২৯ এপ্রিল ২০২৪ / ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / রাত ৩:৩৬/ সোমবার
এপ্রিল ২৯, ২০২৪ ৩:৩৬ পূর্বাহ্ণ

দশ মহররম শিক্ষা ও তাৎপর্য্য

     

মাহমুদুল হক আনসারী
মহররম হিজরি বছরের প্রথম মাস হওয়ায় এ মাসে আল্লাহতায়ালার নিকট প্রতিটি মুসলমানের একমাত্র চাওয়া-পাওয়া হলো তিনি যেন মুসলিম উম্মাহকে বছরজুড়ে রহমত বরকত ও কল্যাণ দ্বারা ঢেকে দেন। যদিও ইসলামের অনেক আগে থেকেই এ মাসের ১০ তারিখ অতি সম্মানিত এবং ফজিলতপূর্ণ। কেননা এই দিনে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবী সৃষ্টি করেন আর এই দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। এই দিনে আল্লাহ তায়ালা হজরত আদমের (আ.) দোয়া কবুল করেন। হজরত নুহের (আ.) জাতির লোকেরা আল্লাহর গজব মহাপ্লাবনে নিপতিত হওয়ার পর ১০ মহরম তিনি নৌকা থেকে ইমানদারদের নিয়ে দুনিয়ায় অবতরণ করেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.) নমরুদের অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ৪০ দিন পর ১০ মহরম সেখান থেকে মুক্তি লাভ করেন। হজরত আইয়ুব (আ.) ১৮ বছর কঠিন রোগ ভোগ করার পর মহররমের এই দিনে আল্লাহ৮র রহমতে সুস্থতা লাভ করেন। এ ধরনের আরও অনেক ফজিলতপূর্ণ ঘটনার সঙ্গে মহররম মাস জড়িত। ইসলামে মহররম মাসের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে বলেই এ মাসে রোজা রাখা মহানবীর (সা.) সুমহান আদর্শ।

মহানবীর (সা.) প্রিয় দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসেন (রা.) অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে চক্রান্তকারী ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে পবিত্র এই মহৎররম মাসের ১০ তারিখে নির্মমভাবে কারবালার প্রান্তরে শাহাদাত বরণ করেন। সেদিন প্রকৃত ইসলাম ও সত্যের জন্য হজরত ইমাম হোসেন (রা.) ইয়াজিদ বাহিনীর কাছে মাথা নত না করে যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেছিলেন। হজরত ইমাম হোসেন (রা.) সেদিন ন্যায় ও সত্যের জন্য চরম আত্মত্যাগের যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা অনুকরণীয়। শিয়ারা বর্তমানে হজরত ইমাম হোসেনের (রা.) শাহাদাতের শোকে যে মাতম করে তা আবেগতাড়িত হয়ে অতিরঞ্জিত কিছু কাজ করে বসে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হজরত ইমাম হোসেনের (রা.) শাহাদাতের দিনকে স্মরণ করে যথার্থই লিখেছেন, ‘ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না’। আমাদের ইমাম হোসেনের (রা.) ত্যাগের কথা স্মরণ করতে হবে। রাস্তা-ঘাট বন্ধ করে অন্যকে কষ্ট দিয়ে শোক প্রকাশের কোনো শিক্ষা ইসলামে নেই। স্পষ্ট করে শহীদে কারবালায় হজরত ইমাম হোসেন (রা.) বলে গেছেন: ‘আমি শহীদ হলে তোমরা আমার জন্য উহ! আহ! করো না, আঁচল ছিঁড়ো না, বরং ধৈর্য ধারণ করে থাকবে’। তবে নিঃসন্দেহে আমরা বলতে পারি হজরত ইমাম হোসেন (রা.) খিলাফতে রাশেদার ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য নিজ দেহের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত দান করে গেছেন, যুগ যুগ ধরে তার এই ত্যাগ মুসলিম উম্মাহকে খিলাফতে রাশেদার অনুরূপ আল্লাহ মনোনীত খলিফা ও ঐশী ইমামতের ছত্রছায়ায় জীবন অতিবাহিত করার অনুপ্রেরণা জোগাবে।

হজরত ইমাম হোসেনের (রা.) শাহাদাতের ঘটনার জন্য প্রত্যেক মুসলমানই সহানুভূতি ও সমবেদনা প্রকাশ করে থাকে। আর শিয়ারা প্রত্যেক বছর মহররম মাসে নিজস্ব রীতি অনুসারে সেই দুঃখ এবং বেদনায় হা-হুতাশ করে। কারবালায় হজরত ইমাম হোসেন (রা.), তার পরিবারের সদস্যরা এবং কয়েকজন সাথী-সঙ্গীকে বড় নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। সত্যিকার অর্থে এ ঘটনা হজরত ওসমানের (রা.) শাহাদাতের ঘটনারই একটি ধারাবাহিকতা।

হজরত ইমাম হাসান ও হোসেন সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, জান্নাতের যুবকদের সরদার তারা। তাদের উভয়ের জন্য রাসুলুল্লাহ্ (সা.) আল্লাহ তায়ালার কাছে এই দোয়া করতেন যে, হে আল্লাহ! আমি তাদের ভালোবাসি, তুমিও তাদের ভালোবাস। অতএব, যারা রাসুলুল্লাহর দোয়ার কল্যাণ এতটা লাভ করেছেন আর একই সঙ্গে যারা শাহাদাতের পদমর্যাদাও লাভ করেন এমন মানুষ অবশ্যই আল্লাহর প্রতিশ্রæতি অনুসারে জান্নাতে মহান জীবিকা লাভ করবেন এবং তাদের হত্যাকারী অবশ্যই আল্লাহপাকের গজব এবং ক্রোধের শিকার হবে।

হজরত ইমাম হোসেন (রা.) এজিদের প্রতিনিধিদের একথাও বলেছিলেন, আমি যুদ্ধ চাই না, আমাকে যেতে দাও, আমি গিয়ে এক আল্লাহর ইবাদত করতে চাই বা কোনো সীমান্তে আমাকে পাঠিয়ে দাও যেন ইসলামের জন্য যুদ্ধ করতে করতে আমি শাহাদাত বরণ করতে পারি বা আমাকে এজিদের কাছে নিয়ে যাও। যাতে আমি তাকে বোঝাতে পারি, আসল ব্যাপার কি। কিন্তু তার প্রতিনিধিরা কোনো কথা শোনে নাই। অবশেষে যুদ্ধ যখন চাপানো হয় তখন বীরপুরুষের মতো মোকাবিলা করা ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিল না। এই স্বল্পসংখ্যক মুসলমান যাদের সংখ্যা ৭০-৭২ হবে তাদের মোকাবিলায় ছিল এক বিশাল সৈন্যবাহিনী। এদের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। আল্লাহ তায়ালার প্রতিশোধ নেয়ার নিজস্ব রীতি আছে যেভাবে হজরত ইমাম হোসেন (রা.) নিজেই বলেছিলেন, আল্লাহ তায়ালা আমার হত্যার প্রতিশোধ নেবেন আর আল্লাহ তায়ালা প্রতিশোধ নিয়েছেনও। এজিদ বাহ্যত সাময়িক সফলতা লাভ করেছে। প্রশ্ন হলো এজিদের নেকির কারণে কী আজকে কেউ তাকে স্মরণ করে? যদি তার সুখ্যাতি থাকত তাহলে মুসলমান নিজেদের নাম এজিদই রাখত কিন্তু কোনো ব্যক্তি নিজের সন্তানের নাম আজ এজিদ আর রাখে না। হজরত ইমাম হোসেন (রা.) কখনো রাষ্ট্র ক্ষমতা অর্জনের লোভ রাখতেন না। তিনি সত্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। তিনি ন্যায়ের জন্য দন্ডায়মান হয়েছিলেন। ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠায় তার ত্যাগ, কোরবানি আমাদের জন্য অনেক শিক্ষা রেখে গেছে। নিজের অধিকার নিজের জীবন বাজি রেখে পৃথিবীতে সত্যের প্রসার করেছেন, সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

আমাদের উচিত হবে এ মাসে অধিকহারে নফল ইবাদতে রত হওয়া। কেননা এ মাসের নফল রোজা ও অন্যান্য ইবাদত রমজান মাস ছাড়া অন্য যে কোনো মাস অপেক্ষা অধিক উত্তম। (মুসলিম ও আবু দাউদ)। আশুরার রোজার বরকতে আল্লাহ তায়ালা বান্দার এক বছরের গোনাহ মাফ করে দেন। অন্য হাদিসে এ সুখবর প্রদান করেছেন স্বয়ং বিশ্বনবী (সা.)। তিনি বলেছেন, ‘আমি আল্লাহর কাছে আশা করি যে, আশুরার রোজার ফলে আগের এক বছরের গোনাহ কাফ্ফারা হয়ে যাবে’ (মুসলিম)। মুসলিম শরিফের অন্য এক বর্ণনায় জানা যায়, মহানবীর (সা.) ইন্তেকালের আগের বছর তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি তবে ৯ তারিখেও রোজা রাখব। এজন্যই আশুরার রোজার সঙ্গে সঙ্গে এর আগের দিন রোজা রাখাকে মুস্তাহাব বলেছেন উলামায়ে কেরাম। এখন আমাদের বুঝতে হবে যে, ১০ মহররমকে কেন্দ্র করে আমরা যেন অতিরঞ্জিত কিছু করে না বসি বরং হজরত ইমাম হোসেন (রা.) সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় যে আদর্শ রেখে গেছেন তা সব সময় আমাদের আঁকড়ে ধরে রাখতে হবে।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply