২৭ এপ্রিল ২০২৪ / ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / সন্ধ্যা ৬:৫৬/ শনিবার
এপ্রিল ২৭, ২০২৪ ৬:৫৬ অপরাহ্ণ

সর্বশ্রেষ্ঠ জিকির ও দোয়া : লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং আলহামদুলিল্লাহ

     

ফখরুল ইসলাম নোমানী
মানবজীবনের সব দিক ও বিভাগে যাঁকে অনুসরণ করলে মহান আল্লাহর নৈকট্য ও ভালোবাসা অর্জিত হবে তিনি হলেন সেই সর্বোত্তম
আদর্শ মহানবী (স.)। তিনি সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনায় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতেন। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ হচ্ছে ঈমানের সত্তরটি
শাখার মধ্যে সর্বোত্তম। যার কারণে এ কালিমার জিকিরে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ফজিলত। যে ব্যক্তি সবসময় লা ইলাহা ইল্লাহর জিকির
করবে আল্লাহতাআলা তাকে ঈমানের সঙ্গে মৃত্যু নসিব করবেন। আলহামদুলিল্লাহ শব্দের অর্থ সম¯ত প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য। যে
কোনো উত্তম আনন্দময় ও শুভ খবরে ভালো কিছুর জন্য এটি বলা হয়ে থাকে। পছন্দনীয় কিছু দেখলে বা শুনলে আলহামদুলিল্লাহ
বলতে হয়। আলহামদুলিল্লাহ শব্দের মধ্যে আছে হামদ শব্দটি। আমরা আল্লাহর গূণকীর্তি করে হামদ গাই। হামদ অর্থ প্রশংসা। ভালো
কোনো খবর শুনলে আলহামদুলিল্লাহ বলা সুন্নত। কোরআন পড়া শুরুই করতে হয় আলহামদুলিল্লাহ বলে। এ ছাড়া কোরআনের
অন্যান্য প্রায় সব সুরাই যে এই বাক্য দিয়ে শুরু করতে হয় তা থেকেই এর তাৎপর্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। মহানবী (সা.)-বলেছেন
আল্লাহর কাছে চারটি বাক্য প্রিয়-সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার। হাদিসে আছে আল্লাহর
মাহাত্ম্য বর্ণনা ও প্রশংসার জন্য আলহামদুলিল্লাহর চেয়ে উত্তম বাক্য আর নেই। আলহামদুলিল্লাহ বলার ফজিলত অগণিত। এই শব্দ
হাশরের ময়দানে কাজে আসবে। মহানবী (সা.)-বলেন আলহামদুলিল্লাহ মিজান (হাশরের মাঠের আমল মাপার যন্ত্র) পূর্ণ করে দেয়।
অন্য হাদিসে এরশাদ হয়েছে-যদি আমার কোনো উম্মতকে পুরো দুনিয়া দিয়ে দেওয়া হয় আর সে আলহামদুলিল্লাহ বলে তাহলে এই
শব্দ পুরো দুনিয়া থেকে উত্তম। (অর্থাৎ, পুরো পৃথিবী পেয়ে যাওয়া এত বড় নিয়ামত নয় যা আলহামদুলিল্লাহ বলার মধ্যে রয়েছে।
কারণ এই পৃথিবী তো একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে কিন্তু আলহামদুলিল্লাহর সওয়াব থেকে যাবে। আল্লাহতায়ালা কোরআন শরিফের সূরা
ফাতিহা, সূরা আনআম, সূরা কাহাফ, সূরা সাবা ও সূরা ফাতির ‘আলহামদুলিল্লাহ’ শব্দের মাধ্যমে শুরু করেছেন। এছাড়াও কোরআনের
বিভিন্ন আয়াতে আলহামদুলিল্লাহ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। আরেকটি হাদিসে বলা হয়েছে আল্লাহ সবচেয়ে বেশি নিজের প্রশংসা
পছন্দ করেন এ জন্য তিনি নিজের প্রশংসা করেছেন এবং আমাদেরও তাঁর প্রশংসার নির্দেশ দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহকে সবচেয়ে
উত্তম দোয়া বলা হয়েছে। মহানবী (সা.)-বলেছেন সর্বোত্তম ফজিলতপূর্ণ বাক্য লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং সর্বোত্তম দোয়া
আলহামদুলিল্লাহ। মহানবী (সা.)-আরও বলেছেন আলহামদুলিল্লাহ আমলের পাল্লা পূর্ণ করে দেয়। আর সুবহানাল্লাহ ও
আলহামদুলিল্লাহ শব্দ দুটি আসমান ও জমিনের খালি জায়গা পূর্ণ করে দেয়। মূলত আলহামদুলিল্লাহ শব্দটি মুমিনের সফলতার
সোপান। কেননা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার জন্য আলহামদুলিল্লাহ পাঠ কর হয়। আর শুকরিয়া আদায়কারীদেরকে শুধু
নেয়ামতের ওপরই রাখা হয়। তাদের ব্যাপারে আল্লাহতাআলা বলেন যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় করো তবে আমি অবশ্যই তোমাদের
(নেয়ামত) বাড়িয়ে দেবো আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও নিশ্চয়ই আমার আজাব বড় কঠিন। (সুরা ইবরাহিম : ০৭)
প্রিয়নবী (স.)-বলেছেন যখন তুমি আলহামদুলিল্লাহ বলার মাধ্যমে আল্লাহতাআলার শুকরিয়া আদায় করবে তখন আল্লাহতায়ালা
নেয়ামতে বরকত দেবেন। খাওয়া-দাওয়ার পরে সকল খুশির খবরে বাথরুমের কাজ সেরে হাঁচি দিয়ে যেকোনো কাজ-কর্ম শেষ করার
পরে এবং আল্লাহর অসংখ্য নেয়ামতের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সবসময় আলহামদুলিল্লাহ বলা মুমিনের বৈশিষ্ট্য। আনাস (রা.)-বর্ণনা করেন
রাসুলুল্লাহ (স.)-বলেছেন নিশ্চয় আল্লাহ সেই বান্দার প্রতি সন্তুষ্ট হন যে বান্দা কিছু খেলে আল্লাহর প্রশংসা করে এবং কিছু পান করলেও
আল্লাহর প্রশংসা করে (অর্থাৎ আলহামদুলিল্লাহ) পড়ে। তার মানে সবকিছুতেই আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করতে উৎসাহিত করা হয়েছে।
এমনকি প্রিয়ব¯তু হারানোর পরও আলহামদুলিল্লাহ বলতে অভ্য¯ত বান্দার জন্য জান্নাতে বিশেষ নেয়ামতের ঘোষণা দিয়েছেন প্রিয়নবী
(স.)। আবু মুসা আশআরি (রা.)-বর্ণিত হাদিসে মহানবী (স.)-ইরশাদ করেছেন যখন কোনো বান্দার সন্তান মারা যায় তখন মহান
আল্লাহ (জান কবজকারী) ফেরেশতাদের বলেন তোমরা আমার বান্দার সন্তানের প্রাণ হরণ করেছ কি ? তারা বলেন হ্যাঁ। তিনি বলেন
তোমরা তার হৃদয়ের ফলকে হনন করেছ ? তারা বলেন হ্যাঁ। তিনি বলেন সেসময় আমার বান্দা কী বলেছে ? তারা বলেন সে আপনার
হামদ (প্রশংসা) করেছে ও ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন পাঠ করেছে। মহান আল্লাহ বলেন আমার (সন্তানহারা) বান্দার জন্য
জান্নাতের মধ্যে একটি গৃহ নির্মাণ করো আর তার নাম রাখো ‘বায়তুল হামদ’ (প্রশংসাভবন)। অসুস্থ ব্যক্তির আলহামদুলিল্লাহ বলা
সম্পর্কে হাদিসে কুদসিতে এসেছে-মহান আল্লাহ বলেন যখন আমি আমার মুমিন বান্দাকে রোগাক্রান্তকরি আর বান্দা সে অবস্থায় আমার
প্রশংসা করে আলহামদুলিল্লাহ বলে ; তবে সে বিছানা থেকে এমনভাবে ওঠে দাঁড়ায় ; যেন তার মা তাকে ভূমিষ্টকালে যেমন জন্মদান
করেছিল। (হাদিসে কুদসি)।
আলহামদুলিল্লাহ বলার প্রচলন থাকবে জান্নাতেও। মহান আল্লাহ বলেন তাদের অন্তরে যা কিছু মালিন্য (দুঃখ ও ঈর্ষা) ছিল তা বের
করে দেব। তাদের তলদেশে ঝরনাধারা প্রবাহিত হবে। (এসব দেখে) তারা বলবে আলহামদুলিল্লাহ যিনি আমাদের এ পর্যন্ত(জান্নাতে)
পৌঁছিয়েছেন। আমরা কখনো (এ পর্যন্ত) পৌঁছতে পারতাম না যদি আল্লাহ আমাদের না পৌঁছাতেন। (সুরা আরাফ : ৪৩) ।
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর জিকিরের গুরুত্বপূর্ণ ফজিলতের কয়েকটি হাদিস তুলে ধরা হলো : –
ক. হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ হতে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন সর্বোত্তম জিকির হচ্ছে-লা ইলাহা
ইল্লাল্লাহ এবং সর্বোত্তম দোয়া হলো আল-হামদুলিল্লাহ। খ. হজরত মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে ব্যক্তি খালেস অন্তরে একনিষ্ঠতার সঙ্গে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। গ. হজরত
ইতবান বিন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহকে
সন্তুষ্ট করার জন্য-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে ক্বিয়ামাতের দিন সে এমনভাবে উপস্থিত হবে যে তার উপর জাহান্নাম হারাম হয়ে গেছে।
ঘ. হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন কিয়ামাতের দিন আল্লাহতাআলা
বলবেন হে মুহাম্মাদ! সৃষ্টির মধ্য হতে আপনার উম্মতের মধ্যকার এমন ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশ করান যে ব্যক্তি একদিন হলেও
ইখলাসের সঙ্গে এ সাক্ষ্য দিয়েছে যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নাই এবং সে এর উপর মৃত্যুবরণ করেছে।
উচ্চারণ : লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। অর্থাৎ-আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। আর অতি উত্তম দোয়া হলো-আলহামদুলিল্লাহ
অর্থাৎ-সকল প্রশংসা শুধু মহান আল্লাহর জন্য। মুমিন, মাত্রই সব সময় এ জিকির ও দোয়ায় মশগুল থাকে। দুটি কালেমাই আল্লাহর
কৃতজ্ঞতা ও একত্ববাদের স্বীকৃতির সর্বশ্রেষ্ঠ বাক্য। যা মানুষকে অনুগত ও কৃতজ্ঞবান্দায় পরিণত করে দেয়।
গ্রীষ্মের দুপুর। কণ্ঠ শুকিয়ে কাঠ। তৃষ্ণায় প্রাণ যায় যায় করছে। মরুর পথিক। ধরেই নিয়েছে এবার বুঝি আর রক্ষা নেই। তব্ওু বাঁচার
আকুতি। কাতর কণ্ঠে করুণ মিনতি। প্রভু ওগো, পানি দাও, জীবন বাঁচাও! এদিক ওদিক করতে করতে সহসা চোখ যায় দূর
পাহাড়ের গায়। কী যেন চিকচিক করছে। পথিকের মনে আশার সূর্যোদয় হলো। সামনে বাড়তেই ছানাবড়া চোখ। পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে
পড়ছে স্বচ্ছ জলধারা। আহা! কী আনন্দ তার মনে। অঞ্জলি ভরে ঢোক ঢোক করে পান করে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস নেয়ারও বুঝি সময় নেই।
অবশেষে তৃপ্ত। দেহ-মন প্রফুল্ল। লম্বা একটা নিঃশাস টেনে উচ্ছ্বাস ছেড়ে বলে ওঠে-আলহামদুলিল্লাহ (সমুদয় প্রশংসা আল্লাহর)।
অবশ্যই আলহামদুলিল্লাহ বাক্যটির মধুরতা কী পরিমাণ সেটাও হয়তো বলে শেষ করা যাবে না। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে কত
কোটি মুমিনের মুখে পঠিত হয় তার হিসাব করা ভার। আলহামদুলিল্লাহর ফজিলত বর্ণনায় নবীজি (স.)-বলেছেন-যে ব্যক্তি সকালবিকাল (সূর্যোদয়ের আগে ও সূর্যা¯েতর আগে) এই দুই সময়ে ১০০ বার-আল-হামদুলিল্লাহ বলল সে যেন আল্লাহর পথে জিহাদের জন্য
১০০টি ঘোড়ার পিঠে মুজাহিদ প্রেরণ করলো অথবা আল্লাহর রা¯তায় ১০০টি গাজওয়া বা অভিযানে শরিক হলো।
আল্লাহতাআলা, মুসলিম উম্মাহকে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর জিকির করার মাধ্যমে মৃত্যুর সময় কালিমা নসিব এবং আমাদের সবাইকে
সুসময়ে-দুঃসময়ে বেশি বেশি আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply