২৬ এপ্রিল ২০২৪ / ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / সন্ধ্যা ৬:০১/ শুক্রবার
এপ্রিল ২৬, ২০২৪ ৬:০১ অপরাহ্ণ

সাক্কুর জয় তন্দ্রাচ্ছন্ন বিএনপি’র দেহে ঝাঁকুনি

     

 

     এস এম মনসুর নাদিম        

কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেল সরকার বিরোধীদের বাগাড়ম্বরের মাঝে। ২০১১ সালের জুলাই মাসে দুটি পৌরসভা নিয়ে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন গঠিত হওয়ার পর এটা ছিল দ্বিতীয় নির্বাচন।নতুন সিইসি’র অভিষেকের পর থেকেই মূলত  বিএনপি সিইসি’র ওপর নানাভাবে অনাস্থা প্রকাশ করলেও মাত্র কিছুদিন আগে বিএনপি’র মুখপাত্র রিজভি সাহেব বলেছিলেন-সিইসি’র ওপর আস্থা রাখা যায়। রিজভি’র মুখে এই অপ্রত্যাশিত মন্তব্যে কেউ বিস্মিত না হলেও এটা ছিল একটি স্বস্থির সুসংবাদ। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মাধ্যমে সিইসি যেন বিএনপি ও সমমনা দলগুলিকেই আশ্বস্ত করলেন এবং সিইসি’র ওপর আস্থা রাখতে পারার ম্যাসেজ পাঠালেন। নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনে প্রথম প্রতিদ্বন্ধিতাপুর্ন ভোটটির দিকে যে গোটা দেশবাসীর দৃষ্টি ছিল তা সিইসি কে এম নুরুল হুদার উপলব্ধিতেও এসেছিল। ভোট গ্রহন শেষ হওয়ার পরপরই সহকর্মীদের নিয়ে ঢাকার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন-এই ভোটের মধ্যদিয়ে শতভাগ জনআস্থা অর্জন করেছে বলে তারা মনে করছেন। মোটামুটি গোলযোগ ছাড়াই সকাল আটটা থেকে চারটা পর্যন্ত ভোট গ্রহন চলে এই সিটি কর্পোরেশনে। দুটি কেন্দ্র ব্যতীত সব জায়গায় শান্তিপুর্ন ভোট হয়েছে। এই নির্বাচনে ধানের শীষের প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু ৬৮ হাজার ৯৪৮ টি ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। আর ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন ৫৭ হাজার ৮৬৩ ভোট। বিএনপি ভোট সুষ্ঠু হয়নি বলে দাবি করলেও এখন সাক্কুর জয়ে কৌশলী কথা-বার্তা বলছে । এইদেশের রাজনীতির পুরনো কালচার থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো। ক্রিয়া সংঘটিত হওয়ার আগেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা’র মত মান্দাতার রাজনৈতিক কালচার থেকে তারা কবে বেরিয়ে আসবে তা একমাত্র আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনই জানেন। এ’যেন মোল্লা নাসিরুদ্দিনের সেই গল্পের মত। মোল্লা একদা একটি ছেলেকে মাটির কলসি দিয়ে নদী থেকে এক কলসি জল এনে দিতে বলে ছেলেটির গালে কষে এক চড় দিয়ে বলল-দেখিস কলসিটা আবার ভেঙ্গে ফেলিসনা যেন। তা দেখে উপস্থিত জনৈক ব্যক্তি বললেন-একি করলেন মোল্লা। কলসি না ভাঙতেই চড় লাগিয়ে দিলেন ? মোল্লা মুচকি হেসে বললেন-কলসি ভাঙ্গার পরে মারলে কী কলসি ফেরত পেতাম ? ঠিক আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদেরও হয়েছে একই রোগ। আগে তো চড় মেরে দিয়েছে এখন কী তা ফিরে নিতে পারবে ? তাই বিএনপি’র নেতারা এখন ‘মাংস হারাম সুরুয়া হালাল’র পদ্ধতি নিয়েছে। সবচেয়ে মজার মন্তব্য করেছেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি বলেছেন ‘এই নির্বাচনের ফলাফল ফেয়ার হলেও ভোট ছিল আনফেয়ার’।এ যেন অবৈধ সম্পর্কের বৈধ সন্তান। বড় হাস্যকর নয়কি ? কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু হলে নাকি বিএনপি’র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু বিপুল ভোটে জয়ী হতেন। গয়েশ্বর আরও বললেন, ভোটে তাদের প্রার্থীর জয় হলেও নির্বাচনকে তারা অবাধ ও সুষ্ঠু বলতে পারছেননা। নির্বাচনে জয় হলেই ভোট সুষ্ঠু বা অবাধ বলার ‘থিউরি’ থেকেও বেরিয়ে আসা উচিৎ বলে তিনি মন্তব্য করেন। এখন সাধারনের প্রশ্ন হলো, অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট না হওয়া মানে হল, ভোটটা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। প্রশ্নবিদ্ধ ভোটে জয়লাভ করা মেয়রও কী তাহলে প্রশ্নবিদ্ধ নয় ? যৌক্তিক বিরোধিতা না করে শুধুমাত্র বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা কোন সুস্থ রাজনীতির পরিচয় বহন করেনা। জামায়াতের সাথে জোট, পেট্রোল বোমা’র সহিংস আন্দোলন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সময় বেলা সাড়ে এগারোটায় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহন না করা সহ রাজনৈতিক নানা অপ্রত্যাশিত কারনে বিএনপি এক ধরনের কাগুজে বাঘে পরিণত হয়েছিল।ঠিক মত সম্মেলন করতে না পারা, মিছিল-মিটিং সমাবেশ করতে না পারাতে কর্মীদের মাঝে একটা হতাশার তন্দ্রাচ্ছন্নতা ভর করেছিল। পদ ও পদবী নিয়ে নেতাদের মাঝেও আছে অসন্তোষ। অতি সম্প্রতি দলের চেয়ারপার্সন বিএনপি’র কয়েকজন সংস্কারবাদী বলে পরিচিত নেতাদের সাথে আলোচনা করেছেন দলকে সক্রিয় করতে। সরকারের বিরুদ্ধেও তাদের এন্তার অভিযোগ রয়েছে। যেমন তাদের নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানী করা, তাদেরকে জনসমাবেশ ও মিছিল করতে না দেয়া ইত্যাদি। বিএনপি’র অভিযোগ সর্বাংশে সত্য না হলেও একেবারে মিথ্যা নয়। বিএনপি’কে চাপে রাখা সরকারের কৌশলী রাজনীতির একটি সুক্ষ্ম চাল। কিন্তু সেই চাপের মুখে অসহায়ত্ব প্রকাশ বিএনপি’র রাজনৈতিক অসারতা । এক সাক্কুর জয়ে বিএনপির উল্লাস করার কিছু নেই, এখানে বিএনপি’র  জনপ্রিয়তা ও আওয়ামীলীগের প্রতি স্থানীয় জনসাধারণের বিতৃষ্ণা প্রকাশ এমনটি ভাবার কোন অবকাশ নেই। কারণ স্থানীয় নির্বাচনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ব্যক্তির ইমেজ, আত্মীয়তা ও আঞ্চলিকতার টান।হ্যাঁ একথা সত্য’যে নব নির্বাচিত নির্বাচন কমিশন ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কারণ তারা শুরুতেই একটি গোলযোগ মুক্ত শান্তি পুর্ন নির্বাচন করতে পেরেছে। সরকারের নিরপেক্ষ ভুমিকার জন্যও সরকার প্রশংসার দাবিদার।

এদিকে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামীলীগের প্রার্থীর পরাজয়ের পেছনে স্থানীয় নেতৃত্বের আভ্যন্তরীণ দ্বন্ধ ভুমিকা রেখেছে বলে মনে করেন দলের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। যখন যারাই ক্ষমতায় থাকুক, ক্ষমতাসীনেরা নিজেদের ভুল দেখেনা। মাহবুবুল আলম হানিফের কথায় সত্যতা আছে কিন্তু তাই বলে শুধু মাত্র এই অভিযোগে নৌকার পরাজয় হয়েছে বলে মনকে শান্তনা দিলে ভ্রান্তির মধ্যে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আওয়ামীলীগ ও সরকারকে জনগণের পালস বোঝা এই মুহুর্তে খুবই জরুরী বলে আমরা মনে করি। জ্বালানী ও গ্যাস বিদ্যুৎ এর দফে দফে মুল্যবৃদ্ধি, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের উর্ধগতি, শেয়ার মার্কেটের বেহাল দশা, নানা ধরনের ট্যাক্স এই কর সেই কর, ভ্যাট ও অনিরাপদ অর্থনীতি ইত্যাদির কথা বিবেচনায় রাখা দরকার। কারণ জনগন রাজনীতি করেনা। তারা সরকারের কাছে জান-মালের নিরাপত্তা চায়। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সমুহ ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে চায়। ভ্যাট-করের উপদ্রব থেকে রেহাই পেতে চায়। নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস, বিদ্যুৎ সুলভে চায়। তারা শুধু একটি কথাই বোঝে ‘দাম শাসন দেশ শাসন’। তাই শুধু দলীয় কোন্দল এর জের বলে এই ধরনের পরাজয়কে দেখা রাজনৈতিক অদুরদর্শিতা বলে গণ্য হবে। আওয়ামীলীগের কিছু কিছু অঙ্গসংগঠনের বিতর্কিত কর্মকান্ড চাঁদাবাজি, টেণ্ডারবাজি, সন্ত্রাস মূল দলের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন করেছে সাধারণের নজরে।আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সবসময় এই সংগঠন গুলির কঠোর সমালোচনা করলেও অজ্ঞাত কারনে এদের উৎপত্তি, উৎপাত এর লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হচ্ছেনা। কাউয়া লীগ, কোকিল লীগ বলে হেয় করা হলেও এই মতলব বাজদের কোন লজ্জা-শরম নেই। এদেরকে এখনই থামাতে না পারলে অদুর ভবিষ্যতে আওয়ামীলীগকে এর কঠোর খেসারৎ দিতে হবে। মনিরুল হক সাক্কু’র জয়ে খানিকটা হলেও চাঙ্গা ভাব এসেছে নেতিয়ে পড়া বিএনপি’র নেতা-কর্মীদের মাঝে। বলা যায়, বিএনপি’র মরা গাঙে  কিছুটা হলেও জোয়ারের সঞ্চার করেছে মনিরুল হক সাক্কুর জয়। আমাদের দুর্ভাগ্য রাজনীতি জনকল্যাণ মূলক বলে প্রচার করা হলেও সব দলই কিন্তু ক্ষমতা কেন্দ্রিক রাজনীতি করে। যেন-তেন ভাবে ক্ষমতায় যেতে পারলেই হল। ক্ষমতাসীনেরা মনে করে ‘গণতন্ত্র’ বেকারীতে সাজানো কোন নাস্তা। পয়সা দিয়ে কিনে এনে টেবিলে সাজিয়ে দেয়া যায়। আর বিরোধী দলে থাকলে মনে হয় ‘গণতন্ত্র’ সুদৃশ্য খাঁচার ভেতর বন্ধি এক ফুট ফুটে পাখি। এটাই বাংলাদেশের প্রকৃত রাজনৈতিক চিত্র।লেখকঃ সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

 

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply