২৯ এপ্রিল ২০২৪ / ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / দুপুর ১২:৫৮/ সোমবার
এপ্রিল ২৯, ২০২৪ ১২:৫৮ অপরাহ্ণ

সভ্য জাতিসত্ত্বা গঠনে শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিকতা মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে

     

 

মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন

মানুষ সামাজিক জীব। “মানুষ” জন্মগতভাবে “মানুষ” হিসাবে পরিচিতি পেলেও ‘মনুষ্যত্ব’ অর্জন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে পারিবার, সমাজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পরিবারকে মানব জাতির প্রাথমিক শিক্ষালয় বলা হলেও বর্তমান সমাজচিত্র ভিন্ন। যথার্থ জীবন আদর্শের অভাবে পরিবারগুলো এখন ভোগবিলাস ও পরশ্রীকাতর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা ও ধনবাদী ধ্যান-ধারণায় গড়ে উঠেছে ভারসাম্যহীন সমাজ। ব্যক্তির যেমন চাহিদা আছে, তেমনি সমাজেরও চাহিদা আছে। সমাজ মানুষ থেকে সব সময় সামাজিক আচরণ প্রত্যাশা করে। সমাজপ্রত্যাশিত আচরণ সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য একান্ত কাম্য। বিশ্বসভ্যতা থেমে নেই। শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্প ও প্রযুক্তি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্বসভ্যতা। আধুনিক সভ্যতার দৌড়ে হারিয়ে যাচ্ছে প্রচলিত নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। ক্রমশই বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়। নষ্ট হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা এবং ছিন্ন হচ্ছে সামাজিক সম্পর্ক। অস্থির হয়ে উঠছে সমগ্র সমাজব্যবস্থা। দেশে চলছে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চরম দুর্ভিক্ষ। মানব সমাজে প্রাচীন কাল থেকেই নৈতিকতার ধারণা রয়েছে। ‘নৈতিক’ শব্দের উৎপত্তি নীতি থেকে। মোরালিটি নৈতিকতার ইংরেজি শব্দ এবং ল্যাটিন শব্দ মোরালিটাস। এর বাংলা অর্থ চরিত্র, ভদ্রতা, সততা, সঠিক আচরণ ও নৈতিকতা। বস্তুত মানুষ একটি নৈতিক প্রাণী। মানুষকে নৈতিকভাবে দায়িত্বশীল করেই সৃষ্টি করা হয়েছে। নৈতিক জবাবদিহীতা মানুষের বৈশিষ্ট্য। মানুষের সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীর পার্থক্য প্রধানত নৈতিক। জৈবিক দিক মানুষসহ সব জীবেরই রয়েছে কিন্তু নৈতিক দিক শুধু মানুষেরই আছে। এদিক দিয়ে মানুষ অনন্য। সব সমাজে ও সব ধর্মে নৈতিকতার গুরুত্ব স্বীকৃত। নৈতিকতার উন্নয়নের ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বের দাবীদার একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষা ব্যবস্থা যদি নৈতিকতার উন্নয়নের সহায়ক না হয় তাহলে সে শিক্ষার মাধ্যমে মানবজাতির সত্যিকার কল্যাণ সাধন সম্ভব নয়। তাই নৈতিকতার উন্নয়নে শিক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। নৈতিকতা বলতে মুলতঃ আমরা বুঝি মানুষ অন্যদের মানুষ ও মানবজাতি বহির্ভূতদের সাথে কীভাবে আচরণ করে তার নির্যাস ও রূপরেখা। অন্যান্যদের সাথে পারস্পরিক কল্যাণ, প্রবৃদ্ধি, সৃজনশীলতার উন্নয়নে কিভাবে মানুষ আচরণ করে এবং কীভাবে মন্দের পরিবর্তে ভালো, ভুলের পরিবর্তে শুদ্ধতার জন্যে প্রয়াস চালায় নৈতিকতা তারই নির্দেশনা দেয়। নৈতিকতাকে দার্শনিকরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। সাদামাটা কথায়, ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ এবং সাধারণ সততার আচরণিক বহিঃ প্রকাশকে নৈতিকতা বলে। জ্ঞানের লক্ষ্য তাত্ত্বিক নয়, ব্যবহারিক। নৈতিকতা বিষয়টিও ব্যবহারিক, যা সরাসরি আচরণের সঙ্গে জড়িত। কারো কাছে নৈতিকতা সহজাত সম্পদ, কারো কাছে শোকেসে তুলে রাখা ভালো ভালো কথার ডালি। একটি রাষ্ট্রের জন্য নৈতিকতা শিক্ষাদান এবং জনগণের মধ্যে তা জিইয়ে রাখা বণর্নাতীত দরকারি। বাংলায় নৈতিকশিক্ষার ওপর সর্বপ্রথম গুরুত্ব প্রদান করেন পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উনিশ শতকের মাঝামাঝি নৈতিক শিক্ষাকে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেন। তিনি নিজেই নৈতিক শিক্ষার উপাদান অন্তর্ভুক্ত করে পাঠ্যবই রচনা করেন ও কয়েকটি বিদেশি বই অনুবাদ করেন। নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ মানবজীবনকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলে। বিশ্বের কল্যাণকর বিষয়গুলোর অন্যতম নির্ণায়ক হলো নৈতিকতা। মানবজীবনকে সুন্দর ও কল্যাণকর করে গড়ে তোলার জন্য সব মানুষই নৈতিক গুণে গুণান্বিত হওয়া প্রয়োজন। পৃথিবীজুড়ে এর প্রভাব সার্বজনীন। সাধারণের কাছে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার পার্থক্য নজরে পড়ে না। আমরা দুটোকে এক মনে করি। কিন্তু বিষয় দু’টি আলাদা। মূল্যবোধ সামাজিকভাবে নির্দিষ্ট আবর্তে বিদ্যমান, যা শুধু স্থানভেদে পরিবর্তিত হয়। পৃথিবীর অনেক দেশে সামাজিকভাবে প্রচলিত থাকায় মদ্যপান, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, সমকামিতা, বিবাহ-পূর্ব সন্তান লাভ প্রভৃতি স্বাভাবিক মনে করা হয়। কিন্তু আমাদের সমাজে এসব খুবই নিন্দিত এবং গর্হিত কাজ। পারিপার্শ্বিক এবং সামাজিক অবস্থানের ওপর মানুষের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ নির্ভরশীল। মূল্যবোধ মানুষের ইচ্ছানির্ভর। আমরা নৈতিকতা আর মূল্যবোধকে এক করে সত্যিকারের নৈতিকতা থেকে দূরে সরে পাশ্চাত্যের সামাজিক মূল্যবোধ আঁকড়ে ধরে নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে নৈতিক মূল শিক্ষা থেকে একধরনের বন্য জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, যা আমাদের জন্য পরকালে কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না। নৈতিকতা ও নৈতিক মূল্যবোধ একসূত্রে গাঁথা। নীতি থেকে বিচ্যুত জীবন কখনো নৈতিকতাসম্পন্ন জীবন হতে পারে না। সব ধরনের অসত্য, অন্যায়, অবিচার ও দুর্নীতিমুক্ত জীবনই আদর্শ মানবজীবন। মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে বড় পার্থক্য নৈতিকতার। মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে নৈতিকভাবে দায়িত্বশীল করেই। তাই মানুষের নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে- ধর্মীয় নিয়মনীতি মেনে চলা। ন্যায় আর সত্যের পথ অনুসরণ করা, অন্যের ক্ষতি না করে যতটুকু সম্ভব পরের উপকারে, অপরের কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত করা। প্রত্যেক ধর্মেই নৈতিকতার গুরুত্ব স্বীকৃত। সব ধর্মে সত্যকে গ্রহণ এবং মিথ্যাকে বর্জন করার আদেশ আছে। নৈতিকতা সব সময় সঠিক এবং সৎ পথের নির্দেশ দেয়। যেসব নৈতিক গুণ মানবচরিত্রকে মহিমান্বিত করে তার মধ্যে সততা একটি মূল্যবান ও মহৎ গুণ। যে সমাজে সততার মূল্য নেই, সে সমাজে মানুষের এবং পশুর মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকতে পারে না। সততাকে বাদ দিয়ে মানুষ নৈতিক বলে বলীয়ান হতে পারে না। নৈতিকতা মানবচরিত্রকে সুশোভিত করে তোলে। নৈতিকতা ও মনুষ্যত্বের মাঝে রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। নৈতিকতার স্বরূপ প্রকাশিত হয় সততা, ন্যায়পরায়ণতা, আদর্শবাদিতা প্রভৃতি গুণের সমাবেশের মাধ্যমে। নৈতিকতা হচ্ছে একজন মানুষের জীবনের বড় গুণ। আমাদের আদর্শ, মহৎ, সৎ ও সুন্দর জীবনযাপনের জন্য নৈতিক শিক্ষা অপরিহার্য। জীবনকে সুখী ও সমৃদ্ধ করতে অবশ্যই নৈতিকতার মাধুর্যে উৎকর্ষমণ্ডিত হতে হবে। তাহলে দেশ ও জাতির প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব। সৎ ও ন্যায়ের পথ সব সময় উজ্জ্বল থাকে, আর অসত্য সব সময় পরাজয়ের গ্লানি বয়ে আনে। তাই প্রত্যেক ব্যক্তিকে, জাতিকে, সমাজকে, দেশকে নৈতিকতার শক্তিতে বলীয়ান হতে হবে। দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য নৈতিকতার বিকল্প নেই। সমাজজীবন থেকে অনৈতিকতা ও মূল্যবোধহীনতা দূর করার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। জনগণকে নৈতিকতার শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সরকারের উদ্যোগে সমাজের অভিভাবক শ্রেণিকে নিয়ে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া সম্ভব। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য পরিবার ও সমাজের নীতি-নৈতিকতা সম্পর্কিত আলাদা কাউন্সিলিং ক্লাসের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পরিবারের অভিভাবকদেরও নিজের সন্তান ও অন্যান্য সদস্যের আচার-আচরণ এবং চলাফেরার প্রতি খেয়াল রাখা জরুরি। সন্তানের মানসিক গঠনের প্রথম পাঠই শুরু হয় পরিবার থেকে। সুষ্ঠু পারিবারিক বলয় থাকলে সন্তানও সুষ্ঠুভাবে গড়ে ওঠে। বলার অপেক্ষা রাখে না, অনাকাঙ্খিত অনেক ঘটনা ও দুর্ঘটনা কখনো কখনো ঠেকানো হয়তো সম্ভব নয়, তবে এসব ঠেকানোর মতো উদ্বুদ্ধকরণমূলক ব্যবস্থা নেয়া গেলে তা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। উল্লেখিত বিষয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতার জোয়ার সৃষ্টি করা প্রয়োজন। সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র ও জাতিতে সব ধরনের বিভেদ, অন্যায়-অবিচারের অবসান ঘটাতে হবে। অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রশাসনিক কাজে নীতিবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। জনগণের মধ্যে দেশাত্মবোধ থাকতে হবে। তবেই অনৈতিকতার বেড়াজাল থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। পৃথিবীর সব মহামানব স্থান করে নিয়েছেন আপন চরিত্রবলে। তারা তাদের নৈতিকতা দিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছেন। একটা দেশ ও জাতির জন্য নৈতিকতার গুরুত্ব অপরিসীম। নৈতিকতা ছাড়া কোনো দেশ বা জাতির টেকসই উন্নয়ন হয় না। নৈতিক মূল্যবোধের অভাবে মানবসমাজ আজ চরম দুর্দশাগ্রস্ত। বিভিন্ন জাতি আজ হয়ে পড়েছে দিশেহারা। তাই জাতিকে সুপথে চালিত করতে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিকতার বীজ বপন করতে না পারলে কখনো সভ্য জাতি গঠন ও পূর্ণাঙ্গ মানুষ হওয়া যাবে না। তাই নৈতিকতার মূল্যবোধ প্রজন্মের মধ্যে জাগানো অত্যন্ত জরুরী।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিষ্ট ও চিকিৎসক।
মোবাইল: ০১৭১৮-১৩৩৯৫৫

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply