে) কদরের রাতে নাজিল করেছি। তুমি কি জানো, কদরের রাত কী ? কদরের রাত হাজার মাস হতেও উত্তম-কল্যাণময়।

রমজানের ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখের রাতগুলোই (অর্থাৎ ২০, ২২, ২৪, ২৬ ও ২৮ রোজার দিবাগত রাত) হলো শেষ দশকের বিজোড় রাত। এ রাতের আরেকটি গুরুত্ব হলো এ পবিত্র রাতেই কুরআন নাজিল হয়েছে। আর এ কুরআনের সাথেই মানুষের ভাগ্য জড়িয়ে আছে। তাহলে লাইলাতুল কদরের আরেকটি অর্থ হয় ভাগ্য রজনী। যে মানুষ যে সমাজ যে জাতি কুরআনকে বাস্তব জীবনবিধান হিসেবে গ্রহণ করবে, তারা পার্থিব জীবনে ও পরকালীন জীবনে সম্মানীত হবে। এ রাতে নাজিলকৃত কুরআনকে যারা অবহেলা করবে, তারা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। এ রাতেই মানবকল্যাণে আল্লাহ মানুষের জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ফেরেশতাদের জানান। আল্লাহ বলেন-এ রাতে প্রতিটি ব্যাপারে অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত ও সুদৃঢ় ফায়সালা জারি করা হয়। মহান আল্লাহ আরো বলেন-ফেরেশতারা ও রূহ (জিব্রাইল আ:)-এ রাতে তাদের রবের অনুমতিক্রমে সব হুকুম নিয়ে অবতীর্ণ হয় সে রাত পুরোপুরি শান্তি ও নিরাপত্তার-ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত।

যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমান সহকারে ও আল্লাহর নিকট হতে বড় শুভফল লাভের আশায় ইবাদতের জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে তার পেছনের সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। এ রাতে কল্যাণ থেকে একমাত্র হতভাগ্য লোক ছাড়া আর কেউ বঞ্চিত হয় না।
নফল নামাজ-তাহিয়্যাতুল অজু, দুখুলিল মাসজিদ, আউওয়াবিন, তাহাজ্জুত, সালাতুত তাসবিহ, তাওবার নামাজ, সালাতুল হাজাত, সালাতুশ শোকর ও অন্যান্য নফল ইত্যাদি পড়া। নামাজে কিরাআত ও রুকু-সিজদা দীর্ঘ করা। কোরআন শরিফ: সুরা কদর, সুরা দুখান, সুরা মুজাম্মিল, সুরা মুদ্দাচ্ছির, ইয়া-সিন, সুরা ত-হা, সুরা আররহমান ও অন্যান্য ফজিলতের সুরা তিলাওয়াত করা; দরুদ শরিফ বেশি বেশি পড়া ; তাওবা ইস্তিগফার অধিক পরিমাণে করা ; দোয়া কালাম,তাসবিহ তাহলিল,জিকির আসকার ইত্যাদি করা ; কবর জিয়ারত করা। নিজের জন্য,পিতামাতার জন্য,আত্মীয়স্বজন,বন্ধু-বান্ধব ও সব মুমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি এবং বিশ্ববাসীর মুক্তি কামনা করে দোয়া করা।

এই রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহতাআলা প্রথম আসমানে অবতরণ করে বান্দাদের ডেকে ডেকে বলেন কে আছ অসুস্থ আমার কাছে চাও আমি শেফা দান করব কে আছ অভাবগ্রস্ত আমার কাছে চাও আমি প্রাচুর্য দান করব কে আছ বিপদ গ্রস্ত আমার কাছে চাও আমি বিপদমুক্ত করে দেব। লাইলাতুল কদর পাওয়ার জন্য নবীজি (সা.)-শেষের ১০ দিন ইতিকাফ করতেন। হজরত আয়িশা (রা.)-বলেন ওফাতের আগ পর্যন্ত প্রত্যেক রমজানের শেষের ১০ দিন রাসুল (সা.) ইতিকাফ করতেন। কিন্তু তিনি যে বছর ওফাত পান সে বছর ২০ দিন ইতিকাফ করেন। (বুখারি: ৪৯৯৮)। রাসুল (সা.)-এর ওফাতের পরও তাঁর স্ত্রী গণ ইতিকাফ করতেন। হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম একটি রাত পবিত্র লাইলাতুল কদর। পবিত্র রমজান মাসের প্রতিটি মুহূর্ত মহামুল্যবান। দিন ও রাতের প্রতিটি ক্ষণ রোজা, নামাজ, তেলাওয়াত, জিকির, তাসবিহ, তাহলিলে পরিপূর্ণভাবে রমজানকে উদযাপন করাই প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর একান্ত কর্তব্য। ফরজ,ওয়াজিবের পাশাপশি সুন্নত আমলসমূহের অনুসরণ করে মাহে রমজানের প্রতিটি মুহূর্তকে সফল করা বিশ্বাসী মুসলমানদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। পবিত্র রমজান মাস মহান আল্লাহর সঙ্গে প্রিয় বান্দার প্রেম বিনিময়ের সবচেয়ে উত্তম সময়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলমানদের মতো বাংলাদেশের মুসলমানরাও নিজেদের গুনাহ মাফ এবং সওয়াব হাসিলের আশায় নফল ইবাদত, কোরআন তেলাওয়াত ও জিকির-আসকারের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করবেন রাতটি। আল্লাহ রব্বুলআলামীন আমাদের সকলকে হেফাজত করুক। সকল প্রকার খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকার দৃঢ়তা দান করুক। আমাদের ঈমানকে মজবুত করার সুযোগ দিক। হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম একটি মহিমান্বিত রজনী পবিত্র লাইলাতুল কদর। পবিত্র রমজানের ফজিলত জেনে বেশি বেশি নেক আমল করার তৌফিক দান করুক। রমজানের রহমত-বরকত-মাগফেরাত-নাজাত লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply