চট্টগ্রামের ৩৪তম জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন সারা দেশে ‘মানবিক ডিসি’ হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা।
মঙ্গলবার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো.কামরুজ্জামান এর কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব বুঝে নেন।
দায়িত্ব নিয়ে চট্রগ্রামে জনবান্ধব ও মানবিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন জাহিদুল ইসলাম। এছাড়া চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের প্রশাসনিক দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সকল শ্রেণী পেশার মানুষের সহযোগিতা কামনা করেন।
জাহিদুল ইসলাম এর আগে রাজবাড়ী ও নারায়ণগঞ্জ জেলার জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জে দায়িত্ব পালনকালে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শহীদ আহত পরিবার, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী, দুস্থ মানুষ, অসহায় শিশু, কারাবন্দি, ঝুঁকিপূর্ণ রোগী সবার নির্ভরযোগ্য ঠিকানা হয়ে ওঠেন তিনি।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সোহাগকে স্মার্টফোন, সালমা জেরিনকে ল্যাপটপ, ২০ প্রতিবন্ধীকে হুইলচেয়ার ও ইলেকট্রিক চেয়ার, বিশেষ স্কুলের শিশুদের শিক্ষা উপকরণ, অসহায় আজান, নাছিমা, আলভী, সিরাজুল ও ফয়সালসহ বহু রোগীর চিকিৎসায় আর্থিক সহায়তা সবখানেই ছিল তার মানবিক স্পর্শ। জুলাই শহীদের ২১ পরিবারকে ৪২ লাখ টাকা, আহত ২১২ জনকে অনুদান, এতিমখানার ৮২ শিশুকে পাঞ্জাবি, ইফতার, কারাগারের ১,২৪৪ বন্দির জন্য ক্রিকেট টুর্নামেন্ট মানবিকতার ছাপ রেখেছেন সর্বত্র।
সবচেয়ে আলোচিত হয় তার গ্রিন অ্যান্ড ক্লিন নারায়ণগঞ্জ কর্মসূচি এবং মাধ্যমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ। যার সুফল জেলাবাসী বহু বছর ভোগ করবে।
হাসপাতালে নবজাতকের আইসিইউ চালু, খানপুর হাসপাতালে হুইলচেয়ার প্রদান, ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে অত্যাধুনিক সিবিসি-ইসিজি মেশিন, ফুটবল একাডেমির শিশুদের জন্য বল, বুট ও টুর্নামেন্ট খরচ বহন উন্নয়নেও তিনি রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
এমনকি শতবর্ষী হকার ফজিলাতুন্নেছাকে খাদ্যসামগ্রী ও পুঁজি প্রদান এবং ১ লাখ ৭৩ হাজার টাকার বিল পরিশোধে অক্ষম হওয়ায় আটকে রাখা পিংকির মরদেহ ১৪ ঘণ্টা চেষ্টায় পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়া এসবই তার মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত।
পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচিতে ফটোসেশন না করে নিজ হাতে সিরিঞ্জ কুড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলা, একদিনে ৩০ ইউপি প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে প্রকাশ্য লটারিতে বদলি, মাত্র ১১২ টাকায় সরকারি চাকরি পূরণের সিদ্ধান্ত স্বচ্ছতার বিরল উদাহরণ সৃষ্টি করেন তিনি।
মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে সিজার বন্ধ হয়ে গেলে জেলা পরিষদ থেকে নতুন ডায়াথার্মি মেশিন উপহার দিয়ে সংকট দূর করেন।নারী ফুটবলারদের স্বপ্ন পূরণেও ছিলেন পাশে।
মানুষের সুখ-দুঃখে নিরবচ্ছিন্ন উপস্থিতি, দ্রুত সিদ্ধান্ত ও মানবিকতার উজ্জ্বল উদাহরণ তৈরি করে ডিসি জাহিদুল ইসলাম হয়ে উঠেছিলেন নারায়ণগঞ্জের অভিভাবক ও অঘোষিত জনপ্রতিনিধি।
এর আগে ২০২৪ সালের ২ নভেম্বর রাজবাড়ীতে যোগ দিয়েই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নিহতদের পরিবার ও আহতদের চিকিৎসায় নির্ভরযোগ্য ঠিকানা হয়ে ওঠেন তিনি। যোগদানের দুইদিনের মাথায় শহীদদের বাড়িতে ছুটে যাওয়া এবং আহতদের সেবা নিশ্চিত করে সারা দেশে ‘মানবিক ডিসি’ হিসেবে পরিচিত হন।
শীতের রাতে দরিদ্র মানুষের দরজায় কম্বল বিতরণ, ক্ষতিগ্রস্ত চার হাজার পেঁয়াজ চাষির পাশে দাঁড়ানো, রাজবাড়ী কারাগারের বন্দিদের পুনর্বাসন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা সব ক্ষেত্রেই ছিল তার ব্যক্তিগত উদ্যোগ। দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর শিশুদের বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় দাতা সংস্থা ও মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে স্কুল চালু রাখার ব্যবস্থাও করেন তিনি।
জাহিদুল ইসলাম ১৯৭৯ সালের অক্টোবর মাসে টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরে জন্মগ্রহণ করেন। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের এই সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অনার্স মাস্টার্স, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট থেকে রাশিয়ান ভাষায় ডিপ্লোমা এবং যুক্তরাজ্য থেকে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় তিনি এমএসসি সম্পন্ন করেন।
২০০৬ সালে ২৫তম বিসিএস এর মাধ্যমে প্রশাসনে যোগ দেন। লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা, মৌলভীবাজার ও নোয়াখালী বিভিন্ন জেলায় এনডিসি, এসিল্যান্ড ও ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কমলগঞ্জে ইউএনও থাকাকালে তিনি জেলার শ্রেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে স্বীকৃতি পান।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে দায়িত্ব হস্তান্তর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. সাদি উর রহিম জাদিদ, পাঠান মো. সাইদুজ্জামান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মাহবুবুল হক, মো. শরীফ উদ্দিন, চট্টগ্রাম স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন, রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর পান্না আক্তার, সিনিয়র সহকারী কমিশনার ইমরান মাহমুদ ডালিম, প্রশান্ত চক্রবর্তী, আলাউদ্দিন, শিফাত বিনতে আরা, সহকারী কমিশনার মো. মাহমুদ হাসান, আফরিন ফারজানা পিংকি, মো. ফাহমুন নবী, মো. মঈনুল হাসান, জান্নাতুল ফেরদৌস, জাকিয়া মুমতাহিনা, এস এম আমিরুল মোস্তফা, শাকিব শাহরিয়ার, রাইয়ান ফেরদৌস, সাদমান সহীদ, ফারজানা রহমান মীম, রুমানা পারভীন তানিয়া, তামজীদুর রহমান, সুব্রত হালদার প্রমুখ।



