২৭ এপ্রিল ২০২৪ / ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / সকাল ১১:২৬/ শনিবার
এপ্রিল ২৭, ২০২৪ ১১:২৬ পূর্বাহ্ণ

মাইজভাণ্ডারী দর্শন পরিপ্রেক্ষিত : তাওহিদে আদিয়ান

     

হাকিম মওলানা মুহম্মদ ইকবাল ইউসূফ
(১)
এক লক্ষ চব্বিশ হাজার নবী-রসুল (আ.), তাঁদের খলীফাগণ বা তাদের সাহাবীদের কেউই কখনো কাফেরদের সাথে কথাবার্তা বা আদান-প্রদান বন্ধ করেননি। সব নবী-রসুলই কাফেরদের কাছে সত্য প্রচার করতে এসেছিলেন। তাঁরা যদি কাফেরদের সাথে কথাবার্তা না বলতেন বা তাদেরকে বয়কট করে রাখতেন অথবা তাদের সাথে মেলামেশা ও বন্ধুসুলভ আচরণ না করতেন তাহলে তাদের আবির্ভাবের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যেত।
(২)
ইহুদীগণ হজরত উযাইর (আ.) কে আল্লাহ পুত্র, হজরত মরিয়ম (আ.) কে ব্যাভিচারিণী এবং হজরত ঈসা (আ.)-কে জারজ সন্তান বলে মনে করে (নাউযুবিল্লাহ মিন যালিকা)। তারা কুরআন শরিফকে এবং মহানবী হজরত মুহম্মদ (দ.)-কে মিথ্যা বলে মনে করে (নাউযুবিল্লাহ)। খ্রিস্টানদের একাংশ হজরত মরিয়ম (আ.) আর হজরত ঈসা (আ.)- কে ঈশ্বর বলে বিশ্বাস করে আবার আরেক দল খ্রিস্টান হজরত জিব্রাইল (আ.) এবং হজরত ঈসা (আ.)- কে খোদা বলে মান্য করে। একইসাথে, তারা কুরআন শরিফ ও মহানবী (দ.) কে মিথ্যা বলে প্রচার করে। এ ধরনের কাফের তথা ইহুদী খ্রিস্টানদের বিষয়ে সূরা মায়েদায় বলা হয়েছে, আহলে কিতাব এর রান্না করা খাদ্য তোমাদের জন্য হালাল এবং আহলে কিতাবের সতী-সাধ্বী নারীদের সাথে বিয়ে করা তোমাদের জন্য বৈধ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’লা ইরশাদ করেন- ‘আল ইয়াওমা উহিল্লা লাকুমুত তাইয়্যেবাতু ওয়া তাআমুল্লাযীনা উতুল কিতাবা হিল্লুল লাকুম ওয়া তাআমুকুম হিল্লুল লাহুম ওয়াল মুহ্সানাতু মিনাল মু’মিনাতি ওয়াল মুহসানাতু মিনাল্লাযীনা উতুল কিতাবা মিন কাবলিকুম (সূরা মায়েদা: ৬)।
উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে, এমন ইহুদী ও খ্রিস্টান নারী যাদের ধর্মীয় বিশ্বাস পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, তারা যদি নোংরা চরিত্রের অধিকারী না হয় বরং পবিত্র জীবনাচরণে অভ্যস্ত হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে মু’মিন-মুসলমান পুরুষরা তাদের সাথে বিয়ে করতে পারে। যে ব্যক্তি উপরোক্ত আয়াতের শিক্ষানুযায়ী পূর্বে উল্লেখিত ধর্মীয় বিশ্বাস পোষণকারী ইহুদী অথবা খ্রিস্টান নারীদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে, বলা বাহুল্য, সে কাফের স্ত্রীর রান্না করা খাবার খাবে, তাকে দিয়ে কাপড় ধোয়াবে, তার সাথে প্রেমপ্রীতি ও ভালবাসার বন্ধন অটুট রাখবে। তার আত্মীয়-স্বজনদের সাথেও সম্প্রীতির বন্ধন রচনা করবে আর সাধ্যানুযায়ী তাদের আতিথেয়তা ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা করবে। নিজের কাফের স্ত্রীর আত্মীয়-স্বজনদের সুখ-দুঃখে অংশীদার হবে আর নিজ সুখ-দুঃখে তাদেরকে আহবান করবে। তা না হলে এদের দাম্পত্য জীবন কলহ-তিক্ততার শিকার হয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে।
ওয়া তাআমুল্লাযীনা উতুল কিতাবা হিল্লুল লাকুম- এর বাক্যটি স্পষ্ট বলে দিচ্ছে, জাগতিক ও বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে কাফেরদের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক অনেক বেশি গাঢ় ও সৌহার্দ্যপূর্ণ হওয়া উচিত। এ সম্পর্ক এত ভাল হতে হবে যার ফলে মুসলমানরা কাফেরদের বাড়িতে যাবে, তাদের বিয়ে ও অন্যান্য নিমন্ত্রণ ও অনুষ্ঠানাদিতে অংশগ্রহণ করবে। একইভাবে কাফেররাও মুসলমানদের বাড়িতে আসবে, এদের বিয়ে এবং অন্যান্য আনন্দঘন অনুষ্ঠানাদিতে অংশ নেবে আর বিভিন্ন দাওয়াতে যোগদান করবে। যখন সম্পর্ক এমন হৃদ্যতাপূর্ণ হবে, কেবল তখনই এ বিষয়ে প্রশ্ন দাঁড়াতে পারে, মুসলমানরা যখন ইহুদী খ্রিস্টানদের কাছে যাবে, আর তারা এদেরকে চা-নাস্তা বা খাবার পরিবেশন করবে, তখন মুসলমানদের জন্য কী করণীয়? আল্লাহ পাক বলেছেন ‘ওয়া তাআমুল্লাযীনা উতুল কিতাবা হিল্লুল লাকুম’ আহলে কিতাব জাতির প্রস্তুতকৃত খাদ্য তোমাদের জন্য হালাল।
মুসলমানরা যদি ইহুদী ও খ্রিস্টানদের সাথে কথাবার্তাই না বলে, তাদের সাথে জাগতিক সুসম্পর্ক না রাখে, তাদের সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে যোগদানই না করে, তাহলে কুরআন শরিফে বর্ণিত এ বাক্যটিই অহেতুক প্রতীয়মান হবে। মুসলমানরা যখন ইহুদী ও খ্রিস্টানদের সাথে বন্ধুত্ব রাখবে, আর কাফেররা এদের কর্মক্ষেত্রে, বসতবাড়িতে যাতায়াত করবে, কেবল তখনই প্রশ্ন হবে- কাফেরদের মেহমানদারী, চা-নাস্তা, খাবার খাওয়ানো বৈধ হবে কি না। এর উত্তরে আল্লাহ্ বলছেন, ‘ওয়া তাআমুকুম হিল্লুল লাহুম’ তোমাদের প্রস্তুতকৃত খাবার তাদের জন্য বৈধ।
(৩)
ধর্মের জন্য নবীদের চেয়ে বেশী অন্য কারো আত্মাভিমান থাকার কথা না। ধর্মের বিষয়ে আমাদের আত্মাভিমান নবীদের দৃষ্টান্ত অনুযায়ী হওয়া চাই। অতএব আল্লাহ তা’লা নবীদের বিষয় বর্ণনা করার পর বলেন, ‘উলাইকাল্লাযীনা হাদাল্লাহু ফাবিহুদাহুমুকতাদিহ’ (সূরা আনআম: ৯১)। অর্থাৎ এরাই তাঁরা যাদেরকে আল্লাহ তা’লা হেদায়ত দিয়েছিলেন। অতএব তোমরা তাঁদের হেদায়ত, আদর্শ অনুসরণ কর। আবার সূরা ইউসুফের শেষ আয়াতে আল্লাহ তা’লা বলেন, ‘লাকাদ কানা ফী কাসাসিহিম ইবরাতুল্লি উলিল আলবাব।’ অর্থাৎ নিশ্চয়ই নবীদের ঘটনাবলী ও বৃত্তান্তের মাঝে বুদ্ধিমানদের জন্য এক মহান শিক্ষা নিহিত। এই নীতি বর্ণনা করে কুরআন আমাদেরকে অবগত করছে, হজরত নূহ (আ.), হজরত লুত (আ.) দু’জনই নবী ছিলেন আর তাদের উভয়ের স্ত্রী কাফের (তথা অবিশ্বাসী) ছিলেন (সূরা তাহরীম: ১১)।
এতদসত্তে¡ও তাঁরা উভয়ে আপন স্ত্রীর সাথে কথাবার্তা বলা বন্ধ করেননি, তাদেরকে বয়কট করেননি। আর আল্লাহ তা’লা এই দুই নবীকে তাঁদের কাফের স্ত্রীর সাথে এমন ব্যবহার করার নির্দেশনা দেননি। স্ত্রীর রান্না করা খাবার তাঁরা খেতেন। কাফের স্ত্রীরাই তাঁদের খাবার রান্না করতেন, বাসন পরিষ্কার করতেন, নবীদের কাপড় ধুয়ে দিতেন, তাদের জন্য বিছানা প্রস্তুত করতেন।
হজরত নূহ (আ.) আল্লাহর নবী ছিলেন। তাঁর আপন পুত্র কাফের ছিল। হজরত নূহ (আ.) নিজ পুত্রকে ত্যাজ্য করেননি, বাড়ি থেকে বের করে দেন নি, তার সাথে রূঢ় আচরণ করেননি। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তুফান থেকে বাঁচানোর জন্য তাকে নিজের নৌকায় আসতে আহবান জানিয়েছেন। তুফান এলে হজরত নূহ (আ.) নিজের কাফের ছেলেকে বললেন, হে আমার প্রিয় পুত্র! এসো, আমার সাথে নৌকায় আরোহী হয়ে যাও (সূরা হুদ: ৪৩)। লক্ষ্যণীয়, তিনি সন্তানকে শুধুমাত্র আমার পুত্র নয় বরং আমার প্রিয় পুত্র বলেছেন।
(৪)
পবিত্র কুরআন বলে, শিরক সবচেয়ে বড় পাপ। যা আল্লাহ তা’লা ক্ষমা করবেন না। তারপরও বলেছেন, ‘তোমাদের পিতামাতা যদি মুশরেক, পৌত্তলিক হয় আর মূর্তিপূজায় এতটাই কট্টর হয়, আর তোমাদের শিরকে জড়িত করার চেষ্টা করে, তাহলে শিরকে লিপ্ত হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের কথা মানা যাবে না। তবে ‘ওয়া সাহিবহুমা ফিদ্দুনইয়া মা’রূফা’ (সূরা লুকমান: ১৬)। অর্থাৎ জাগতিক বিষয়ে তাঁদের সাথে সর্বোত্তম ব্যবহার করতে হবে।
(৫)
মক্কার কুরাইশরা তিন বছর পর্যন্ত প্রিয় রসূল (দ.), তাঁর পরিবার – পরিজন এবং সাহাবীদের বয়কট করেছিল। তখন তাদের কেউ যেমন মুসলমানদের কাছে আসতো না, তেমনি মুসলমানদের মধ্য থেকেও কাউকে নিজেদের কাছে আসতে দিত না। দয়াল নবীজি (দ.) সারাজীবনে কোনো একজন কাফেরকেও বয়কট করেননি (তাবারী, বিষয়, বয়কট শা’বে আবু তালিব, ইবনে সা’দ ও ইবনে হিশাম)।
(৬)
আবু জাহল মক্কার অলি-গলিতে স্থানীয় যুবকদের নিয়োজিত করেছিল। তারা শহরে প্রবেশকালে আগন্তুকদের বলত, তুমি আমাদের শহরে নবাগত। শহরের অবস্থা সম্পর্কে অবগত না। আমাদের শহরে একজন মানুষ আছে, যার নাম হজরত মুহম্মদ (দ.)। তাঁর কাছে যাবে না। সে তোমাদের ঈমান নষ্ট করে ফেলবে।
মহানবী (দ.) কখনো কোন সাহাবীকে কাফেরদের সাথে মিলামিশা করতে বারণ করেন নি। তিনি সাহাবীদের বলতেন তোমরা লোকদেরকে আমার পক্ষ থেকে আমার বাণী পৌঁছাও। তা একটি আয়াত হলেও’ (বুখারী, কিতাবুল আম্বিয়া, বাব মা যিকরে আন বনী ইসরাইল)।
(৭)
আল্লাহ তা’লা সূরা মায়েদার ৬ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেন, আজকের দিন তোমাদের জন্য সকল পবিত্র জিনিস হালাল আখ্যা দেয়া হয়েছে আর আহলে কিতাবের (পবিত্র) খাবারও তোমাদের জন্য হালাল তেমনিভাবে তোমাদের খাবারও তাদের জন্য হালাল।
সূরা মরিয়ম-এর ৮৯ আয়াত থেকে ৯২ আয়াতে আল্লাহ তা’লা বলেন, তারা আল্লাহ পুত্র আছে বলে দাবী করেছে।
‘ওয়া কালুত্তাখাযাল্লাহু ওয়ালাদা। লাকাদ জি’তুম শাইয়ান ইদ্দা। তাকাদুস্ সামাওয়াতু ইয়াতাফাত্তারনা মিনহু ওয়া তানশাক্কুল আরযু ওয়া তার্খিরুল জিবালু হাদ্দা। আন দাআউ লিররাহমানি ওয়ালাদা। আর তারা বলে, রহমান (খোদা) পুত্র বানিয়ে নিয়েছেন। নিশ্চয়ই তোমরা একটি মনগড়া বিষয় বানিয়ে এনেছ। আকাশ বিদীর্ণ হতে চায়, পৃথিবী খÐবিখÐ হতে চায় এবং পাহাড় ভেঙে পড়তে চায়।
বুখারী শরিফে লেখা আছে, যে ব্যক্তি কাউকে খোদার পুত্র বলে মান্য করল, সে প্রকারান্তে খোদাকে গালি দিল। (বুখারী, কিতাবুত তাফসীরুল কুরআন, বাব- ওয়া কালুত্তাখাযাল্লাহু ওয়ালাদা) খ্রিস্টানরা হজরত ঈসা (আ.)- কে খোদার পুত্র বলে মান্য করে। শিরক সবচেয়ে বড় পাপ। বর্ণিত আছে, আল্লাহ তা’লা অন্য সকল পাপ ক্ষমা করবেন। কিন্তু মুশরিক শিরক থেকে তওবা না করা পর্যন্ত তাদেরকে ক্ষমা করবেন না। খ্রিস্টানরা কুরআন করিম, রসুল পাক (দ.) এবং ইসলাম ধর্মকে অসত্য মনে করে। তবুও কুরআন করিম এমন গর্হিত বিশ্বাসে বিশ্বাসী খ্রিস্টানদের প্রস্তুতকৃত খাবারকে আমাদের জন্য বৈধ বলেছেন।
(৮)
বিশ্বনবী (দ.) এবং সাহাবাগণ কাফেরদের সাথে লেনদেন এবং জাগতিক ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন। প্রিয় নবী (দ.)’র তিরোধানকালে তাঁর একটি বর্ম এক ইহুদীর কাছে বন্ধক রাখা ছিল, যার নিকট থেকে তিনি ঋণ নিয়েছিলেন। (বুখারী, কিতাবুল বুয়ূ)
(৯)
মহানবী (দ.)-এর কাছে ইহুদী, খ্রিস্টান, অগ্নিউপাসক, মুশরিক, পৌত্তলিক নির্বিশেষে সবার আসার সুযোগ ছিল। তিনি তাদেরকে মদিনার সবচেয়ে উত্তম পবিত্রতম স্থান মসজিদে নববী শরিফে বসাতেন এবং নিজ ঘরের তৈজসপত্রে সেই কাফেরদেরকে আপ্যায়ন করতেন। কখনও যদি তাঁর নিজ ঘরে মেহমান সংকুলান না হতো তখন সাহাবীদেরকে দায়িত্ব দিতেন, তারা যেন ঐ কাফের মেহমানদের আতিথেয়তার ব্যবস্থা করেন। সেই কাফের মেহমানদেরকে মসজিদে নববী এবং সম্মুখের উঠানে শয্যা দিতেন। নিজ বিছানা- পত্র ব্যবহারের জন্যে তাদের দিতেন। এ প্রসঙ্গে একটি বিখ্যাত ঘটনা রয়েছে- একবার এক ইহুদী মেহমান রাতে নবী (দ.)’র বিছানায় মলত্যাগ করে যায়। সকালে দয়াল নবী স্বহস্তে তা ধুয়ে পরিষ্কার করেন।
(১০)
ইহুদী এবং খ্রিস্টানরা মহানবী(দ.)- কে মিথ্যাবাদী মনে করে কুরআনকে মিথ্যা গণ্য করে আল্লাহ একত্ববাদকে পরিত্যাগ করেছিল। তা সত্তে¡ও নবীর কাছে আগত কাফের মেহমান মসজিদে নববীতে বসে তাঁর সাথে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা এবং বিতর্ক করত। তাদের বিশ্বাসের স্বপক্ষে তারা প্রমাণ উপস্থাপন করত। ইসলামের বিরুদ্ধে তারা তাদের আপত্তি এবং সন্দেহ প্রকাশ করত। নবীজি নিজ দলিল-প্রমাণাদি পেশ করতেন এবং তাদের আপত্তি খÐন করে তাদেরকে বুঝাতেন। কাফেররা তাদের স্বপক্ষে দলিল-প্রমাণ দিলে এবং ইসলামের বিরুদ্ধে নিজেদের আপত্তি এবং সন্দেহ বর্ণনা করলে নবীজি এবং সাহাবগণ কখনও এ কথা বলেন নি, তোমাদের কথা শুনে আমাদের অনুভূতিতে আঘাত লাগছে। তাই সাবধান! নিজেদের বিশ্বাসের স্বপক্ষে কোন কথা বলবে না। আমাদের বিশ্বাস পরিপন্থী তোমাদের কোন আপত্তি বা সন্দেহ প্রকাশ করবে না। বরং কুরআন করিম বার বার কাফেরদেরকে উদ্দেশ্য করে বলে, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক, তাহলে নিজেদের বিশ্বাসের স্বপক্ষে কোনো দলিল প্রমাণ উপস্থাপন করো। যদি কাফেরদের বিশ্বাসের স্বপক্ষে দলিল প্রমাণ উপস্থাপনের ফলে অনুভূতিতে আঘাত লাগার বা মনোকষ্টের কারণই হত, তাহলে কুরআন শরিফ বার বার তাদেরকে এ বিষয়ে অনুমতি দিত না। অন্যথায় এর অর্থ যা দাঁড়াবে তা হল, হে কাফেররা! তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকলে নিজেদের আকীদার স্বপক্ষে কোন দলিল প্রমাণ উপস্থাপন কর যেন রসুলে পাক (দ.) এবং সাহাবীদের মনে আঘাত লাগে এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে। (নাউযুবিল্লাহ্)
পবিত্র কুরআনে বলা আছে ‘কুল হাতূ বুরহানাকুম ইনকুনতুম সাদেকীন’ (নমল: ৬৫)।
হে নবী, কাফেরদের বলে দিন, তোমরা তোমাদের বিশ্বাসকে সত্য বলে মনে করে থাকলে তার স্বপক্ষে দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন কর।
তেমনিভাবে বলা আছে, ‘উদউ ইলা সাবীলি রাব্বিকা বিলহিকমাতি ওয়াল মাওয়িযাতিল হাসানাহ্, ওয়া জাদিলহুম বিল্লাতী হিয়া আহ্সান’ (নহল-১২৬)। অর্থাৎ কাফেরদেরকে তুমি তোমার প্রভুর পথে প্রজ্ঞা এবং সর্বোত্তম উপদেশবাণীর মাধ্যমে আহবান কর এবং কাফেরদের সাথে অত্যন্ত উত্তম পন্থায় বিতর্ক কর।
নিজেদের বিশ্বাসের স্বপক্ষে দলিল প্রমাণ উপস্থাপনের এবং ইসলামি শিক্ষার বিরুদ্ধে বিভিন্ন আপত্তি উপস্থাপন করার অনুমতি যদি কাফেরদের না থাকে, তাহলে ‘জাদেলহুম’ কাফেরদের সাথে মুবাহাসা তথা তর্কযুদ্ধ কর”- এই নির্দেশ অর্থহীন হয়ে যায়। কেননা মুবাহেসার অর্থই হল, বিবাদমান উভয়পক্ষ নিজ নিজ দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করবে এবং একে অন্যের বিপক্ষে দলীল প্রমাণ এবং আপত্তি যুক্তি তুলে ধরবে।
(১১)
মহানবী (দ.) কখনও কোন ইহুদী খ্রিস্টান অগ্নিপূজারী মুশরেককে তাদের আকীদা অনুযায়ী ইবাদত করতে বারণ করেননি। উপরন্তু একবার নাজরান উপত্যকা থেকে খ্রিস্টান পাদ্রীদের একটি দল মদিনায় আসে এবং বেশ কয়েক দিন তারা মসজিদে নববী শরিফের অভ্যন্তরে বসে মহানবী (দ.) এবং সাহাবাগণের উপস্থিতিতে খ্রিস্টধর্মের পক্ষে আলোচনা করেন। মহানবী (দ.) ও তাদের সাথে ধর্মীয় বিষয়ে আলোচনা করেন। একদিন এমনই কথোপকথনের সময় তারা মসজিদ থেকে উঠে চলে যেতে লাগল। নবীজির জিজ্ঞাসায় তারা বলল, আমাদের উপাসনার সময় হয়েছে তাই আমরা বাইরে গিয়ে উপাসনা করতে চাই। নবীজি বললেন, এজন্যে মসজিদ থেকে বাইরে যাবার প্রয়োজন নেই। এখানেই বসে আপন নিয়মানুযায়ী প্রার্থনা করে নিন। অতঃপর সে খ্রিস্টান পাদ্রীরা, যারা হজরত ঈসা (আ.)- কে ঈশ্বরপুত্র বলে বিশ্বাস করে এবং নিজেদের আকীদা অনুযায়ী হজরত ঈসা (আ.)- কে ঈশ্বর জ্ঞানে পূজা করত, তারা মসজিদে নববীর অভ্যন্তরে নিজেদের বিশ্বাস অনুযায়ী উপাসনা করে। (ইবনে সা’দ ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৫৬; দারুল ফিক্র বইরুত)
(১২)
কাফেরদের বিষয়ে আল্লাহ্ তালা পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘লা ইয়ানহাকুমুল্লাহু আনিল্লাযীনা লাম ইউকাতিলূকুম ফিদ্দীনে ওয়া লাম ইউখরিজূকুম মিন দিয়ারিকুম আন তার্বারূহুম ওয়া তুকসিতূ ইলাইহিম ইন্নাল্লাহা ইউহিব্বুল মুকসিতীন। ইন্নামা ইয়ানহাকুমুল্লাহু আনিল্লাযীনা কাতালূকুম ফিদ্দীনে ওয়া আখরাজূকুম মিন দিয়ারিকুম ওয়া যাহারূ আলা ইখরাজিকুম আন তাওয়াল্লাওহুম ওয়া মান ইয়াতাওয়াল্লাহুম ফা-উলাইকা হুমুয্ যালিমূন (সূরা মুমতাহানা: ৯ ও ১০)।
যারা তোমাদের সাথে ধর্মীয় বিষয়ে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে দেশছাড়া করে নি, আল্লাহ্ তোমাদেরকে তাদের সাথে উত্তম আচরণ করতে এবং ন্যায়-নিষ্ঠার ব্যবহার করতে বারণ করেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ন্যায়পরায়ণদের ভালবাসেন। আল্লাহ্ তোমাদেরকে কেবল তাদেরকে বন্ধু বানাতে বারণ করেন, যারা ধর্মীয় বিষয়ে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেছে এবং তোমাদেরকে তোমাদের বাড়ি-ঘর থেকে বিতাড়িত করেছে এবং তোমাদেরকে বিতাড়িত করতে একে অন্যকে সাহায্য করেছে। আর যে তাদেরকে বন্ধু বানাবে, তারাই হলো যালেম।
(১৩)
কাফেরকে সালাম বলা:
আল্লাহ্ তা’লা পবিত্র কুরআনে বলেন, ওয়া কীলিহি ইয়া রাব্বে ইন্না হাউলায়ে কাওমুন লা ইউ’মিনূনা; ফাসফাহ্ আনহুম ওয়া কুল সালাম, ফাসাউফা ইয়া’লামূন।
‘হে আমার প্রভু! এরা এমন এক জাতি, যারা ঈমান আনে না, নবীর এমন কথায় আল্লাহ্ বলছেন, হে নবী-আপনি তাদের উপেক্ষা করুন এবং তাদেরকে সালাম বল। অচিরেই তারা জানতে পারবে’ (সূরা যুখরুফ: ৮৯, ৯০)।
অতএব কাফেরদের ক্ষেত্রেও আল্লাহ্ তা’লার নির্দেশ হল, তাদেরকে সালাম বল।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, সূফীতত্ত্ব গবেষণা ও মানবকল্যাণ কেন্দ্র।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply