২৯ মার্চ ২০২৪ / ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ / দুপুর ১:১২/ শুক্রবার
মার্চ ২৯, ২০২৪ ১:১২ অপরাহ্ণ

।।ফেসবুক পারে সমাজ পরিবর্তন করতে।।  -এস এম মনসুর নাদিম

     

 

 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের কদর বেড়েছে বাংলাদেশে। প্রথম প্রথম ফেসবুকটা শুধু টিন এজ দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাও অনেকটা ‘চুপি চুপি বল কেউ জেনে যাবে’র মতো। এখন টিন এজ দের একক দখল থেকে বেরিয়ে আবাল,বৃদ্ধ বনিতার হাতে দেখা যায় এন্ড্রয়েড সেট। রিকশা ওয়ালা, বাদাম বিক্রেতা থেকে শুরু করে এম পি মন্ত্রীরা পর্যন্ত ,এদিকে নানী-দাদী, নানা-দাদা থেকে শুরু করে কাজের বুয়া পর্যন্ত ফেসবুক ব্যবহার করতে দেখা যায়। এতে যেমন যোগাযোগের এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে তেমনি বেড়েছে নানা বিড়ম্বনা। সেন্সরবিহীন এই ফেসবুককে অনেকে ব্যবহার করছেন নিছক পার্সোনাল ডায়েরীর মতো। ভুল বানান আর ভুল শব্দের প্রয়োগ এর পাশাপাশি অশালীন আচরণ, এমনকি গালাগাল তক দিতে কেউ কাউকে ছাড়ছেন না।

এতকিছু দেখার পর এটাই অনুধাবন করা যায়, আমাদের সমাজে এখনো অধিকাংশ মানুষই ফেসবুকের গুরুত্ত্ব বোঝেন না। কিংবা ফেসবুকের যথাযথ ব্যবহার জানেননা। আমার এই কথাটার সাথে আপনি তখনই একমত হবেন, যখন দেখবেন কোন নতুন আইডি খোলা ফেসবুকারের স্ট্যাটাস দেখবেন। অনেকে ধর্মীয় উস্কানি মূলক স্ট্যাটাস দেন। যিনি স্ট্যাটাস দেন তিনি হয়তো বুঝতে পারেননা এই উস্কানিমূলক স্ট্যাটাসের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে। কিংবা এই প্রতিক্রিয়ার পরিণাম কতো ভয়াবহ হতে পারে । কেউ রাজনীতির বিপক্ষ মতবাদীদের ঘায়েল করতে মিথ্যা ও উস্কানিমূলক কিংবা শালীনতা বিবর্জিত পোস্ট অথবা নেতা-নেতৃর কুরুচিপুর্ন এডিট করা ছবি প্রকাশ করে থাকেন। ফলে ঐ ছবি কিংবা পোষ্টকে কেন্দ্র করে হয় আরও কিছু কুরুচি মন্তব্য। এতে একপক্ষের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হয়। অন্য পক্ষের আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ হয়। যার কোনটাই কাম্য  না।

এই ফেসবুক অনেককে আবার লেখক হতে অনুপ্রাণিত করেছে। অনেকে লিখতে চেষ্টা করছেন। এটা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। ভাল-খারাপ, শুদ্ধ-অশুদ্ধ যাই লিখুকনা কেন এদের লেখা বন্ধুরা পড়ছেন। এদেরকে অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে বন্ধুদের লাইক / কমেন্টস। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, একজন প্রবীণ ভালো লেখকের লেখাতে যে পরিমান লাইক / কমেন্টস পড়ে থাকে তার তিনগুন বেশি লাইক, কমেন্টস ঐ ভুলে ভরা আনকোরা লেখকের লেখায় পড়ে থাকে। কারন, ঐ আনকোরা লেখকের বন্ধু তালিকায় যারা  আছেন তারা তেমন বোদ্ধা পাঠক না। তারা বন্ধুর লেখা শুধু সেই বিচারে নির্বিঘ্নে কাল বৈশাখীর ঝড়ের মত লাইক মারতে থাকে। এই লাইকারদের নিকট লেখার মানের চেয়ে বন্ধুর মান বড়। পক্ষান্তরে গুনী লেখকদের চুজি পাঠকদের লাইক/ কমেন্টস এর ব্যাপারে হাত একটু অবশ। অহমিকার ভারে নুইয়ে পড়া ঘাড় সোজা করতে করতে বেলা শেষ। তাই এখানে অনেক লেখক (যারা মূলত প্রতিক্রিয়াশীল) কোয়ালিটি’র চেয়ে কাউন্টিটিকে গুরুত্ত্ব দিয়ে গর্বে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে এই ভেবে যে, আমার লেখায় কতো লাইক/কমেন্টস রে…………। আহারে, বিখ্যাত হইয়া গেলামরে……

ওদের বন্ধু তালিকাও দীর্ঘ। সেখানে বাধ বিচারহীনভাবে বন্ধু এড করা হয়ে থাকে। যারা দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো’ কথাটার মর্মার্থ উপলব্ধি করতে অক্ষম।

কিছু লেখা থাকে বিতর্কিত। সেখানেও তর্ক-বিতর্ক চলতে থাকে। ফলে মন্তব্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। আসলে অনেকে ইচ্ছে করেই এই সমস্ত বিতর্কিত পোস্ট দেয়, শুধুমাত্র ঝগড়া লাগার জন্য। যাতে কমেন্টস এর সংখ্যা বেড়ে যায়। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, অল্পশিক্ষিত কিংবা যে বিষয়ে যার জ্ঞান নেই সেই যখন মাস্টারি করে তখন পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যায়। অনেকে সরকারের বিরুদ্ধে লিখতে গিয়ে রীতিমত দেশের বিরুদ্ধে লিখে ফেলেন। তিনি নিজেই বুঝতে পারেননা’ যে, যে কোন মুহুর্তে তিনি দেশদ্রোহিতার মামলায় জড়াতে পারেন। সে জন্যই বোধহয় বলা হয়-‘অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্কর’।ফেসবুক প্রোফাইল দেখে একজন লোকের রুচি বোধ ও মানসিকতা এমনকি রাজনৈতিক পরিচয়ও জানা যায়। যেই হারে অল্প শিক্ষিত নিন্মশ্রেনীর লোকেরা ফেসবুকিং এ ঝুঁকে পড়েছে, তা বিপজ্জনক। তার চেয়ে বরং শিক্ষিতরা এগিয়ে এলে অবস্থা উন্নতির দিকে যেতে পারে বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারনা। আমার এক  অভিনেতা ও নির্মাতা বন্ধু বলেছিলেন, তার পরিবহন ব্যবসা আছে। তার কয়েকজন ড্রাইভারকে তিনি ফেসবুক একাউন্ট খুলে দিয়েছেন অতি সম্প্রতি। যারা ভালো করে ফেসবুক চালাতে জানেন না। সপ্তাহ খানিক পর তিনি অবাক হয়ে দেখলেন তার পুরানা একাউণ্ট এর নান্দনিক পোস্ট গুলির চেয়ে দশগুন বেশি লাইক পড়ছে ঐ ড্রাইভারদের ভুলেভরা স্ট্যাটাস গুলিতে। আমরাও দেখি ভালো একটা লিখা কিংবা কবিতায় সর্বোচ্চ লাইক পড়লো ৪০-৫০ টা। কমেন্টস হল ৫/৭ টা। আর একজন ড্রাইভার লিখলেন-‘টেরাপিক ফুলিসকে আজও টেকা দিচি’। ব্যস লাইক শুরু হয়ে গেল ঘন্টায় ১২০ মাইল স্পীডে। কয়েক ঘন্টা পর দেখা গেল ৩০০’র ওপরে লাইক ৫০টার ওপরে কমেন্টস। এতেই কী বোঝা যায়না ফেসবুক কাদের দখলে ? শিক্ষিত তরুন-তরুনী সহ বয়স্করা যতবেশি ফেসবুকিং এ এগিয়ে আসবেন ততবেশি সমাজ উপকৃত হবে বলে আমাদের ধারনা। ফেসবুকের মাধ্যমে সমাজের অসংগতিগুলির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া খুবই সহজ। নানা দুর্ঘটনা, অনিয়ম, দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করতে ফেসবুকের বিকল্প নেই। অতীতেও দেখা গেছে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অদম্য শক্তির কারিশমা। ফেসবুককে সাম্প্রদায়িকতা ও ইভ টিজার এবং কুরুচিপুর্ন মানসিকতার নিন্মশ্রেনীর করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করতে হলে লেখক, কবি সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের এগিয়ে আসতে হবে। ফেসবুকে শুধু বন্ধু না, আত্মীয়-স্বজন, গোটা পরিবার যেন পরস্পর পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকে। সন্তানগণ যেন মা-বাবার ফেসবুক আইডির সাথে যুক্ত থাকে। এতে সন্তানদের ভাল-মন্দে সার্বক্ষনিক নজরদারি করা হবে। ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে নিজ সন্তানদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেবেননা। সন্তানদের চোখে চোখে রাখা মা-বাবার দায়িত্ব। ঐশীর মত একটি মেয়ে কীভাবে সঙ্গদোষ আর মা-বাবা কর্তৃক অন্ধ ভালবাসায় অন্ধকারে পা বাড়িয়ে সর্বস্ব হারিয়েছে তা থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। মা-বাবার অনেক আদরের মেধাবী সন্তান আজ ‘জঙ্গি’ হয়ে দেশ এবং জাতির শত্রু হয়ে অকালে জীবন দিয়ে চরম ভুলের মাশুল দিচ্ছে। ফেসবুক থেকে তথ্য সংগ্রহ করে অনেক অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যাবহার করা হোক অপরাধ নির্মুলে। ইদানিং বাংলাদেশের পুলিশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপরাধ কমাতে ফেসবুকের সাহায্য চেয়েছে। বিশেষ করে একাউণ্ট খোলার সময় যেন ব্যাক্তিকে জাতীয় পরিচয় পত্র বা পাসপোর্ট প্রদর্শন বাধ্যতা মূলক করে। সেই বিষয়ে ফেসবুককে প্রস্তাব করেছে পুলিশ। চিফস অব পুলিশ কনফারেন্সের দ্বিতীয় দিনে ১৩ মার্চ (২০১৭) ফেসবুকের সেফটি ম্যানেজার বিক্রম লেংগেহর সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশের পুলিশের পক্ষ থেকে এই প্রস্তাব জানানো হয়। (সুত্রঃ সুপ্রভাত বাংলাদেশ) আলোচনা শেষে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক মনিরুজ্জামান বলেন- সাইবার অপরাধ তদন্তের ক্ষেত্রে ফেসবুক যেন সহায়তা দেয়, এই বিষয়টি বলা হয়েছে। ফেসবুকের একাউন্ট করতে গেলে পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয় পত্র বা ওই ব্যাক্তিকে পরে শনাক্ত করা যায় এমন কোন পরিচয় পত্র প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব দিয়েছে পুলিশ।ফেসবুক প্রতিনিধি বিক্রম বলেছেন, তাদের নিজস্ব নীতিমালায় সাংঘর্ষিক না হলে তারা সব রকম সহযোগিতা করবেন।

আমরাও আশা করি ফেসবুককে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কিছু প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজন করলে ফেসহীন, ঠিকানা বিহীন ছদ্মবেশি অপরাধীদের দৌরাত্ব্য অন্তত ফেসবুকে হ্রাস পাবে। ফেসবুকের মত শক্তিশালী একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে আমরা যথাযথ ব্যাবহারোপযোগী করে তুলতে পারলে আমাদের সমাজের চিত্র বদলে যাবে বলে সমাজবিজ্ঞানীদের বিশ্বাস।

_______________________ লেখকঃ সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply