২৯ এপ্রিল ২০২৪ / ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ভোর ৫:২৫/ সোমবার
এপ্রিল ২৯, ২০২৪ ৫:২৫ পূর্বাহ্ণ

বিশ্ব নেতাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাবনা বাংলাদেশ কৃষিতে পেয়েছে অভাবনীয় সফলতা

     

বিপ্লব কান্তি নাথ

বৈশ্বিক খাদ্যসংকটের ঝুঁকির কথা বলা হলেও কৃষিতে অভাবনীয় সফলতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ব ব্যাংকও বলেছে, বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতি হয়নি। ফলে সুবিধাজনক অবস্হায়ই ক্ষমতার তৃতীয় মেয়াদের পঞ্চম বছরে পা রেখেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
করোনা সংক্রমণের কারণে দেশের সবকিছু যখন স্হবির, তখনও সচল ছিল কৃষির চাকা। এরই মধ্যে চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ দুঃসময়ে কৃষিই সম্ভাবনার পথ দেখাচ্ছে। শুধু করোনা সংকটে নয় গত এক দশকে ঝড়, জলোচছাস, বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামলে কৃষি বার বার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ধান, গম, ভুট্টা, আলু, সবজি ও মাছ উৎপাদনে শীর্ষ কাতারে উঠে এসেছে বাংলাদেশ।
এক সময় বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে তাচ্ছিল্য করা হয়েছিল। সেই বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। কৃষি নির্ভর অর্থনীতি ছিল এক সময় এ অঞ্চল। কিন্তু কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসে শিল্প ও সেবাখাতমুখী হয়েছে অর্থনীতি। সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেছে অর্থনৈতিক কাঠামোও। বিশাল জনসংখ্যার দেশে কৃষিজমি কমলেও কৃষি এখনও অর্থনীতির প্রাণ।
প্রযুক্তির ছোঁয়া পেয়েছে কৃষি। বদলে যাওয়া এ সময়ে কৃষিতে যুক্ত হচ্ছেন শিক্ষিত তরুণরাও। ফলে খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে অনন্য উদাহরণ।
কৃষি বিজ্ঞানীদের খাদ্যশস্যের নতুন নতুন জাতের উদ্ভাবন, ভর্তুকি দিয়ে সার ও সেচের পানি প্রাপ্তি সহজ করা, বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগ সহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবন, ১ কোটি ৮০ লাখেরও বেশি কৃষকের মধ্যে কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড বিতরণ, ১০ টাকার বিনিময়ে কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলাসহ নানা রকম পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে গেলো ১৪ বছরে। যে কারণে বাংলাদেশ কৃষিতে পেয়েছে অভাবনীয় সফলতা।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ১৯৭১-’৭২ সালে মাথাপিছু জমির পরিমাণ ছিল ২৮ শতাংশ, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১০ শতাংশ। প্রতিবছর দেশে মানুষ বাড়ছে ২০ লাখেরও বেশি। কৃষি জমি কমছে ৮ লাখ হেক্টর। তারপরও জনপ্রতি সরবরাহ কমছে না কৃষি পণ্যের, বরং তা দিন দিন বাড়ছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি এখনো কৃষি। বিশ্বে বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে তৃতীয় স্হানে থাকলেও বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নে বাংলাদেশের স্হান হলো সবার ওপরে।
২০১৯-’২০ অর্থবছরে দেশে রেকর্ড ৩ কোটি ৮৯ লাখ টন চাল উৎপাদন করে ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে দেয় বাংলাদেশ। আর চাল উৎপাদনকারী শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে তৃতীয় স্হানে  উঠে এসেছে দেশটি। এছাড়া ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম, পাট উৎপাদনে বাংলাদেশ দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, মৎস্য উৎপাদনে তৃতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম এবং আলু উৎপাদনে সপ্তম স্হানে রয়েছে। এছাড়া কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বের দ্বিতীয় এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্হানে বাংলাদেশ।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চার গুণ, গম দুই গুণ, ভুট্টা ১০ গুণ ও সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। খাদ্যশস্য ছাড়াও মাছ উৎপাদনেও বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে মাছ রফতানিও বাড়ছে। আলু উৎপাদনে উদ্বৃত্ত। তাই দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা আর ক্ষুধার দেশে এখন ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহে।
স্বাধীনতার পর দেশের ৮৫ শতাংশ মানুষ কৃষির ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে এ হার ৪০.৬ শতাংশ। ১৯৭৩-৭৪ সালে জিডিপিতে কৃষির অবদান ছিল ৫৮.০৪ শতাংশ, ২০১৯-২০ সালে ১৩.৩০ শতাংশ, বর্তমানে তা ২০ শতাংশের নিচে নেমে এলেও মোট অবদান বেড়েছে প্রায় ৬.০ গুণ। বাংলাদেশে কৃষি জাতীয় অর্থনীতির জীবনীশক্তি। দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪২ দশমিক ৬২ শতাংশ কৃষিক্ষেত্রে নিয়োজিত।
গত ২৪ জুলাই ইতালির রোমে অবস্হিত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্হার (এফএও) সদর দফতরে খাদ্য ব্যবস্হাপনা বিষয়ক সম্মেলনে উদ্বোধনী সেশনে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের মাননীয় প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিশ্বব্যাপী টেকসই, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য ব্যবস্হা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ খাদ্য সম্মেলনে পাঁচ দফা প্রস্তাব পেশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকটের অশনি সংকেত। খিদেয় কাতরাচ্ছে কোটি কোটি মানুষ। বাঁচবে কীভাবে ? পথ দেখাল বাংলাদেশ। জাতিসংঘে প্রস্তাব পেশ করলেন শেখ হাসিনা। হাতে হাত মিলিয়ে সবাইকে একসাথে চলার আহ্বান। জলবায়ু পরিবর্তনের কাছে কিছুতেই হার মানবে না বাংলাদেশ। প্রতিমুহূর্তে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা। তাহলে কি ভবিষ্যতে বাংলাদেশই হবে পথপ্রদর্শক ? এত সহজে কিভাবে বাংলাদেশ খাদ্য সংকট মোকাবিলা করছে ?
বিশ^ব্যাপী ভবিষ্যতে ভয়ঙ্কর দিন আসতে চলেছে। গোটা বিশ্বকে দেখতে হবে খাদ্য সংকট। বিষয়টি নিয়ে, অনেক আগে থাকতে সচেতন বাংলাদেশ। জাতিসংঘের খাদ্য সম্মেলনে, গোটা বিশ্বজুড়ে টেকসই, নিরাপদ আর পুষ্টিকর খাদ্য ব্যবস্হা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঁচ দফা প্রস্তাব পেশ করলেন। যার প্রত্যেক পয়েন্ট ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর কথায় উঠে এসেছে বিশ্বজুড়ে দারিদ্র আর অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের দুর্দশা কষ্ট আর হাহাকারের কথা। বিশ্বে অপুষ্টিতে ভুগছে, প্রায় ৬৯০ মিলিয়ন মানুষ। ২ বিলিয়ন মানুষের কাছে খাদ্যের কোন নিরাপত্তাই নেই। ৩ বিলিয়ন মানুষের মুখে পৌঁছায় না সুষম খাবার। একদিকে ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ, অপরদিকে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা। সার, জ্বালানি, আর্থিক সংকটে জর্জরিত গোটা বিশ্ব। এই সময় টেকসই খাদ্য ব্যবস্হাপনা যে কতটা ইম্পর্ট্যান্ট তা সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুধুমাত্র কৃষি আর খাদ্য পণ্যের উপর জোর দিলে হবে না, চাই সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ৫ প্রস্তাবের মধ্যে ছিল 
প্রথম প্রস্তাব : আধুনিক কৃষিতে বিনিয়োগের জন্য বহুপাক্ষিক উন্নয়ন ব্যাংক এবং বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আর্থিক প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা প্রদান করা প্রয়োজন।
দ্বিতীয় প্রস্তাব : জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্যোগে ‘ব্ল্যাক সি গ্রেইন ডিল’-কে চালু রাখার পাশাপাশি খাদ্য ও সার রপ্তানির বিধি-নিষেধগুলো তুলে নেওয়াসহ যে কোন বাণিজ্য বাঁধা অপসারণের লক্ষ্যে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত দরকার।
তৃতীয় প্রস্তাব : জরুরি পরিস্হিতি মোকাবিলায় বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক ‘ফুড ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্হার রূপান্তরের লক্ষ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সহায়তায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে।
চতুর্থ প্রস্তাব : কৃষিশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে তাল রেখে ন্যানো-প্রযুক্তি, বায়ো-ইনফরমেটিক্স ও অত্যাধুনিক কৃষি প্রযুক্তিগুলো সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া বাঞ্ছনীয়।
পঞ্চম প্রস্তাব : প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের অপচয় রোধে তরুণ সমাজকে অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়ে ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি।
শেখ হাসিনার ভাস্যঅনুযায়ী, ২০০৯ সাল নাগাদ বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতি ছিল প্রায় ২৬ লক্ষ মেট্রিক টন। নতুন নতুন পদক্ষেপ আর কৃষকদের সহযোগিতায় ২০১৩ সালের মধ্যে দেশটা নিজেদের খাদ্য নিজেরাই অর্জন করে। উপরন্ত প্রচুর খাদ্য বেঁচেও যায়। বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ খাদ্য উৎপাদনকারী ১০টা দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। ধান, মাছ এবং সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয়, আলু উৎপাদনে ষষ্ঠ, পাট উৎপাদনের দ্বিতীয়। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে হাইড্রোপনিক এবং অ্যারোপনিক কৃষি পদ্ধতিতে চাষ হয়, যা জলবায়ু অভিযোজনের অন্যতম উদাহরণ। কৃষকদের সহায়তার জন্য রয়েছে ডিজিটাল প্রযুক্তি। গোটা দেশ জুড়ে প্রায় ৫০০টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র রয়েছে। দীর্ঘদিন জলাবদ্ধতা আর খরা প্রতিরোধে ধানের জাত নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা। পুষ্টির উন্নতির জন্য দেশটি প্রায় আটটি ধানের জাত প্রবর্তন করেছে। ধীরে ধীরে দেশটা জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। যাই হয়ে যাক, সাধারণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা আগে দরকার। এভাবেই বাংলাদেশ গোটা বিশ্বের কাছে হয়ে উঠছে উজ্জ্বল উদাহরণ।
মানণীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তব্যের সময় জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্হার (এফএও) সদর দপ্তরের প্লেনারি হল রুমে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান, মন্ত্রী, রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি, বিভিন্ন সংস্হার প্রতিনিধি ও আমন্ত্রিত অতিথিরা উপস্হিত ছিলেন।
প্লেনারি হল ছাড়াও জাতিসংঘের সদরদপ্তরে গ্রিন রুম, রেড রুম, ইরান রুমসহ বেশ কয়েকটি হল রুমে বড় পর্দায় প্রদর্শন করা হয়। এসব রুমে বিপুল সংখ্যক শ্রোতা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শোনেন এবং করতালির মাধ্যমে তার বক্তব্যকে সমর্থন জানান।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ, নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কামাল দহল, সামাও এর প্রধানমন্ত্রী ফিয়ামি নাওমি মাতাফা, ইতালির উপ-প্রধানমন্ত্রী অ্যান্তেনিও তাজানি, জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস।
২৪ থেকে ২৬ জুলাই রোমে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্হা আয়োজিত জাতিসংঘ খাদ্য ব্যবস্হাপণা সম্মেলনে ২০টির বেশি রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানসহ ১৬০টির বেশি দেশ থেকে প্রায় ২ হাজারের অধিক প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ অংশগ্রহণ করছেন।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply