২৯ এপ্রিল ২০২৪ / ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / সকাল ৬:৩১/ সোমবার
এপ্রিল ২৯, ২০২৪ ৬:৩১ পূর্বাহ্ণ

তিস্তার জল নয়, মমতার গোয়ার্তুমীর জল ঢেলে দিলো প্রত্যাশার সফরে

     

এস এম মনসুর নাদিম
প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিপক্ষীয় সফরে ভারতে গিয়েছিলেন প্রচুর উপহার সামগ্রী নিয়ে। বাঙালির সংস্কৃতি খালি হাতে কোথাও যেতে নেই। পবিত্র ইসলাম ধর্মেও উপহারের আদান-প্রদান করাকে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি প্রনব মুখার্জি ও প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ছাড়াও তাদের পরিবারের সদস্য ব্যতীত শেখ হাসিনা যাদের জন্য উপহার সামগ্রী নিয়েছেন তারা হলেন— ভারতের ভাইস প্রেসিডেন্ট, পশ্চিম বঙ্গের মুখ্য মন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী , প্রিয়াংকা গান্ধী।ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী অরুণ জেটলি, ভারি শিল্প মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম জে আকবর, বিজয় কুমার সিং ও জয়পুরের মুখ্যমন্ত্রী-গভর্নর সহ আরও অনেকের জন্য।
উপহার সামগ্রীর মধ্যে ছিল– আমাদের জাতীয় মাছ পদ্মার ইলিশ, বেনারশী শাড়ি, রাজশাহী সিল্কের পাজামা-পাঞ্জাবি, রুপার নৌকা, চামড়ার ব্যাগ, টি-সেট, গুড়ের সন্দেশ, চমচম, সাদা সন্দেশ, কালোজাম, দই,রসগোলা, চিত্রকর্ম ও ডিনার সেট।
ভরপুর হাতে নিয়ে যাওয়া এই অতিথি জাতির জন্য কী নিয়ে এলেন তাই এখন সর্বত্র চর্চা হচ্ছে। সাধারন মানুষ অন্য চুক্তি কী হল না হল তা নিয়ে চিন্তিত না। তারা শুধু তিস্তা চুক্তির কথাটাই গুরুত্ত্ব সহকারে দেখছে।
অনেক আশা ও বিশ্বাসে ভরপুর ছিল এবারের ভারত সফর। আওয়ামীলীগ সরকারের সাথে ভারতের সুসম্পর্ক সবসময় ঐতিহাসিক সত্য।রাষ্ট্রপতি প্রনব মুখার্জি ও মমতা ব্যানার্জির সাথে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খুবই ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান যত সমস্যা ও অসংগতি ছিল তার বেশিরভাগই আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে সমাধানের মুখ দেখেছে।তাইতো আশায় বুক বেঁধে শেখ হাসিনা বলেছেন-‘‘এই ভাবেই আমরা গঙ্গা জলচুক্তি করেছি। সীমান্ত হাট করেছি। তিস্তা জলবন্টন চুক্তিও সেই ভাবে করতে চাই।’’ বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা’র ৮ এপ্রিলের ভারত সফরটি ছিল ভারত-বাংলাদেশ উভয় দেশের জন্য রাজনৈতিক কারনে খুবই গুরুত্ত্বপুর্ন।ভারতের কূটনীতিকরা বলেছেন বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রীর সফরকে ভারত খুবই গুরুত্ত্বের সঙ্গে দেখছে। সরকার প্রধান হিসেবে নয়াদিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনে তাকে আতিথ্য দেয়ার ঘটনাও বিরল। সুচিতে ছিলনা কর্মকর্তারাও আগে থেকে কিছু বলেননি কিন্তু শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানাতে নিজেই ফুল হাতে বিমান বন্দরে হাজির হয়েছিলেন ভারতের প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সবার জন্য এটা একটা চমক ছিল শেখ হাসিনার জন্য তো বটেই। চারদিনের এই সফরে ভারত বাংলাদেশকে আশাতীত সম্মান দিয়েছে। সহযোগিতার সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার মূল লক্ষের এই সফরে জনগণের মূল চাওয়া ছিল তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা বা তিস্তা চুক্তি।
শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি’র নেতৃত্বে শীর্ষ বৈঠকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২২ টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হলেও তিস্তা চুক্তি ছিল অনুপস্থিত। অথচ তিস্তার জট কাটানোর লক্ষ্যে মোদির উদ্দ্যোগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে শীর্ষ বৈঠকের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত করা হয়। খুলনা-কোলকাতা বাস ও ট্রেন উদ্বোধনে তাকেও সঙ্গে রাখেন মোদি। ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সইয়ের কথা থাকলেও মমতার আপত্তিতে শেষ মুহুর্তে তা আটকে যায়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বলেছিলেন তাঁকে না জানিয়ে মনোমোহন সিংয়ের সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি চূড়ান্ত করেছিল বলে তিনি তাতে সায় দেননি।

১১ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হতেও রাজি হননি। এরপর ক্ষমতার পালা বদলে মোদি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ত্বে এলেও এখনো তিস্তার জট খুলতে পারেনি।  ৭ বছর পর শেখ হাসিনার বহুল প্রতীক্ষিত সফরে ৬টি চুক্তি,১৬টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হলেও সব ছাপিয়ে আলোচনা সেই তিস্তাতেই আটকে আছে।বাংলাদেশের মনোভাব বুঝতে পেরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন-‘আমাদের প্রতিশ্রুতি এবং অব্যাহত প্রচেষ্টা সম্পর্কে আমি আপনাকে এবং বাংলাদেশের জনগনকে আশ্বস্থ করতে চাই। আমি দৃঢভাবে বিশ্বাস করি যে, আমি ও আপনার সরকারই তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যার সমাধানে পৌছতে পারবে’। তিস্তা চুক্তি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘গুরুত্ত্বপুর্ন’ বলেও স্বীকার করেন মোদি।

পশ্চিবঙ্গের প্রায় সব রাজনৈতিক দলেরই মত, ঢাকা বরং অনেক ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। ভারত ওপশ্চিমবঙ্গের নেতাদের যথেষ্ট সময় দিয়েছে, যেন তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা সেরে নিতে পারে।বাংলাদেশের ন্যূনতম দাবি, মমতা একটি সমঝোতায় আসতে পারেন। কিন্তু এতোদিন অপেক্ষার পরওমমতা ঠিক আগের মতোই তিস্তা নিয়ে অনড় থাকার বিষয়ে তৃণমূল কংগ্রেস বাদে অন্য সব দল তীব্রপ্রতিবাদ জানিয়েছে এবং এর কঠোর সমালোচনা করেছে। মমতার গোয়ার্তুমী রাজনৈতিক অঙ্গনে সবিশেষ পরিচিত। আগেও বাংলাদেশ তিস্তার পানি থেকে বঞ্চিত ছিল মমতার একরোখা মনোভাবের কারনে। একেকবার একেক কথা বলেছিলেন মমতা। কোন সময় বলেন কেন্দ্রীয় সরকার আমাকে না জানিয়ে তিস্তা চুক্তি চূড়ান্ত করেছিল বলে আমি তাতে সায় দিই নাই। কখনো বলেন তিস্তায় জল নেই আমি কোত্থেকে দেবো ? এবার বললেন-তিস্তার বিকল্প তোর্সা সহ কিছু নদীর নাম, যেখান থেকে বাংলাদেশকে পানি দেয়া যায়। সরেজমিনে এ টি এন বাংলার মুন্নিসাহা   তার একটি সচিত্র প্রতিবেদনে দেখালেন তিস্তায় জলের কোন অভাব নেই। তাহলে বাংলাদেশে পানি দেয়ার মানসিকতার অভাব বললে কী ভুল বলা হবে ?এমনিতে মমতা সবসময় বাংলাদেশ ও বাঙালিদের ভালবাসার কথা ব্যাক্ত করেন। অথচ তার সকল গোয়ার্তুমীর সিদ্ধান্ত একরোখা স্বভাব বাংলাদেশ ও বাঙালির বিরুদ্ধে। ষোল কোটি বাঙালির মনে আজ প্রশ্ন জেগেছে-বাংলাদেশের প্রতি মমতার কেন এই মমতাহীন আচরণ ? এ কিসের রাজনীতি ? এ কেমন মানসিকতা ? শোনা যায় তিনি ও তার দল রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক, কোনও রকম ন্যূনতম রীতিনীতিমেনে চলায় বিশ্বাসী নয়। তাই কোনও কারণ না থাকার পরও এই ধরনের অহেতুক সমস্যা তৈরি হয়। কংগ্রেস রাজ্য সভাপতি অধীর চৌধুরীরও মোটামুটি একই বক্তব্য। তার মতে, যে সমস্যা নিয়ে বহুদিনআলাপ-আলোচনা হয়েছে, এবার চুক্তি করে ফেলা উচিত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার নিজের জিদ বাড়িয়েচলছেন, যেখানে ভারত সরকার তো বটেই, অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্কচায়। তৃণমূল কংগ্রেসের এই আচরণ খুবই দুর্ভাগ্যজনক। পশ্চিমবঙ্গে ভারতীয় জনতা পার্টি সভাপতিদিলিপ ঘোষ থেকে শুরু করে অন্য নেতাদের মতে, মমতা আসলে তার নিজের রাজ্যের ব্যাপক দুর্নীতিসহআর্থিক ও অন্যান্য বহু সমস্যার সমাধানের জন্য দিল্লির ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকেঅকারণে বলির পাঁঠা করা হচ্ছে, যেটা খুবই অন্যায়।

মমতার দেয়া বিকল্প প্রস্তাব শেখ হাসিনা গ্রাহ্য করেছেন বলে মনে হয়না । তিনি বলেছেন-তিস্তার ব্যাপারে মমতার প্রতি নয় মোদির প্রতিই তিনি আস্থা রাখছেন। তিস্তার পরিবর্তে মমতা বিকল্প নদী এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিদ্যুৎ দেবেন বলেছেন। মমতার এই বিতর্কিত ভুমিকার জন্য  তৃণমূল কংগ্রেস তথামুখ্যমন্ত্রী রাজ্য তো বটেই, দিল্লিতেও অনেকটাই একা এবং কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। সবারই প্রশ্ন, তিনিকি চান এখন আরও বিশ/ত্রিশ বছর ধরে তোরসা এবং অন্যান্য নদীর প্রবাহ নিয়ে অনুসন্ধান চলুক,যেখানে বাংলাদেশের পানির প্রয়োজন মেটানো দরকার এখনই? আরও প্রশ্ন, যদি প্রস্তাব তার ছিলই,তাহলে আগেই তিনি এ ব্যাপারে দিল্লিতে বা বাংলাদেশেই, এ সম্পর্কে কথাবার্তা শুরু করেননি কেন?মমতার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুসম্পর্কের কথা তো সবাই জানেন। কী কারণে এতগুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার শেষ মুহূর্তের জন্য ঝুলিয়ে রেখেছিলেন?

তাদের বক্তব্য, ভারতের স্বার্থ রক্ষার জন্য অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ, তারা নিম্ন অববাহিকারদেশ হিসেবে সব জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী শুষ্ক মৌসুমে আরও অধিক পানি দাবি করতেইপারে। এখানে না বলার প্রশ্ন ওঠে কী করে? এদিকে কলকাতার কিছু বিশ্লেষকের মতে, মমতার এইধরনের ঘোষণায় শুধু যে দুই দেশের মধ্যে অশান্তির বাতাবরণ তৈরি হবে, তাই নয়। লাভ হবেপাকিস্তানের, সুবিধা হবে দুই দেশের ধার্মীয় মৌলবাদীদের, যাদের জন্য এতদিন সীমান্তে, অবাধ যাতায়াতও বাণিজ্যের বিকাশ ঘটতে পারেনি।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply