বিপ্লব কান্তি নাথ
সনাতন ধর্মে “ গীতা ” এমন একটি গ্রন্থ যা পাঠ করলে মানসিক প্রশান্তি আসে এবং জীবনের জটিল সমস্যাগুলোর সমাধান পাওয়া যায় এবং আমাদের আত্ম-উন্নতি ও মনোবল বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। গীতার শিক্ষাগুলো দৈনন্দিন জীবনে অনুসরণ করলে মানুষের আচার-আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। এটি কেবল ধর্মীয় গ্রন্থ নয়, বরং একটি জীবন দর্শন যা সত্য, ন্যায়, ধর্ম এবং কর্মের সঠিক পথ দেখায়।
গীতা সম্পর্কে লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী তার লিখনিতে যে ভাবে তুলেধরছেন- “গীতার মতো ধর্মগ্রন্থ পৃথিবীতে বিরল। তার প্রধান কারণ গীতা, সর্ব যুগের সর্ব মানুষকে সব সময়েই কিছু না কিছু দিতে পারে। অধ্যাত্বলোকে চরম সম্পদ পেতে হলে গীতাই অত্যুত্তম পথ প্রদর্শক, আর ঠিক তেমনি ইহলোকের পরম সম্পদ পেতে হলে গীতা যে রকম প্রয়োজনীয় চরিত্র গড়ে দিতে পারে, অন্য কম গ্রন্থরই সে শক্তি আছে। ঘোর নাস্তিকও গীতা পাঠে উপকৃত হয়।” গীতা-রহস্য, গ্রন্থ- ময়ূরকণ্ঠী। সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলী, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৬০।
গীতা কি ?
গীতা হলো ভগবানের নিঃশ্বাস প্রশ্বাস, হৃদয় ও বাগ্মিয় মূর্তরূপ। এই সংসারে গীতার সমতুল্য কিছুই নেই। ভক্তিভরে গীতা অনুশীলন করলে একইসঙ্গে সমস্ত যজ্ঞ, তীর্থভ্রমন, জপ, তপ, দান, ব্রত, সংযম ও সেবার ফল পাওয়া যায়। এই কথাটির তাৎপর্য আমারা কিভাবে বুঝতে পারব? গীতাতত্ব মানব রূপ দেহ দেবালয়ের মধ্যে পরমেশ^র শিব’কে কে খুঁজে পাওয়ার সাহায্য করে। গীতা হলো উপনিষদ বা বেদান্তের সারগ্রন্থ। প্রায় সমস্ত উপনিষদেই বলা হয়েছে যে- “অংঙ্গুষ্টমাত্রঃ পুরুষোহন্তরাত্মা সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ”। অর্থাৎ অতি সূক্ষ্মতম অঙ্গুষ্ঠ পরিমিত পুরুষ অন্তরাত্মা রূপে সর্বজনের হৃদয়ে অবস্থিত আছেন। এই পুরুষই পরমাত্মা বা ‘শিব’। শিবই ত্রিকালের নিয়ন্তা। তিনি সমস্তকিছুর মধ্যেই সুপ্তভাবে বিরাজমান।
গীতা অধ্যয়ন ও মননের গভীরতায় গেলে মানুষের মন পাঁচটি মূল্যবান তত্ত্বে স্থির বিশ্বাসী হয়ে উঠে। এই পাঁচটি তত্ত্ব হলো (১) আত্মার অমরত্ব বা অখন্ডতা, (২) দেহের নশ্বরত্ব বা ক্ষুদ্রতা, (৩) অনন্ত ঈশ্বরের অবতার রূপ পরিগ্রহন, (৪) পরলোক তত্ব এবং (৫) মানুষের স্বধর্ম অনুসারে জীবন পরিচালনা করার আবশ্যকতা।
গীতা যে কি এবং এঁর ব্যাপ্তি যে কত অসীম তা গীতা বারবার অধ্যয়ন না করলে অনুধাবন করা সম্ভব নয়।
গীতায় কি কি রয়েছে ?
১। পরিপূর্ণ মানব জীবন কীভাবে গড়ে তোলা যায়, তার সন্ধান রয়েছে গীতায়।
২। বিভ্রান্ত মানুষকে সঠিক পথে চলার নির্দেশ দেয়।
৩। গীতাপাঠ মানুষকে সৎ কর্মের পথে দিক নির্দেশনা দেয়।
৪। জীবনের চলার পথে কোনও সঙ্কটে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার শিক্ষা পাওয়া যায় গীতা অধ্যয়নে।
৫। গীতা মানব দর্শনের কথা বলে।
“শিব গীতা” কি এবং কেন পাঠ করবেন :
সনাতন ধর্মের সকলেই হয়তো ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’ সম্পর্কে জানেন, কিন্তু ‘শিব গীতা’ সম্পর্কে ঠিক ততটা জানেন না। তাই শিবগীতা সম্বন্ধে একটি সাধারন জ্ঞান প্রকাশিত করছি। যে প্রকার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখ থেকে ভগবদ্গীতা রচয়িতা হয়েছে, অনুরূপ ভাবে ‘ভগবান শিবের’ মুখারবিন্দ থেকে বের হয়েছে এই “শিবগীতা”। মহাভারতের ভীষ্ম পর্ব থেকে ভগবদ্গীতা এসেছে এবং সেখানে মোট আঠারোটি অধ্যায় রয়েছে এবং ৭০০টি শ্লোক রয়েছে। তাকে কৃষ্ণার্জুন সংবাদ বলে উল্লিখিত করা হয়েছে। ঠিক তেমনই পদ্মপুরাণে উল্লিখিত শিবরাঘব সংবাদ ‘শিবগীতা’ নামে প্রসিদ্ধ। এখানে ষোলটি অধ্যায় রয়েছে। ষোলটি অধ্যায়ের মধ্যে ৭৮৩টি শ্লোক রয়েছে। শিব গীতা ষোলটি অধ্যায় হলো- প্রথমোহধ্যায় শিবভক্ত্যুৎকর্ষনিরূপণং, দ্বিতীয়োহধ্যায় বৈরাগ্যোপদেশো, তৃতীয়োহধ্যায়ঃ বিরজাদীক্ষানিরূপণং, চতুর্থোহধ্যায় শিবপ্রদুর্ভাবাখ্য, পঞ্চমোহধ্যায়ঃ রামায় বরপ্রদানং, ষষ্ঠোহধ্যায়ঃ বিভূতিয়োগো, সপ্তমোহধ্যায়ঃ বিশ্বরূপদর্শনং, অষ্টমোহধ্যায় পিণ্ডোৎপত্তিকথনং, নবমোহধ্যায় দেহস্বরূপনির্ণয়ো, দশমোহধ্যায় জীবস্বরূপকথনং, একাদশোহধ্যায়ঃ জীবগত্যাদিনিরূপণং, দ্বাদশোহধ্যায়ঃ উপাসনাজ্ঞানফলং, ত্রয়োদশোহধ্যায় মোক্ষয়োগো, চতুর্দশোহধ্যায় পঞ্চকোশোপপাদনং, পঞ্চদশোহধ্যায়ঃ ভক্তিয়োগো, ষোডশোহধ্যায় গীতাধিকারিনিরূপণং। যেভাবে অর্জুনের প্রশ্নের উত্তরে ভগবদ্গীতা সামনে এসেছে, সেভাবেই শ্রীরামচন্দ্রের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে প্রকাশিত হয়েছে এই শিবগীতা। শিবগীতা আধ্যাত্ম বিদ্যার এক অসামান্য গ্রন্থ যেখানে বেদান্তের সার বস্তু সমাহিত হয়েছে। বেদান্ত যাকে ব্রহ্ম বলেছেন তাকে এখানে শিব নামে অভিহিত করা হয়েছে। শিবই এই সৃষ্টির নির্মাতা, পালন কর্ত্তা এবং সংহার কর্ত্তা। সম্পূর্ণ সৃষ্টি পরমেশ্বর শিবের শক্তির রূপ বলা হয়েছে, বেদান্ত তাকে মায়া শক্তি নামে আখ্যায়িত করেছেন। এই মায়াশক্তিকে অতিক্রম করে পরব্রহ্ম বিষয়ে জ্ঞাত হওয়াই মুক্তির একমাত্র উপায়। এই জ্ঞান তথা মুক্তির জন্যই পরমেশ্বর শিব ব্রহ্ম, শিব থেকে সৃষ্টির রচনার বর্ণনা, শরীর রচনার বর্ণনা, শিব সাধনা, শিবপূজার বিধান, সংসারের অসারতা, তত্ত্বজ্ঞান, কর্মফল, বিরজা দীক্ষা, শিবের বিরাট স্বরূপ, শিবের বিভূতি, জীবের গতি, মুক্তির স্বরূপ, ভক্তির বিধি, ধ্যান যোগ ইত্যাদি অনেক আধ্যাত্মিক রহস্যের উদ্ঘাটন করেছে এই শিবগীতায়। এই দৃষ্টিতে শিবগীতার মহত্ব সর্বাধিক। জ্ঞান প্রাপ্তির জিজ্ঞাসুদের জন্য এই শিবগীতা গ্রন্থ অতি মহত্বপূর্ণ।
সনাতন হিন্দুধর্মের কয়টি গীতা ও নাম কি কি ?
অধিকাংশ হিন্দুদের ধারনা ভাগবত গীতা হল আমাদের শাস্ত্র আর একমাত্র গীতা যা একদম ভুল কথা। সনাতনধর্মে সর্বমোট ৪২ ধরনের গীতা রয়েছে। এই ৪২ গীতার নাম ও খুব সংক্ষিপ্ত বিবরন নিম্নে উল্লেখ করা হয়েছে-
গুরুগীতা :
মুনি ব্যাস দ্বারা রচিত এই গীতার শ্লোক সংখ্যা ৩৫২টি। এই গীতায় ভগবান শিবের কাছে দেবী পার্বতী গুরুতত্ত্ব সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন, যা স্কন্ধ পুরাণের অন্তর্গত।
শিব গীতা :
পদ্মপুরাণের পাতাল কান্ডের ১৬ টি অধ্যায় নিয়ে এই ‘শিব গীতা’ রচিত, এই গীতার শ্লোক সংখ্যা ৭৮৩টি। শ্রীরামচন্দ্রের স্ত্রী সীতা দেবিকে যখন লঙ্কাধিপতি রাবণ হরণ করেন, তখন ঋষি অগ্যস্ত রামচন্দ্রকে মহাদেবের আরাধনা করার উপদেশ প্রদান করেন। পরমেশ্বর শিব তখন শ্রীরামচন্দ্রের প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হয়ে শিব গীতার মাধ্যমে জ্ঞ্যান প্রদান করেন। শৈবদের মাঝে এই গীতার উপযোগীতা অপরিসীম। শ্রীরামচন্দ্রই সর্বপ্রথম বিষ্ণুর অবতার যিনি প্রভু পরমেশ্বরের বিশ্বরূপের দর্শন পান। শিব উনার বিশ্বরূপ প্রদর্শনের মাধ্যমে মানব ভ্রূণ মনুষ্যজন্মরহস্য, কর্ম, শরণাগতি ইত্যাদি বহু বিষয় সম্পর্কে উপদেশ দিয়ে শ্রীরামচন্দ্রকে সমৃদ্ধ করেন।
ঈশ্বর গীতা :
কুর্ম পুরানের উত্তর বিভাগের প্রথম ১১টি অধ্যায় নিয়ে এই গীতা। পরমেশ্বর ভগবান শিবের শিক্ষা ও উনাকে কিভাবে পাওয়া যায় তা নিয়ে আলচনা হয়েছে। বলা হয়ে থাকে ভাগবত গীতার শিক্ষা তো বটেই এছাড়াও এই গীতায় পাতঞ্জলির ৮টি যোগ সম্পর্কে বিস্তারিত বলা আছে। এই গীতায় ভগবান শিব নিজেকে বার বার পরমেশ্বর বলেছেন।
শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা :
শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা ইহাতে ১৮টি অধ্যায় রয়েছে, শ্লোক সংখ্যা ৭০০টি, এর একটি গ্রন্থ যা মহাভারতের ভীষ্ম পর্বের ২৫তম অধ্যায় থেকে ৪২ তম অধ্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডব যুবরাজ অর্জুনের রথের সারথি হয়ে অর্জুনকে নির্দেশনা প্রদান করছিলেন।
দেবী গীতা :
দেবীগীতা দেবী ভাগবতমের অন্তর্গত সপ্তম খন্ডের অধ্যায় ৩১ থকে ৪০ থেকে চয়ন করা হয়েছে, যাঁর রচয়িতা হলেন মহামুনি ব্যাস। এই গীতায় বিবৃত হয়েছে দেবীর আবির্ভাব ও তাঁর প্রকৃতি সম্পর্কে তাছাড়াও দেবীকে ধ্যান, যোগসাধনা ও পূজার মাধ্যমে কিরূপ আরাধনা করা হয় তা বিবৃত হয়েছে। এই গীতার আবার ২ অংশ যথা গনেশ আর গোপিকা গীতা।
ব্রহ্মগীতা :
ইহা স্কন্দ পুরাণের থেকে গৃহীত যা সুত সংহিতার ৪র্থ অধ্যায়, যজ্ঞ বৈভব খন্ডের প্রথম ১২টি অধ্যায় থেকে নেয়া। তার অপর একটি সংস্করণ পরবর্তীতে নির্বাণ খন্ডের ১৭৩ থেকে ১৮১ মধ্যেও পাওয়া যায় যা “যোগ বশিষ্ঠ” নামে পরিচিত।
ব্রাহ্মণ গীতা :
যা অনুগীতার একটি অংশ।
রুদ্র গীতা :
শ্রীমদ্ভাগবদ পুরাণের চতুর্থ স্কন্দের ২৪শ তম অধ্যায়ের ১৬-৭৯ শ্লোক এবং বরাহ পুরাণের ৭০-৭২ তম অধ্যায়কে রুদ্র গীতা বলে অবহিত করা হয়। পরমেশ্বর ভগবান শিব দ্বারা প্রচীতা(পবন দেব) যিনি তখনকার সময় দক্ষ ছিলেন তাঁকে বিভিন্ন ধরণের নির্দেশনা প্রদান করেন। এই গীতার মন্ত্রগুলোর মধ্যে শ্রীবিষ্ণুর বিভিন্ন প্রশংসা করা হয়েছে। এখানে পরমেশ্বর শ্রীবিষ্ণুর উপাসনা এবং শ্রীবিষ্ণুর দ্বার মোক্ষ প্রদান করার বিভিন্ন ধরনের উপাসনা পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন। তাছাড়া এই গীতাতে আত্মোপলব্ধি এবং হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন শিক্ষা ও দর্শন সম্পর্কে বলা আছে।
অনুগীতা :
অনুগীতার উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয় মহাভারতের অশ্বমেধ পর্বে ১৬তম অধ্যায়ে। মহাভারতের যুদ্ধের পর যুদ্ধিষ্ঠীরের রাজ্যাভিষেকের মুহূর্তে অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণের মধ্যকার কথোপকথন এই গীতায় সংকলিত হয়েছে। এখানেই কৃষ্ণ বলেছিলেন যে ভাগবত গীতার পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বর তিনি নিজে নন।
অষ্টবক্রগীতা :
রাজা জনক ও অষ্টবক্রের মধ্যে আত্মা, বন্ধন, জীবনের পরম সত্য নিয়ে কথোপকথন হয়। এই গীতায় বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে সন্ন্যাস জীবন ও সংসার ত্যাগ তথা বৈরাগ্যের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।
অবধ্যত্ত্ব গীতা :
এই গীতার মূল বিষয় হল অদ্বৈত বেদান্ত এবং এই গীতার প্রবক্তা হলেন মুনি দত্ত্বাত্রেয়। যাঁর জন্ম হয়েছিল এই পৃথিবীতে আত্ম অহমিকাহীন এবং হিংসার ঊর্ধ্বে।
ভীক্ষু গীতা :
ইহা শ্রীমদভাগবদ পুরাণের ৫ম অধ্যায় ১২শ স্কন্দের অন্তর্গত যেখানে রাজা পরিক্ষীত ও শুক মুনির মধ্যকার কথোপকথন মধ্য দিয়ে বেদান্ত দর্শন, ব্রাহ্মন ও আত্মার ওপর স্ংক্ষিপ্তভাবে আলোকপাত করা হয়েছে।
বোদ্ধগীতা :
ইহা মহাভারতের মোক্ষ পর্বের অন্তর্গত শান্তি পর্ব থেকে গৃহীত, যেখানে ঋষি বোদ্ধের সাথে রাজা যজাতির কথোপকথন হয়ে থাকে।
গণেশ গীতা :
ইহা গণেশ পুরাণের ১৩৮-১৪৮ অধ্যায়ের অন্তর্গত যা কৃৎখন্ড থেকে নেয়া। যা অনেকটাই ভাগবদ গীতার আদলে রচিত যেখানে শ্রীগণেশকে পরমাত্মার স্বরূপ হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে। রাজা বরেণ্যের সাথে গজাননরূপী শ্রীগণেশের কথোপকথন হয়ে থাকে।
গোপিকা গীতা :
এই গীতার মূল বিষয়বস্তু হল শ্রীকৃষ্ণের প্রতি গোপীদের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশিত হয়। ইহা ভাগবদ পুরাণের অন্তর্গত যা রাজা জনমেজয়কে শুকদেব মুনি বলছিলেন।
হংস গীতা/ উদ্ধব গীতা :
ইহা শ্রীমদ্ভাগবদ্পুরাণের ১১শ স্কন্দের ৪০ শ্লোক ৬ষ্ঠ খন্ড থেকে ২৯ খন্ডের মধ্যে প্রায় ১০০০ শ্লোকের সমন্বয়ে রচিত। যেখানে নশ্বর দেহ ত্যাগের পূর্বে শ্রীকৃষ্ণের সাথে উদ্ধবের কথোপকথন যোজন করা হয়েছে।
হনুমদ গীতা :
শ্রীরামচন্দ্রের রাজা হওয়ার পর সীতা দেবীর সহিত শ্রীহনুমানের কথোপকথন চয়িত হয়েছে হনুমদ গীতায়।
হরি গীতা :
ভাগবদ গীতাকে নারদ মুনি কর্তৃক এই নামকরণ করা হয়েছিল। শান্তিপর্ব, ৩৪৬তম অধ্যায়, ১০ম শ্লোক।
কপিলা গীতা :
ভাগবত পুরানের ৩ নম্বর স্কন্দের ২৩-৩৩ অধ্যায় নিয়ে এই গীতা গঠিত। সাধু কপিল তাঁর মা দেবাদুতির আধ্যাত্মিক ক্ষুদা নিবারনের জন্য এই গীতা আলচনা করেন।
মানকি গীতা :
মহাভারতের মোক্ষ পর্বের আর শান্তি পর্বের কিছু অংশ নিয়ে এই গীতা গঠিত।মানকি মুনি তাঁর ২ ষাঁড়কে নিয়ে ৫০টি প্যারার একটি গল্প এইখানে বলা হয়েছে। এর মূল বিষয় বস্তু হল লোভ, কামনাকে ত্যাগ আর সকল নিষ্পাপ প্রানীর জন্য ভালবাসা জাগানো।
পান্ডব বা প্রপন্ন গীতা :
এই গীতার মূল বিষয় হল আত্মসমর্পন এর গান। মূলত পুরানিক বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যাক্তিত্ত্যের উক্তি নিয়ে এই গীতা উপদেশ দেয়। এই ব্যাক্তিদের মাঝে পঞ্চ পান্ডবও আছে।
পরাশর গীতা :
এই গীতাও মহাভারতের মোক্ষ পর্বের আর শান্তি পর্বের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত। শান্তি পর্বের সবথেকে বড় গীতা বলা হয় এই গীতাকে। শান্তি পর্বের মোট ৯টি অধ্যায় নিয়ে এই গীতা আলোচনা করে থাকে। পরাশর মুনি ও তাঁর পিতা ব্যাস মুনির সাথে রাজা জনকের কথাবার্তা নিয়ে এই গীতার ভাস্য।
পিঙ্গলা গীতা :
এই গীতাটিও মহাভারতের অন্তর্গত। শান্তি পর্বের অন্তর্গত মোক্ষ পর্ব থেকে সংকলিত। এখানে শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধবকে পিঙ্গলা নামক এক পতিতার মোক্ষ লাভ সম্পর্কে জ্ঞ্যান প্রদান করেন।
রাম গীতা :
ব্রহ্মাণ্ড পুরাণের অন্তর্গত আধাত্ম রামায়ণ যা উত্তর কাণ্ডের পঞ্চম স্বর্গ থেকে সংকলিত। এছাড়াও এই গীতার আরেকটি সংকলন দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুতে পাওয়া যায়। এই সংকলন তত্ত্বস্মরণের গুরুজ্ঞ্যান বশিষ্ঠের অন্তর্গত। এই গীতায় তিনটি কাণ্ড দ্বারা পরিবেষ্টিত যথা জ্ঞ্যানকাণ্ড, উপাসনাকাণ্ড ও কর্মকাণ্ড। উপাসনা কাণ্ডের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের আঠারটি অধ্যায় নিয়ে রামগীতা গঠিত।
রমন্ গীতা :
এই গীতা মহর্ষি রমন্রে দ্বারা রচিত। এই গীতা উনার সবচেয়ে কাছের শীষ্যদের মধ্যে অন্যতম শ্রীগণপতি মুনি যিনি আরো শীষ্যদের সাহায্যে মোট ৩৭ খানা প্রশ্ন মহর্ষি রমন্রে সম্মুখে উত্থাপবন করেন। এই গীতা ভগবদগীতার শ্লোক সহ মোট ১৮টি অধ্যায় এবং ৩০০ মন্ত্র দ্বারা পরিবেষ্টিত।
রিভু গীতা :
ইহা শিব রহস্য পুরাণের ষষ্ঠ খণ্ড থেকে নেয়া হয়েছে । মুনি রিভু এবং মুনি নিদঘ এর কথোপকথনের মধ্য দিয়ে আমিত্ব এবং ব্রহ্ম সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। যা দুই সহস্র পঙক্তি দিয়ে রচিত।
সম্পর্ক গীতা :
মহাভারতের শান্তি পর্বের অন্তর্গত মোক্ষ পর্ব থেকে এই গীতার উৎপত্তি। এই গীতা ২১টি মন্ত্র দ্বারা তৈরী যা সম্পক একজন সৎ বাহ্মণের দ্বারা উপেদেশাবলি হিসেবে পেয়েছিলেন। এসকল উপদেশের মূল উদ্দেশ্য হল একজন মানুষ কিভাবে তার আমিত্ব ত্যাগ করে সমর্পণের মাধ্যমে সচ্চিদাননন্দে লীন হতে পারেন।
শ্রুতি গীতা :
শ্রীমদভাগবদপুরাণের ১০ম স্কন্দের ৮৭ নং অধ্যায়কে শ্রুতিগীতা নামে অবহিত করা হয়। রাজা পরিক্ষীত শুকদেবের কাছে ব্রাহ্মণের অনাচার এবং ঈশ্বরাচার এই দুইয়ের সম্পর্কে উপদেশাবলি সংকলতিত হয়েছে।
সূর্য গীতা :
গুরজ্ঞ্যান বশিষ্ঠ যা তত্ত্ব স্মরণের অন্তর্গত সেখানে সূর্যগীতার উল্ল্যেখ পাওয়া যায়। ইহা তিনটি খন্ডে বিভক্ত যথা জ্ঞ্যান কান্ড, উপাসনাকান্ড ও কর্মকান্ড। অদ্বৈত বশিষ্ঠের তৃতীয় পঙক্তির প্রথম পাঁচ অধ্যায় সূর্য গীতা দিয়ে শুরু।
সূত গীতা :
ইহা মূলত স্কন্দ পুরানের ১৩শ অধ্যায়ের ২০তম যজ্ঞবৈভব খণ্ডের অন্তর্গত। ইহা প্রবলভাবে অদ্বৈতবাদের পক্ষে এবং মনোথিজম অর্থাৎ দ্বৈত সত্তার মাধ্যমে অদ্বৈতবাদের খোঁজ এর পক্ষে সমর্থন প্রদান করে। মূলত নিরাকার অদ্বৈত ব্রহ্মকে জানাই এই গীতার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।অদ্বৈতবাদের ব্যাপারে এই গীতা মূলত ভগবদগীতা থেকে অনেকাংশে সুনির্দিষ্ট এবং সুস্পষ্ট নিয়ম মেনে চলে। মহর্ষি সুত অদ্বৈতবাদের ধারণা এবং ঈশ্বরের দর্শন মার্গের ধারণা পান পরমেশ্বর ভগবান শিবের কাছ থেকে।
স্বামী নারায়ণ গীতা বা যোগী গীতা :
মূলত এটি বৈষ্ণবদের একটি গীতা। শ্রী যোগীমহারাজ ভগবান শ্রীস্বামী নারায়ণ এর দর্শন লাভ করেন এবং উনার কাছ থেকে পাওয়া জ্ঞ্যান, যেমন : কিভাবে মানব জীবনে আধাত্মিক সফলতা পাওয়া যায়, এর জন্য একজন ভক্তকে কি কি পদক্ষেপ নিতে হয়, কি কি গুণ এবং কি কি প্রার্থনার পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয় তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। মূলত দাক্ষিণাত্যে বৈষ্ণবদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় গীতা হল এই স্বামী নারায়ণ গীতা।
উত্তর গীতা :
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর অর্জুন যখন বয়সের ভারে নিমজ্জিত এবং রাজ্যসুখ জগতের মায়া দ্বারা প্রবলভাবে বেষ্টিত তখন অর্জুন এসব থেকে মুক্তি পেতে শ্রীকৃষ্ণের কাছে যান। শ্রীকৃষ্ণকে তিনি ব্রাহ্মণের জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন এবং এর থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ শ্রীকৃষ্ণের কাছে উত্থাপন করেন। শ্রীকৃষ্ণের উনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন এবং অর্জুনের সকল প্রশ্নের উত্তর প্রদান করেন। উত্তর গীতা তিনটি অধ্যায় দ্বারা পরিপূর্ণ। এটি মহাভারতের উত্তরকাণ্ডে সংকলিত রয়েছে।
বল্লভ গীতা :
বল্লভ গীতাকে সদাসা গ্রন্থ হিসেবেও জানা যায়। শ্রীবল্লভ উনার শিষ্যদের জীবনের উদ্দেশ্য ও মুক্তি সম্পর্কে শিক্ষা দিয়ে গেছেন।এটি শ্রীবল্লভের ১৬টি কর্ম এবং প্রতিটি কর্মের মূল বিষয়ের উপরে বিস্তর আলোচনা করা হয়েছে।
বশিষ্ঠ গীতা বা যোগী বশিষ্ঠ গীতা :
রাজপুত্র রামচন্দ্রকে বিষন্ন অবস্থায় দেখে ঋষি বশিষ্ঠদেব বিশদভাবে অদ্বৈত বেদান্ত এবং অদ্বৈতবাদ সম্পর্কে আলোকপাত করেন যা ৩২,০০০ সংখ্যক শ্লোকের সমন্বয়ে সংকলিত হয়েছে।
বিভীষণ গীতা :
এই গীতা রামায়ণ থেকে সংকলিত। রাজা শ্রীরামচন্দ্র বিভীষণকে ভক্তি, বিশ্বাস সৎকার্যের লক্ষণ সম্পর্কে জ্ঞ্যান দান করেন।
বিচক্ষু গীতা :
এই গীতা মহাভারতের মোক্ষ পর্বের অন্তর্গত শান্তি পর্ব থেকে নেয়া হয়েছে। রাজা বিচক্ষু একটি যজ্ঞে উপস্থিত হন যেখানে প্রাণী আহুতি দেয়া হয়। তিনি সেখানে অহিংসার প্রতি আলোচনা করেন যা এগারোটি শ্লোক এর মাধ্যমে সংকলিত। পিতামহ ভীষ্ম রাজা যুধিষ্ঠিরকে এই জ্ঞ্যান প্রদান করেন।
বিদুর গীতা :
এই গীতাটিও মহাভারতের অন্তর্গত। বিদুর এবং সম্রাট ধৃতরাষ্ট্রের মধ্যকার কথোপকথন এই গীতায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এখানে বিদুর সম্রাট ধৃতরাষ্ট্রকে রাজনীতির জ্ঞ্যান এবং সঠিক সিদ্ধান্তের মূল্য ,ন্যায় এবং সত্যবাদীতা সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান করেন।
বৃত্র গীতা :
ইহাও মহাভারত থেকে গৃহীত। মোক্ষ পর্বের শান্তি পর্ব থেকে ইহা চয়িত। এই গীতায় মূল কথোপকথন হয় ভয়ঙ্কর দানব বৃত্রাসুর এবং দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের মধ্যে হয়ে থাকে যা দুই অধ্যায়ে ব্যাপ্ত।
ব্যাধ গীতা :
মহাভারতের বন পর্বের অন্তর্গত। এই গীতায় এক মাংস বিক্রেতা এক সাধুকে জ্ঞ্যান প্রাদান করেন যিনি সম্রাট যুধিষ্টিরের সঙ্গে পরিচিত হন মার্কণ্ডেয় মুনির দ্বারা।সেই সাধারণ মাংস বিক্রেতা অহঙ্কারী সাধুকে নিষ্কাম কর্ম সম্পর্কে জ্ঞ্যান প্রদান করেন।
ব্যাস গীতা :
এটি কূর্ম পুরাণের দ্বাদশ অধ্যায় থেকে শুরু করে উত্তর বিভাগ পর্যন্ত ব্যাস গীতার অন্তর্গত। এখানে ব্যাস মুনি আত্ম জ্ঞ্যান অর্জনের সর্বোচ্চ মার্গ সম্পর্কে জ্ঞ্যান প্রদান করেছেন। এখানে একতার বিশ্বাস এবং অদ্বৈতবাদ দর্শনের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
যম গীতা :
ভজসর্বার ছেলে শ্রী নচিকেতার সাথে ধর্মরাজ যমের ধর্মবিষয়ে কথোপকথনকে যম গীতা হিসেবে জানা যায়। পিতৃ আদেশ পালনে যমের দ্বারে উপস্থিত হয় ও নিজ ধর্ম জ্ঞ্যান এবং প্রজ্ঞা দ্বারা যমকে তুষ্ট করেন এবং ধর্মরাজকে ধর্মজ্ঞ্যান দিতে বাধ্য করেন। যম গীতার সারাংশ তিনটি জায়গায় পাওয়া যায়। ১) বিষ্ণু পুরাণের ৩য় খন্ড ৭ম অধ্যায় পর্যন্ত ২) অগ্নি পুরাণের ৩য় খণ্ড অধ্যায় ৩৮১ এবং ৩) নৃসিংহ পুরাণের ৮ম অধ্যায়সমূহে।
সনাতন ধর্মের মোট ৪২টি গীতা ও সংক্ষিপ্ত বর্ণনা উপরিভাগে লিপিবদ্ধ করা হল।
শুচিরেব সদাজ্ঞানী গুরুগীতা জপেন তু।
তস্য দর্শন মাত্রেন পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে।। ১১৬
বঙ্গানুবাদ : সকল সময় গুরুগীতা জপ অথবা পাঠ ও শ্রবণ করিয়া যিনি পবিত্র ও জ্ঞান লাভ করিয়াছেন, অর্থাৎ পরব্রহ্মের স্বরূপ সমস্ত উপলব্ধি করিয়াছেন। তাঁহাকে দর্শন করিবামাত্রই পূনর্জন্ম রহিত হয়, অর্থাৎ পূনর্জন্ম গ্রহণ করিতে হয় না।। ১১৬ (গুরুগীতা)
গুরুর্দেবো গুরুধর্মো গুরুনিষ্ঠা পরং তপঃ।
গুরোঃ পরতরং নাস্তি নাস্তি তত্ত্বং গুরো পরম্।। ১১৮
বঙ্গানুবাদ : হে পার্বতি। গুরুদেবই সাক্ষাৎ দেবতা, গুরুদেবই সর্বপ্রকার ধর্ম, গুরুই একমাত্র নিষ্ঠা, গুরুদেবই পরম তপস্যা। অর্থাৎ গুরুতে ভক্তি-শ্রদ্ধা পোষণ এবং গুরুভজনই শ্রেষ্ঠ ভজন। ইহা হইতে শ্রেষ্ঠ ভজন আর নাই। গুরুতত্ব হইতে জানিবার মতো শ্রেষ্ঠ তত্বও আর কিছুই নাই। অতএব গুরুতত্ব অর্থাৎ গুরুর প্রকৃতরূপ অবগত হওয়াই এই বিশ্বচরাচরে শ্রেষ্ঠ তপস্যা বলিয়া জানিবে।। ১১৮ (গুরুগীতা)
ধন্যা মাতা পিতা ধন্যো ধন্যং সর্বকুলং তথা।
ধন্যা চ বসুধা দেবি গুরুভক্তিঃ সুদুর্লভা। ১১৯
বঙ্গানুবাদ : হে প্রিয়ে ! যে ব্যক্তির হৃদয় মাঝে অতি সুদুর্লভ গুরুভক্তি জন্মিয়াছে, সেই ব্যক্তির মাতা ধন্যা, পিতা ধন্য এবং যে কুলে সে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, সেই কুলও ধন্য। দুর্লভ গুরুভক্তি পরায়ণ ব্যক্তির জন্মলাভ হেতু পৃথিবীও ধন্য হইয়াছেন ও পবিত্রতা লাভ করিয়াছেন।। ১১৯ (গুরুগীতা)
প্রতিদিন গীতা পাঠ করলে কোনো ফল হবে না, গীতায় বলা কথাগুলো যখন আত্মস্থ হবে আর সেই অনুরূপ কাজ করতে সক্ষম হব তখনই ফল পাওয়া যাবে।
যিনি গীতা পুস্তক সঙ্গে করিয়া প্রাণ ত্যাগ করেন, তিনি বৈকুষ্ঠে গিয়ে বিষ্ণুর সহিত আনন্দ ভোগ করেন।
পুরাণ অনুসারে, যে বাড়িতে নিয়মিত গীতা পাঠ করা হয় সেখানে সমৃদ্ধি থাকে। ধর্ম, কর্ম, নীতি, সাফল্য ও সুখের রহস্য লুকিয়ে আছে গীতায়। প্রতিদিন গীতা পাঠ করলে জীবনের প্রতিটি সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়।
লেখক : সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক, রুদ্রজ ব্রাহ্মণ পুরোহিত সংঘ, বাংলাদেশ।