২৭ এপ্রিল ২০২৪ / ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / সন্ধ্যা ৬:৪৪/ শনিবার
এপ্রিল ২৭, ২০২৪ ৬:৪৪ অপরাহ্ণ

আত্মশুদ্ধির প্রবারণা ও কঠিন চীবর দান

     

লায়ন উজ্জ্বল কান্তি বড়ুয়া
প্রবারণা পূর্ণিমা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের একটি অন্যতম ধর্মীয় উৎসব; যা আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পালিত হয় বিধায় আমরা আশ্বিনী পূর্ণিমা নামেও অভিহিত করি। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব।
“প্রবারণা” এই পালি শব্দটির আভিধানিক অর্থ- নিমন্ত্রণ, আহ্বান, মিনতি, অনুরোধ, নিষেধ, ত্যাগ, শেষ, সমাপ্তি, ভিক্ষুদের বর্ষাবাস পরিসমাপ্তি, বর্ষাবাস ত্যাগ, বর্ষাবাস ত্যাগের কার্য অথবা শিষ্টাচার, বিধি, তৃপ্তি বা সন্তুষ্টির বিষয়, ক্ষতিপূরণ, প্রায়শ্চিত্ত, ঋণ পরিশোধ প্রভৃতি বুঝায়। অর্থাৎ প্রবারণা হচ্ছে প্রকৃষ্টরূপে বরণ ও বারণকে অন্তরে ধারণ করে বিশুদ্ধ বিনয়াচারে জীবন পরিচালিত করার আদর্শে ব্রতী হয়ে ধর্মাচারের পরিপন্থী কর্মসমূহ পরিহার করাকে বুঝায়। আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে শ্রাবণী পূর্ণিমা হয়ে মধু পূর্ণিমা বা ভাদ্র পূর্ণিমা অতঃপর আজকের এ আশ্বিনী পূর্ণিমা বা প্রবারণা পূর্ণিমা পর্যন্ত বর্ষাব্রত অধিষ্ঠানের ব্যাপ্তিকাল। বৌদ্ধ ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে, বুদ্ধ যখন শ্রাবস্তীর জেতবন মহাবিহারে অবস্থান করছিলেন, তখন কোশাল হতে একদল ভিক্ষু বর্ষাব্রত সমাপনান্তে বুদ্ধের নৈকট্য লাভে উপস্থিত হয়েছিলেন। বুদ্ধ তাঁদেরকে বলেছিলেন, ‘ভিক্ষুসংঘ একস্থানে সম্মিলিতভাবে বসবাস করলে তাঁদের মধ্যে বহু বাদবিসংবাদ হওয়া অস্বাভাবিক নহে।’ বর্ষাবাস সমাপ্তির পর তোমরা অবশ্যই একত্র হয়ে ‘প্রবারণা’ করবে। প্রবারণা চতুর্দশী অথবা পঞ্চদশী তিথিতে করতে হয়। প্রবারণা কর্ম চার প্রকার। যথা (১) ধর্ম বিরুদ্ধ বর্গের (সংঘের একাংশ) প্রবারণা, (২) ধর্ম বিরুদ্ধ সমগ্র সংঘের প্রবারণা, (৩) ধর্মানুকূল বর্গের প্রবারণা এবং (৪) ধর্মানুকূল সমগ্র সংঘের প্রবারণা। তন্মধ্যে শেষোক্ত প্রবারণা কর্ম করাই বিধেয়। বুদ্ধের নির্দেশ হলো এই তিন মাস ভিক্ষু-সংঘ নিরবিচ্ছিন্নভাবে ধ্যান সাধনায় নিরত থেকে নিজ নিজ চিত্তের উৎকর্ষ বিধান করবে। প্রতি অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় ভিক্ষু-সংঘ সীমায় একত্রিত হয়ে অসাবধানতাবশত যদি কোনো ক্ষুদ্রানুক্ষুদ্র দোষত্রুটি জীবন চলার পথে সংঘটিত হয়ে থাকে, তা তাঁরা পারস্পরিক ‘আপত্তি দেশনা’র মাধ্যমে পরিশুদ্ধ থাকার অঙ্গীকারবদ্ধ হবে। তাঁরা ভিক্ষুসীমায় বসে ভিক্ষু প্রাতিমোক্ষ পাঠ বা দেশনা করবেন। ভিক্ষু প্রাতিমোক্ষে সন্নিবেশিত ভিক্ষুর অবশ্য-প্রতিপালনীয় ২২৭ শীলের মাহাত্ম্য পর্যালোচনাপূর্বক তাঁর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও প্রয়োজনীয়তা অনুপুঙ্খ বুঝে নেবে বয়োজ্যেষ্ঠ ভিক্ষু-সংঘের কাছ থেকে। ভিক্ষুরা বর্ষার তিন মাস বুদ্ধের ধর্ম-দর্শন গবেষণা করবে। প্রত্যেক অমাবস্যা পূর্ণিমা ও অষ্টমী তিথিতে সমাগত অষ্টশীল অধিষ্ঠিত উপোসথ ব্রতধারী পুণ্যপ্রত্যাশী ও দুঃখান্ত সাধনে বদ্ধপরিকর উপাসক-উপাসিকাদের উদ্দেশ্য বুদ্ধের ধর্ম-দর্শনের ওপর আকর্ষণীয় ভাষণের মাধ্যমে সদাসর্বদা তাঁদেরকে আত্মকল্যাণ, আত্মশুদ্ধিসহ পরকল্যাণব্রতে আত্মনিবেদিত থাকার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করবেন। বস্তুত প্রতিনিয়ত ধর্মশ্রবণ, সশ্রদ্ধচিত্তে ধর্মকে তথা সত্য ধর্মকে অন্তরের অন্তস্তলে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত রাখার মধ্য দিয়ে প্রতিটি নর-নারী ও ভিক্ষু-সংঘের যাপিত জীবনের পরতে পরতে নিয়মনিষ্ঠভাবে সত্য ধর্মকে প্রতিপালনের একটি জীবনচক্র বির্নিমাণের লক্ষ্যেই করুণাঘন তথাগত বুদ্ধের বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান বিধানের একটি অনন্যসাধারণ মাঙ্গলিক প্রয়াস। কারণ তাঁর ধর্ম শ্রবণ, ধারণ ও অনুশীলন-এ তিনটি অপরিহার্য, অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ পারস্পরিক সহায়তাকারী গঠনশৈলীর ওপর পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল ও বিন্যস্ত। বর্ষাবাস সমাপনান্তে ভিক্ষুগণ তাদের দোষত্রুটি অপর ভিক্ষুগণের নিকট প্রকাশ করে তার প্রায়শ্চিত্ত বিধানের আহ্বান জানায়; এমনকি অজ্ঞাতসারে যদি কোনো অপরাধ হয়ে থাকলে তার জন্যও ক্ষমা প্রার্থনা করা বিধেয়। এটিই হলো ভিক্ষু-সংঘের জন্য প্রবারণার বিধান। অর্থাৎ দৈনন্দিন জীবনাচারের প্রতিটি মুহূর্তে সচেতনভাবে ঘটিতব্য সর্ববিধ দোষকে বর্জন করে গুণের প্রতি আকৃষ্ট থাকার চেতনা সৃষ্টি করাই প্রবারণার উদ্দেশ্য। শ্রাবস্তীর জেতবনে অবস্থানকালে গৌতম বুদ্ধ ভিক্ষু-সংঘের পালনীয় হিসেবে এর প্রবর্তন করেন।
বৌদ্ধ মতে, এ পুণ্যময় পূর্ণিমা তিথিতে গৌতম বুদ্ধ ঋদ্ধিবলে তাবতিংস স্বর্গে উপনিত হয়ে মাতৃদেবীকে অভিধর্ম দেশনার পর ভারতের সাংকাশ্য নগরে অবতরণ করেন এবং মানব জাতির সুখ, শান্তি ও কল্যাণে দিকে দিকে স্বদ্ধর্ম প্রচারের জন্য তার ভিক্ষু সংঘকে নির্দেশ প্রদান করেন। কথিত আছে এই তিথিতে গৌতম বুদ্ধ ষাট জন অর্হৎ ভিক্ষুকে ধর্ম প্রচারের জন্য বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করেন এবং তাদের বলেন, ‘‘চরত্থ ভিকখবে চারিকং, বহুজন হিথায় বহুজন সুখায়’’ – অর্থাৎ, ভিক্ষুগণ আত্মহিত ও পরহিতের জন্য, বহুজনের হিতের এবং বহুজনের সুখের জন্য আদি-মধ্য-অন্তে কল্যাণকর ধর্ম দিকে দিকে প্রচার কর। এই নির্দেশনা দিয়ে স্বয়ং বুদ্ধ এবং ভিক্ষুগণ বুদ্ধের বিমুক্তিমূলক ধর্ম প্রচারে বের হয়েছিলেন। এ সময় তাঁরা কল্যাণের বাণী প্রচার করেন, যাতে দেব-মনুষ্যসহ সকল প্রাণীর কল্যাণ সাধিত হয়।
প্রবারণা পূর্ণিমার অন্য একটি উৎসবময় দিক হলো ফানুস উত্তোলন। বৌদ্ধগণ প্রবারণা পূর্ণিমায় আকাশে প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের প্রতীকরূপে ফানুস উত্তোলন করে। কথিত আছে, সিদ্ধার্থ গৌতম গৃহত্যাগ করে অনোমা নদীর তীরে উপনীত হয়ে সারথী ছন্নকে অশ্ব কন্থক ও শরীরের আভরণাদি প্রদান করে বিদায় দেন। অতঃপর তিনি ভাবলেন, একজন গৃহত্যাগী সন্যাসীর মস্তকে সুবিন্যস্ত কেশকলাপ শোভনীয় নহে। তিনি দক্ষিণ হস্তে অসি এবং বাম হস্তে রাজমুকুটসহ কেশকলাপ ধারণ করে কেটে ঊর্ধ্বদিকে নিক্ষেপ করে সত্যক্রিয়া করেন- যদি সত্যিই আমি ইহজন্মে মহাজ্ঞান (বুদ্ধত্ব) লাভে সমর্থ হই তাহলে এই মুকুটসহ কেশরাশি ঊর্ধ্বাকাশে উত্থিত হবে। তাঁর কেশরাশি আকাশে উত্থিত হলো। তাবতিংশ স্বর্গের দেবগণ সাধুবাদের সহিত এই কেশরাশি বরণ করে চুলমনি চৈত্য প্রতিষ্ঠা করে অদ্যবদী পূজা করতে লাগলেন। বৌদ্ধরা বুদ্ধের সেই কেশরাশির প্রতি পূজা ও সম্মান প্রদর্শনের জন্য আশ্বিনী পূর্ণিমায় আকাশ প্রদীপ বা ফানুস উড়িয়ে থাকে। এ করণে আত্মবিশ্লেষণের শিক্ষা, মাতৃকর্তব্য পালন ও বিনয়বিধান অনুশীলনের বহুবিধ মহিমায় এই প্রবারণা পূর্ণিমা মহিমান্বিত। এই পূর্ণিমা তিথিতেই তিন মাসের বর্ষাবাসের পরিসমাপ্তি ঘটে। যে বিহারে ভিক্ষু বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান করবেন সেই বিহারেই প্রবারণার  সমাপনান্তে উদযাপিত হয় দানোত্তম শুভ কঠিন চীবর দানোৎসব এবং বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান কারী ভিক্ষুই কঠিন চীবর লাভ করেন। আশ্বিনী পূর্ণিমা থেকে কার্তিকী পূর্ণিমা পর্যন্ত বিভিন্ন বিহারে মাসব্যাপী দানোত্তম শুভ কঠির চীবর দান অনুষ্ঠিত হয়।
২৮ অক্টোবর ২০২৩ খ্রিস্টািব্দ, ২৫৬৭ বুদ্ধাব্দ সেই মহিমান্বিত পূতপবিত্র প্রবারণা পূর্ণিমা বা আশ্বিনী পূর্ণিমা। প্রবারণা পূর্ণিমা ও কঠিন চীবর দানোৎসব উপলক্ষে বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে তাঁরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। বাণীতে রাষ্ট্রপতি আশা প্রকাশ করে বলেন, যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদায় ‘প্রবারণা ও কঠিন চীবর দান’ উদযাপনের মাধ্যমে বৌদ্ধ সমাজের শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ-সহ বিশ্বের সকল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, মহামতি গৌতম বুদ্ধের শান্তির বাণী মানবজাতির কল্যাণ ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।
বর্ষাবাস, প্রবারণা ও কঠিন চীবর দান একটার সঙ্গে আরেকটা একই সূত্রে গাঁথা। বিশ্বের অপরাপর থেরবাদী বৌদ্ধদের মতো বাংলাদেশের আপামর বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী মহাসাড়ম্বরে মহামহিমান্বিত পূতপবিত্র এ প্রবারণা পূর্ণিমাকে বুদ্ধের ধর্ম-দর্শনসম্মত নানাবিধ, বহু বর্ণিল অনুষ্ঠান সাজিয়ে প্রতিটি বৌদ্ধমন্দিরে যথাযথ ভাবগাম্ভীর ধর্মীয় মর্যাদায় উদযাপন করছে। এই পূর্ণিমা তিথিতে প্রতিটি বৌদ্ধ পরিবারে পিঠা, পায়েসসহ নানান প্রকার উপাদেয় খাদ্য-ভোজ্যে তৈরি করে সকালবেলায় আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা নববস্ত্র পরিধান করে স্থানীয় বিহারে উপগত হয়ে সেই উপাদেয় খাদ্য-ভোজ্য, ফল-ফুল, বাতি ইত্যাদি দিয়ে বুদ্ধ পূজা ও ভিক্ষু-শ্রামণদের আহার্যাদি দান করে পঞ্চশীল ও অষ্টশীল গ্রহণসহ ধর্মীয় ব্রতাদি পালন করে।  উল্লেখ্য, করুণাঘন তথাগত বুদ্ধ বিশ্ব পরিবেশ সুসংরক্ষণ ও জনকল্যাণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার তাগিদে আষাঢ়ী পূর্ণিমার পবিত্র তিথিতে তাঁর শিষ্য ও শিষ্যা হিসেবে দীক্ষালব্ধ তাঁর অহিংস ধর্ম-দর্শনকে সার্বিক সুস্থিতিদানের লক্ষ্যে ও তাবৎ মানবজাতির মধ্যে মৈত্রী ও অহিংসার বাতাবরণে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় আত্মনিবেদিত, স্ব-স্ব ক্ষেত্রে সুভাবিত চিত্ত ভিক্ষু-সংঘকে তিন মাস বর্ষাব্রত অধিষ্ঠানপূর্বক নিজ নিজ বৌদ্ধমন্দির ও প্যাগোডায় অবস্থান করার বিধান প্রজ্ঞাপ্ত করেছিলেন।
বস্তুত বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান পরিসমাপ্তির পর অর্থাৎ আশ্বিনী পূর্ণিমার পরদিন থেকে কার্তিকী পূর্ণিমা পর্যন্ত এক মাসের মধ্যে এ কঠির চীবর দান সম্পন্ন করার বিধান রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে চীবর শব্দের আগে ‘কঠিন’ কথাটির গভীর তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। বর্তমানে অনেকে কঠিন চীবর বলতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সুতা তৈরি, কাপড় বোনা, কাপড় কাটা, সেলাই ও রঙের কাজ সম্পন্ন করতে হয় বলে একে আক্ষরিকভাবে কঠিন চীবর বলে থাকেন। তবে পারমার্থিক অর্থে একে কঠিন বলার তাৎপর্য হচ্ছে- কঠিন চীবর দান সব সময় করা যায় না, এ দান একটা বিহারে বছরে মাত্র একবারই করতে পারে। উক্ত নির্ধারিত সময় ছাড়া অন্য সময়ে এ দান করতে পারে না। উল্লেখ্য, চীবর আর কঠিন চীবর এক কথা নয়। বস্ত্র এক হলেও প্রেক্ষাপট ও আনুষ্ঠানিকতা ভিন্ন। চীবর যেকোনো সময় ভিক্ষুকে দান করা যায়। কিন্তু কঠিন চীবর বর্ণিত নিয়মে শুধু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অর্থাৎ আশ্বিনী পূর্ণিমা থেকে কার্তিকী পূর্ণিমা এক মাস সময়ের মধ্যে বর্ষাবাস যাপনকারী ভিক্ষু সংঘকে দান করা যায়। একজন ভিক্ষু যে বিহারে বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান পূর্বক বর্ষাযাপন করবেন সেখানেই তিনি কঠিন চীবর দান গ্রহণ করতে পারবেন। দোয়াজিক, অন্তর্বাস, চীবর ও কটিবন্ধনী এই চার খণ্ডের ভিক্ষু-সংঘের পরিধেয় বস্ত্রের অপর নাম ত্রি-চীবর। উল্লেখিত ত্রি-চীবর বা যেকোনো একটা দিয়ে ‘কঠিন চীবর দান’ করা যায়। কঠিন চীবর দানের দিন অরুণোদয় থেকে পরদিন অরুণোদয় পর্যন্ত সময়ে তুলা থেকে সুতা কাটা, কাপড় বোনা, কাপড় কাটা (কর্তন), সেলাই ও রং করা প্রভৃতি কাজ উল্লিখিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করে দান করতে হয়। অর্থাৎ এক দিনের মধ্যে তৈরি করা হয় এই ত্রি-চীবর। এভাবে চীবর তৈরির কায়িক-বাচনিক ও মানসিক পরিশ্রম বেশি ফলদায়ক হয় বলে ত্রিপিটকে উল্লেখ রয়েছে। এটাই কঠিন চীবর দানের বিশেষত্ব। কঠিন চীবর দানকে সর্বশ্রেষ্ঠ দান হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। চীবর তৈরির পর সূর্যাস্তের পূর্বেই ত্রিশরণসহ পঞ্চশীল গ্রহণ করে নিম্নোক্তভাবে তিনবার বলে ভিক্ষু-সংঘকে চীবর দান করতে হয় : “ইমং কঠিন চীবরং ভিক্ষুসংঘস্স দেমং, কঠিন অত্থরিতুং”। ভিক্ষু-সংঘ উক্ত চীবর সীমায় নিয়ে বিনয় বিধান মতে বিহারবাসী ভিক্ষুকে প্রদান করেন। সেই বিহারে বর্ষাবাসী অন্য ভিক্ষু থাকলে তা অনুমোদন করে কঠিন চীবরের পঞ্চফল লাভ করতে পারেন। তবে বর্ষাব্রত ভঙ্গকারী ভিক্ষু তা অনুমোদন ও পঞ্চফল লাভ করতে পারে না। বৌদ্ধ ধর্মে এটাই একমাত্র দান দাতা-গ্রহীতা উভয়ে পুণ্যফল লাভ করেন। কঠিন চীবর লাভী ভিক্ষু পঞ্চফল লাভ এবং পাঁচটি দোষমুক্ত হন। পঞ্চফল গুলো নিম্নরূপ :
ক. পূর্বাহ্নের জন্য নিমন্ত্রিত ভিক্ষুদাতার বাড়ি থেকে সহপাঠীর অপরাপর ভিক্ষুকে না বলে অন্যগৃহে গমন করতে পারে। খ. যেই বিহারে কঠিন চীবর প্রাপ্ত হয় তা সমস্তই কঠিন চীবর লাভী ভিক্ষুরই অধিকার থাকবে। গ. অধিষ্ঠিত ত্রি-চীবর নিজের হস্তপাশে না রেখে অরুণোদয় পর্যন্ত থাকতে পারবে। ঘ. অতিরিক্ত ইচ্ছানুরূপ অধিষ্ঠান কিংবা বেনামায় নিজের কাছে রাখতে পারবে ও ঙ. চারজনের একাধিক ভিক্ষু নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে ভোজন করতে পারবেন। বিহারস্থ ভিক্ষুরা কঠিন চীবর অনুমোদনের পর আগন্তুক ভিক্ষুরা অনুমোদন করতে পারেন। মহাকারুণিক বুদ্ধ পাথ্যেয়কবাসী ত্রিশজন ভিক্ষুকে উপলক্ষ করে দানোত্তম কঠিন চীবর দানের প্রবর্তন করেছিলেন। বুদ্ধ এক সময় পঞ্চশত ষড়াভিজ্ঞ অরহত ভিক্ষুসহ আকাশপথে হিমালয়ে গিয়ে ‘অনবতপ্ত হ্রদ’ নামক মহাসরোবরে উপস্থিত হন। সহস্র দল পদ্মে উপবিষ্ট হয়ে বুদ্ধ বললেন, ‘হে ভিক্ষুরা, নাগিত স্থবিরের মুখে কঠিন চীবর দানের মাহাত্ম্য শোনো’। অতঃপর নাগিত স্থবির বলতে লাগলেন আমি শিখি বুদ্ধের সময়ে বহুবিধ পুণ্যকর্মসহ উত্তম পুণ্যশ্রেষ্ঠ সংঘমধ্যে কঠিন চীবর দান দিয়ে এই কল্প থেকে বিগত ত্রিশকল্প পর্যন্ত দুর্গতি অনুভূতি করিনি। আঠারকল্প দেবলোকে দিব্যসুখ ভোগ করেছি। চৌত্রিশবার ইন্দ্র হয়ে দেবকুলে রাজত্ব করেছি। অজস্রবার ঐশ্বর্যশালী ব্রহ্মা হয়েছি। কোথাও আমার ভোগসম্পদের অভাব হয়নি। যেখানে জন্মগ্রহণ করি না কেন সেখানে সম্পত্তিলাভের কোনো কমতি থাকত না। যে ফলগুলোর কথা বললাম সবগুলোই একমাত্র কঠিন চীবর দানের ফল।
নাগিত স্থবিরের ভাষণ শেষ হলে ভগবান বুদ্ধ পুনঃ কঠিন চীবর দানের ফল ব্যাখ্যা করেন ‘হে ভিক্ষুরা শিখি বুদ্ধের সময় সনজয় ব্রাহ্মণ হয়ে কঠিন চীবর দান করেছিলাম। তার মহাফল বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি পর্যন্ত ভোগ করেছি। অষ্টপরিষ্কারাসহ অন্যান্য যাবতীয় দানীয় সামগ্রী শত বছর ধরে দান দিলেও একখানা কঠিন চীবর দানের ষোলভাগের একভাগের সমান হবে না।’ বুদ্ধ, প্রত্যেক বুদ্ধ ও মহাশ্রাবকগণ কঠিন চীবর দানের ফলপ্রাপ্ত হয়ে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেছেন। যিনি শ্রদ্ধা সহকারে কঠিন চীবর দান করেন তার ফল তিনি প্রয়োজনে বিস্তৃত কনক বিমান, সহস্র অপসরা এবং মণিমুক্তা বৈদুর্য্য এবং কল্পকর্ম প্রভৃতি সম্পদ এবং দিব্যপুষ্করিণী লাভ করেন। এটা পঞ্চফল যুক্ত এবং পঞ্চদোষ বিবর্জিত। এই কঠিন চীবর দানের কথা বুদ্ধ দেশনায় বলেছেন, এটার ফল অসংখ্য ও অপ্রেময়। সুতরাং প্রত্যেকের জীবনে অন্তত একবার কঠিন চীবর দান করা একান্ত প্রয়োজন। এটা ভবিষ্যতে মহাফল দান করে।
বর্তমানে কঠিন চীবর দান থেরবাদী বৌদ্ধ দেশগুলোয় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয়, সামাজিক ও জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।এদানের প্রাক্কালে আজকের এ মহাপুণ্যময় দিনে বুদ্ধবাণী স্মরণই পারে নানান দূর্যোগ থেকে পরিত্রাণ ও সংঘাতমুক্ত বিশ্ব গড়তে। আজকের  এই দিনটি অসাম্প্রদায়িক সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হোক। এ উৎসব একদিকে বৌদ্ধ ভিক্ষু-সংঘের মধ্যে পারষ্পরিক মৈত্রী, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও শৃঙ্খলা বৃদ্ধি করে অপরদিকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মধ্যে বন্ধুত্ব ও অসম্প্রদায়িক ভাবধারা সুদৃঢ় করে যে যার অবস্থানে থেকে দেশের মঙ্গলময় ভবিষ্যৎ রচিত করা প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব এবং কর্তব্য বলে মনে করি। বাদ-বিসংবাদ ভুলে গিয়ে শাশ্বত সত্যকে গ্রহণ করে পারস্পরিক সহাবস্থানই প্রবারণার মূল আদর্শ। এ আদর্শকে ধারণ ও অনুশীলনের মাধ্যমে একটি পরিচ্ছন্ন সমাজ গড়ে উঠবে। কারণ ধর্ম মানে সুশৃঙ্খল জীবনযাপন। সুশৃঙ্খল জীবনযাপনই পারে দেশের কল্যাণ বয়ে আনতে। এতে প্রয়োজন সচেতনতা। নিজের বিবেকবোধকে সৎপথে চালিত করে অন্যকেও এপথে আসার জন্য উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা জোগাতে পারলে পরিচ্ছন্ন এবং পাপমুক্ত দেশ আমরা আগামী প্রজন্মকে উপহার দিতে পারব।
জগতের সব প্রাণী সুখী হোক, দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করুক।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply