নিজস্ব প্রতিনিধি

চট্টগ্রামে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে চলছে ৩৭৩ ইটভাটা। যেগুলো পাহাড়, সংরক্ষিত বনের গাছ, ফসলি মাটির সাথে গিলে খাচ্ছে সরকারের ভূমি উন্নয়ন করও । চলতি বছর এসব ইটভাটা থেকে ধার্যকৃত ভূমি উন্নয়ন কর আদায় হয়েছে মাত্র ১৫ লাখ ৬৮ হাজার ৫৪ টাকা। যা খাজনা আদায় লক্ষ্যমাত্রার ২৭ শতাংশ।

জানা গেছে, চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলায় যেসব ইটভাটা রয়েছে তার মধ্যে বেশিরভাগই অনুমোদনহীন। যেসব ইটভাটা বৈধ হিসেবে অনুমোদন পেয়েছে সেগুলোতেও আছে নানা শুভংকরের ফাঁকি। চট্টগ্রামে বেশিরভাগ ইটভাটা গড়ে উঠেছে পাহাড় কেটে কিংবা ফসলি জমিতে। অনেক ইটভাটা রয়েছে লোকালয়ে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে। এছাড়া পৌর এলাকায়ও রয়েছে অনেক ইটভাটা। এমনকি হালদা নদী ও কর্ণফুলী নদীর পাড় ঘেঁষেও অনেক ইটভাটা গড়ে উঠেছে।
ইটভাটাগুলোতে এখন পর্যন্ত ৭৩ শতাংশ খাজনা বকেয়া রয়েছে। দ্রুত বকেয়া ভূমি উন্নয়ন কর আদায় ও অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা-ভূমি কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছেন জেলা প্রশাসন। কিন্তু একটি ইটভাটার বিরুদ্ধেও এ পর্যন্ত কোন রকম ব্যবস্থা নেয়নি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ভূমি কর্মকর্তারা। গত ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম জেলা সমন্বয় সভার তথ্য পর্যালোচনা করে এসব
তথ্য পাওয়া গেছে।

জেলা প্রশাসনের হিসাবের তথ্য বলছে, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় সর্বাধিক ৭০টি, সাতকানিয়ায় ৫৩টি, রাউজানে ৪৭টি, ফটিকছড়িতে ৪৩টি, লোহাগাড়ায় ৪২টি এবং হাটহাজারী ও চন্দনাইশে ৩২টি, মিরসরাইয়ে ১৪টি, সন্দ্বীপে ১৬টি, সীতাকুন্ডে ৮টি, বোয়ালখালীতে দুটি, কর্ণফুলীতে ৮টি, আনোয়ারায় দুটি ও বাঁশখালীতে চারটি ইটভাটা রয়েছে। এসব ইটভাটা থেকে চলতি মৌসুমে (২০২৪-২০২৫) ভূমি উন্নয়ন কর দাবি করা হয় ৫৮ লাখ ৯৫ হাজার ৪২৮ টাকা। এরমধ্যে শুধু গত বছরের নভেম্বর মাসে আদায় হয়েছে ৭ লাখ ৯১ হাজার ৫৫৭ টাকা। চলতি মৌসুমে সর্বমোট আদায় হয়েছে ১৫ লাখ ৬৮ হাজার ৫৪ টাকা। সেই তথ্যে দেখা যায়, জেলার সীতাকুন্ড উপজেলায় শতভাগ খাজনা আদায় করা হয়েছে। তবে রাঙ্গুনিয়া, বোয়ালখালী, আনোয়ারা, সাতকানিয়া ও বাঁশখালী উপজেলায় কোনো অর্থ আদায় হয়নি। মিরসরাই উপজেলায় ১৪ ইটভাটা থেকে দুই লাখ ১১ হাজার ৬৮০ টাকার খাজনা দাবি করা হয়। এর বিপরীতে গত নভেম্বর মাস পর্যন্ত সময়ের মধ্যে আদায় হয়েছে ১৩ হাজার ৩০০ টাকা। সীতাকুন্ড উপজেলায় আটটি ইটভাটায় ছয় লাখ ৩৯ হাজার ২৭৯ টাকার খাজনা দাবি করা হয়। দাবির বিপরীতে শতভাগ খাজনা আদায় হয়েছে। সন্দ্বীপ উপজেলায় ১৬ ইটভাটা থেকে দুই লাখ ৪৪ হাজার ৬৪০ টাকার খাজনা দাবি করা হয়। আদায় হয়েছে এক লাখ ৮৫ হাজার ৪৩৩ টাকা।
ফটিকছড়িতে ৪৩ ইটভাটায় ১০ লাখ ৪৫ হাজার ৪ টাকার খাজনা দাবি করা হয়। আদায় হয়েছে ৫৪ হাজার ৯৩২ টাকা। হাটহাজারী উপজেলায় ৩২ ইটভাটায় ৬ লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ টাকার খাজনা দাবি করা হয়। আদায় হয়েছে ৪ লাখ ৮৪ হাজার ৫০০ টাকা। রাউজান উপজেলায় ৪৭ ইটভাটায় দুই লাখ ৬০ হাজার ৩০০ টাকার খাজনা দাবি করা হয়। আদায় হয়েছে ৩৪ হাজার ২০০ টাকা। রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় ৭০ ইটভাটায় ৫ লাখ ৩৯ হাজার ২০০ টাকার খাজনা দাবি করা হয়। দাবির বিপরীতে কোনো টাকাই আদায় হয়নি। বোয়ালখালী উপজেলায় ২ ইটভাটায় ২২ হাজার ১৭৯ টাকার খাজনা দাবির প্রেক্ষিতে কোনো টাকা আদায় হয়নি। কর্ণফুলী উপজেলায় ৮ ইটভাটায় ৬৮ হাজার টাকার খাজনা দাবি করা হয়। আদায় হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। আনোয়ারা উপজেলায় দুই ইটভাটায় ১৮ হাজার ৪৮০ টাকার খাজনা দাবির বিপরীতে কোন অর্থই আদায় হয়নি। চন্দনাইশ উপজেলায় ৩২ ইটভাটায় চার লাখ ৭০ হাজার ৭৬৪ টাকার খাজনা দাবি করা হয়। আদায় হয়েছে ৩৪ হাজার এক টাকা। সাতকানিয়া উপজেলায় ৫৩ ইটভাটায় ১০ লাখ ৭৪ হাজার ৫৬৭ টাকার খাজনা দাবি করা হয়। এর বিপরীতে কোনো অর্থ আদায় হয়নি। লোহাগাড়া উপজেলায় ৪২ ইটভাটায় ৫ লাখ ৫ হাজার ৪৪০ টাকার খাজনা দাবি করা হয়। আদায় হয়েছে ৪৩ হাজার ৪০৯ টাকা। বাঁশখালী উপজেলায় চার ইটভাটায় এক লাখ ২৮ হাজার ৩৯৫ টাকার খাজনা দাবির প্রেক্ষিতে এক টাকাও আদায় হয়নি। সব মিলিয়ে ৫৮ লাখ ৯৫ হাজার ৪২৮ টাকার বিপরীতে গত নভেম্বর মাসে আদায় হয়েছে মাত্র ৭ লাখ ৯১ হাজার ৫৫৭ টাকা। যা মোট খাজনা আদায় লক্ষ্যমাত্রার ২৭ শতাংশ। এখন পর্যন্ত ৭৩ শতাংশ খাজনা বকেয়া রয়েছে। অন্যদিকে এসব ইটভাটা ফসলি জমি, পাহাড়, সংরক্ষিত বনের গাছ কেটে সাবাড় করছে। পুড়িয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে পরিবেশ। অভিযোগ রয়েছে, ইউএনও-ভূমি কর্মকর্তাদের সাথে ইটভাটা মালিক সমিতির দারুণ সখ্যতা রয়েছে। যাদের মাধ্যমে প্রতিবছর অর্ধকোটি টাকারও বেশি পকেটে ঢুকছে তাদের। সে কারণে কোনরকম লাইসেন্স ছাড়া সম্পূর্ণ অবৈধভাবে ইটভাটাগুলো চললেও নাকের
ডগায় তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছেন ইউএনও ও ভূমি কর্মকর্তারা। গত ২৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নে কেবিএম ও সম্রাট নামে দুটি অবৈধ ইটভাটার চিমনিসহ কিলন ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে পরিবেশ অধিদফতর। অভিযানে নেতৃত্ব দেন পরিবেশ সদর দফতরে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. রেজওয়ান-উল-কাদের। অথচ এই উপজেলায় ৭০টি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। অভিযানে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক
মো. মোজাহিদুর রহমান। তিনি বলেন, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন আইন ২০১৩ (সংশোধন আইন ২০১৯) এর কতিপয় ধারা লঙ্ঘন করায় রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নে মেসার্স আব্দুল করিম ব্রিকস (কেবিএম) ও একই এলাকার মেসার্স সৌদিয়া অ্যান্ড কোং (সম্রাট) ইটভাটার চিমনিসহ কিলন ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। পরিবেশ রক্ষায় এ অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি। স্থানীয়রা জানান, রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ইসলামপুর, রাজানগর, লালানগর, হোসনাবাদ, চন্দ্রঘোনা কদমতলি, সরফভাটা, পোমরা ও কোদালা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় ১২০টিরও বেশি ইটভাটা রয়েছে। যদিও পরিবেশ অধিদফতর বলছে, রাঙ্গুনিয়ায় ইটভাটার সংখ্যা ৭০টি। আর এসব ইটভাটায় প্রতিনিয়ত পোড়ানো হচ্ছে সংরক্ষিত বনের কাঠ ও টায়ার। এতে দুষণ হচ্ছে পরিবেশ। ইট তৈরীর উপকরণ হিসেবে ফসলি জমির টপসয়েল ও পাহাড় কেটে ধ্বংস করা হচ্ছে। যা দেখেও নাকের ডগায় তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা প্রশাসন।
অভিযোগ রয়েছে, মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও দেশের শীর্ষ সংবাদপত্রগুলোর স্থানীয় প্রতিনিধিরা পেশাদার রাঙ্গুনিয়া প্রেসক্লাবের নামে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট গড়ে তোলে দেশ ও পরিবেশ বিধ্বংসি এসব ইটভাটা সচলে সহযোগীতা করছে। এ বিষয়ে জানতে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদুল হাসানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে সরকার পরিবর্তনের পর গঠিত ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপি নেতা ইউসুফ চৌধুরী বলেন, ইটভাটাগুলোর পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র আছে, কিন্তু নবায়ন হয়নি। সেই সূত্রে জেলা প্রশাসনেরও কোন অনুমোদন নেই।
এরপরও কীভাবে চলছে ইটভাটা জানতে চাইলে ইউসুফ চৌধুরী বলেন, রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ও মানুষের জীবন-যাপনে ইটের প্রয়োজন আছে। সেই সূত্রে ইটভাটা চালু রাখা হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রামসহ সারাদেশে যেভাবে ইটভাটাগুলো চলছে সেভাবে রাঙ্গুনিয়ায়ও চলছে। তবে ইটভাটা নিয়ে কিছু কিছু গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশে আক্ষেপও প্রকাশ করেন তিনি। এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম জেলা ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির সভাপতি ও রাউজান পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. জমির উদ্দিন পারভেজ, সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার শামসুল আলম তালুকদারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তারা গা ঢাকা দেন।

শেয়ার করুনঃ