২৬ এপ্রিল ২০২৪ / ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / রাত ১১:২৫/ শুক্রবার
এপ্রিল ২৬, ২০২৪ ১১:২৫ অপরাহ্ণ

বসন্ত উৎসবের কথা

     

বরুণ কুমার আচার্য বলাই

বসন্ত উৎসব বাঙালির ঐতিহ্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। যুবক-যুবতীরা ঐ দিবসের প্রতি যথার্থ প্রতিপাদ্যকে সামনে নিয়ে বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বে পালিত হয়। বাংলাদেশের চট্টগ্রামেও এ ব্যতিক্রম নয়। চট্টগ্রামে দিনটি যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়। বসন্ত কথাটি শুনলেই ফুলের ঘ্রাণ এসে দোলা দেয় মনে। মনে হয় ফুলেলময় দিনের কথা। বাংলা ভাষাভাষিরা পহেলা ফাল্গুনে বসন্ত উৎসবে মেতে উঠে। তবে শুধু কি বাংলাদেশিরাই এ উৎসবে মেতে উঠে? মোটেই নয়, ঋতুভেদে সারাবিশ্বেই পালিত হয় বসন্ত। তবে বসন্ত বরণে এ উৎসব নানা দেশে নানাভাবে উদযাপন করা হয়।
বাংলাদেশ: ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্তকে এক সাথে বলা হয় ষড়ঋতু। আর বসন্তকে বলা হয় ‘ঋতুরাজ’। শীতের ঝরাপাতার সাথে বসন্ত আসে প্রকৃতিতে। এদেশের মানুষ গাছের ডালে নতুন পাতায় দেখতে পায় বসন্তের আগমনী বার্তা। শীতের ঝরাপাতা মারিয়ে আর কোকিলের ডাকের সাথে মিলেমিশে বাংলার বুকে আসে বসন্ত। পহেলা ফাল্গুনে এই বসন্ত পালন করা হয়। এদিন লাল, হলুদ রঙয়ের পোশাক পরে খোপায় ফুল গুজিয়ে নারী ও তরুণীরা উৎসবে মেতে উঠেন।
ভারত: ‘ওরে গৃহবাসী, খোল্ দ্বার খোল্, লাগল যে দোল’,এই গানের মধ্য দিয়ে প্রতিবছর ভারতের শান্তি নিকেতনে উদযাপিত হয় বসন্ত। দেশজুড়ে এটি হোলি নামে পরিচিত। ভারতীয় পুরাণ অনুযায়ী, একদিন অসুর হিরণ্যকশিপু আক্রমণ করে বসলো স্বর্গলোক। অবতার বিষ্ণু নরসিংহের রূপে এসে হত্যা করলেন এই অপদেবতাকে। রক্ষা পেলো স্বর্গ। সেই শুভ দিনকে এই অঞ্চলে স্মরণ করা হচ্ছে স্মরণাতীতকাল থেকে। এদিনে একে অপরের গালে আবির মেখে শুভকামনা জানায়। এদিন মিষ্টি, দইয়ের পাশাপাশি আরো থাকে মাঠা ও ভাংয়ের আয়োজন।
ইরান: এশিয়ার এই দেশটির বসন্তের আলাদা রীতি আছে। এটি প্রায় তিন হাজার বছর ধরে উদযাপিত হয়ে আসছে। মহাকাব্য শাহনামা ও জরথ্রুস্ত্রিয়ান লোকগাথা থেকে জানা যায়, রাজা জামশিদের আমলে এই উৎসবের প্রচলন হয়। এখানে অপদেবতা বধের গল্প। জামশিদ এমন এক অপদেবতা বধ করেন, যে সব প্রাণীর জন্যই হুমকি হয়ে ছিল। বধের সেই দিনটি নতুন বছরের প্রথম দিন হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে ইরানি সমাজে। মূলত সৌর পঞ্জিকা অনুযায়ী দিনটি উদযাপন করা হয়। ইরানে এর নাম নওরোজ, মানে নতুন দিন।
ইরানে ‘নওরোজ’ আজ ছড়িয়ে পড়েছে মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, চীনের উত্তর-পশ্চিম ও ইউরোপের বলকান অঞ্চলে। ২০১০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক নওরোজ দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
চীন: এশিয়ার প্রভাবশালী দেশ চীনে বসন্ত উৎসব বেশ ঘটা করেই উদযাপন করা হয়। চৈনিক পঞ্জিকা অনুযায়ী পিনইন মাসে প্রথম দিন যা ইংরেজি মাসের ২২ জানুয়ারি তাদের নতুন বছর শুরু হয়। যা তারা ২২-২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত উদযাপন করে থাকে। একে বলা হয় চুনইয়ুন। এখানেও সেই অপদেবতার গল্প শোনা যায়। নিযয়ান নামের এক অপদেবতা শীতনিদ্রা শেষে গ্রামে এসে গরু, ছাগল, শস্য ও ছেলেমেয়েদের ধরে খেয়ে ফেলতো। তার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মজাদার বিভিন্ন খাবার তৈরি করে চীনারা নিজেদের দরজায় ফেলে রাখতো। তাদের বিশ্বাস ছিল, এই খাবার খেয়ে নিয়োন আর কোনো অনিষ্ট করবে না। একদিন গ্রামবাসী অবাক হয়ে লক্ষ করল, নিয়োন লাল রঙের পোশাক পরা এক বাচ্চাকে দেখে ভয় পাচ্ছে। পরে গ্রামবাসী আবিষ্কার করে, সে লাল রঙ ভয় পায়। এর পর থেকে শীতের শেষে গ্রাম সাজানো শুরু হয়ে যায় লাল রঙের লণ্ঠন, ব্যানার দিয়ে। পরে আর কখনো নিয়োনকে দেখা যায়নি। এই উৎসবে চীনারা ঘরে তৈরি করে মজার সব খাবার। চৈনিক নববর্ষের এই উৎসব শুধু চীনারাই নয়, উদযাপন করে অধিকাংশ মঙ্গোলীয় নৃগোষ্ঠী।
জাপান: জাপানিদের সবচেয়ে প্রিয় ফুল হো চেরি। যাকে তারা সাকুরা বলেই ডাকে। বসন্তে ফোটে এই ফুল। আর এই সময়কে ঘিরে তাদের বসন্ত। সেই সপ্তম শতাব্দী থেকে এই ফুল ফোটার উৎসবে গা ভাসানো শুরু করে জাপানিরা। এ সময় পুরো দেশটাই যেন ছেয়ে যায় চেরি ফুলে প্রকৃতি অপরূপ হয়ে ওঠে। এই উৎসবকে বলা হয় হানামি। জাপানের বিভিন্ন অঞ্চলে সাকুরা জানুয়ারিতে ফুটতে শুরু করলেও হানামির মূল আয়োজনটা শুরু হয় মার্চ থেকে।
থাইল্যান্ড: সক্রান বা জল ছিটানো উৎসবে থাইল্যান্ড জেগে ওঠে নতুন চেহারায়। এটি শুরু ১৩ এপ্রিল। চলে তিন দিন। বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে এর রয়েছে ব্যাপক মিল। বাংলা ‘সংক্রান্তি’ শব্দটিই সেখানে ‘সক্রান’। আর জল ছিটানোর এই উৎসব আমাদের দেশের মারমা সম্প্রদায়েও করা হয়ে থাকে। প্রথা অনুযায়ী, এই উৎসবে জল ছিটানো হয় শরীর ও মনের কালিমা দূর করার বাসনা নিয়ে। জলে ভিজে মানুষ নিজেকে পবিত্র করে নেয়। ধুয়ে ফেলে গেল বছরের হিংসা, বিদ্বেষ, গ্লানি আর না পাওয়ার বেদনা। এই উৎসবের সঙ্গে যুগে যুগে যোগ হয়েছে বিভিন্ন আচার।
বসন্তের উৎসব যে শুধু এশিয়াতেই হয়, তা ভাবার কোনোই কারণ নেই। ইউরোপেও বেশ ঘটা করে উদযাপন করা হয়। আয়ারল্যান্ড, রোমানিয়া, ইতালি, স্পেন ও ক্রোয়েশিয়ায় সাজ-সাজ রবে উদযাপন করা হয় এই উৎসব। মজার ব্যাপার হলো, কেবল খানাপিনা করেই তা শেষ হয়।
মেক্সিকো: মেক্সিকোর বসন্তকে বলা হয় সান মার্কোস। এটি তাদের সবচেয়ে বড় উৎসব। এ দিনটিতে মেক্সিকোতে সমাগম হয় প্রায় ৭০ লাখ মানুষের। মোরগ লড়াই থেকে শুরু করে সুন্দরী প্রতিযোগিতা, কী নেই সে আয়োজনে! এপ্রিলের ১৪ তারিখ শুরু হওয়া এ অনুষ্ঠানটি চলে প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে।
স্পেন: ১ মার্চ সপ্তাহ ব্যাপি চলে স্পেনে বসন্ত উদযাপন। এ সময় থাকে নাচ, গান, সাজসজ্জা, প্যারেড ও রান্নাবান্নাসহ নানা আয়োজন। এ উৎসবে আতশবাজির ঝলকানিতে জেগে থাকে স্প্যানিশদের রাতগুলো। স্পেনের ভ্যালেন্সিয়ায় গেলে দেখা যাবে, অসাধারণ ফায়ার ওয়ার্ক। উৎসবটির নাম লাস ফালেস। এটি তাদের বসন্তের উৎসব। মা মেরির স্বামী সেইন্ট স্টিফেন জোসেফের স্মরণে তারা এদিন উৎসব পালন করে। সেদিন শহরের প্রতিটি সেন্টারের পাশে কাগজ, কাঠ ও মোমের সমন্বয়ে তৈরি বড় বড় পাপেট দিয়ে সাজানো হয়। এ পাপেটগুলোর নামই মূলত ফালেস।লেখক: মরমী গবেষক, কলামিষ্ট ও প্রাবন্ধিক।

 

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply