২৯ এপ্রিল ২০২৪ / ১৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / সন্ধ্যা ৭:২২/ সোমবার
এপ্রিল ২৯, ২০২৪ ৭:২২ অপরাহ্ণ

এখনো নৃশংসতা থামেনি জ্বলছে বাড়িঘর

     

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সেদেশের সেনাবাহিনীর চলমান নৃশংসতা এখনো থামেনি। হতাহতের ঘটনা কমলেও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ চলছেই। প্রতিদিন ১৫-২০টি বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসতে বাধ্য করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা সংবাদমাধ্যম এবং এক্টিভিস্টরা এসব অগ্নিকান্ডের ছবি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোও সেগুলো প্রচার করছে।

অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশন (এবিসি নিউজ) এ ধরনের কয়েকটি সম্পাদিত ভিডিও একটি বিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকে পেয়েছে। এক প্রতিবেদনে গণমাধ্যমটি বলেছে, মিয়ানমারের ভেতর থেকে পাওয়া ‘জাতিগত নিধনে’র ভিডিও ফুটেজে অর্ধ মাটিচাপা দেয়া লাশ, গ্রামগুলো পোড়ার এবং দুর্দশাগ্রস্ত লোকজনের পাহাড়ের দিকে পালানোর চিত্র দেখা গেছে। মিয়ানমারের কার্যত নেত্রী অং সান সুচি দাবি করেছিলেন নিরাপত্তা বাহিনী ৫ সেপ্টেম্বর অভিযান সমাপ্ত করেছে। কিন্তু প্রাপ্ত ভিডিও তার দাবির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতের একটি পৃথক ভিডিও পাওয়া গেছে। সেখানে নিরাপত্তা বাহিনী ও কিছু লোকজনকে মংডু শহরে মুসলমানদের বাড়িঘরে আগুন দিতে দেখা গেছে।

এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের ঢল সহসাই থামবে না বলে মনে করছে জাতিসংঘ। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) মিয়ানমার সরকারকে শান্তি আলোচনার ডাক দিয়েছে।

বিবিসি তাদের বর্মী বিভাগের সাংবাদিকের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় রাখাইনের মংডুতে রোহিঙ্গাদের ২৩টি বাড়িতে আগুন দেয়া হয়। এরমধ্যে শুক্রবার দুপুরে নর্থ মিওমা গ্রামের আটটি ঘরে আগুন দেওয়া হয়। আগেরদিন বৃহস্পতিবার রাতে আগুন দেওয়া হয় তিন নম্বর ওয়ার্ডের ১৫টি বাড়িতে। সেখানে কারফিউ চলছে এবং সরকার দাবি করছে, মংডু এলাকা তাদের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে। আর এরমধ্যেই আগুন দেওয়া হচ্ছে। কারা আগুন দিচ্ছে তা পরিষ্কার করে না বললেও স্পষ্ট বোধগম্য আগুন দিচ্ছে কোন পক্ষ।

রোহিঙ্গা এক্টিভিস্টরা বলছেন, এসব বাড়িঘর থেকে রোহিঙ্গারা আগেই পালিয়েছিল।  ফলে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। অগ্নিকান্ডের পর ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভাতে এসছিল। ততক্ষণে সব বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। অগ্নিকান্ডের ঘটনার পর আশপাশের গ্রামে যেসব রোহিঙ্গা আছে তারাও বাংলাদেশের দিকে রওয়ানা দিয়েছে। প্রতিদিনই এভাবে মংডু, রাথেডং ও বুথিডং এর বিভিন্ন এলাকার বাড়ি বাড়ি গিয়ে সৈন্য ও রাখাইনরা আগুন দিচ্ছে বলে দাবি করেন তারা।

এবিসি নিউজ জানায়, ভিডিওতে যে মৃতদেহ দেখা গেছে সেগুলো বাথিডং শহরের গু ডার পিয়ান গ্রামের। যেসব স্থানে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে, এটি তারই একটি। ক্যামেরা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় একজন জিজ্ঞাসা করছিল, মৃত লাশ দুটি পুরুষের না মহিলার। ‘ফরটিফাই রাইটসের’ মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ পুটানি কাংকুন ব্যাংককে ফুটেজগুলো দেখে জানান, বৃষ্টি নামলে মৃতদেহগুলো এখনো কাদার মধ্যে ভেসে ওঠে। তিনি আরো বলেন, আমাদের কাছে সাক্ষ্য প্রমাণ রয়েছে যে এখনো হামলা চলছে। ৫ সেপ্টেম্বরের পর থেকে এখনো রোহিঙ্গারা রাখাইন ছাড়ছে।

রাখাইন প্রদেশে এখনো গণমাধ্যম প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত। শুধুমাত্র সতর্কতার সঙ্গে সরকার আয়োজিত সফর ছাড়া। তাই ফুটেজগুলোর সত্যাসত্য নির্ধারণ হয়নি।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ অফিস দাবি করেছে বুথিডংয়ের মি চং জ্যা গ্রামে মুসলমানদের বাড়িতে আগুন দিয়েছে রোহিঙ্গা মুসলমানরা।

এর প্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা এক্টিভিস্ট ও ব্লগার রো ন্যা সান লুইন ইত্তেফাককে বলেছেন, ২৫ আগস্ট থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত এমন কোনো দিন নেই, যেদিন রোহিঙ্গাদের অন্তত কয়েকটি বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়নি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ঢুকতে না দিয়ে অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে নতুন করে প্রপাগান্ডা তৈরির চেষ্টা করছে। সৈন্য ও রাখাইনরা গতকালও বুথিডংয়ে বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন দিয়েছে।

তিনি আগুন জ্বলছে এমন বাড়ির ভিডিও ফেসবুকেও শেয়ার করেছেন।

সান লুইন ছাড়াও রাখাইনের অভ্যন্তরে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা এক্টিভিস্টের সঙ্গে ইত্তেফাকের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। তারাও প্রতিদিন সেখানকার সহিংসতার ছবি ও ভিডিও পাঠাচ্ছেন। তারা জানাচ্ছেন, যেসব রোহিঙ্গা সেখানে অবশিষ্ট আছে, তারা রাতের বেলা প্রাণভয়ে পাহাড়সহ বাড়ির পাশের জঙ্গলে রাত কাটান। এই সুযোগে সেখানে রাতে আগুন দেওয়া হয়। আবার দিনের বেলায়ও আগুন দেওয়া হয়। তবে বেশিরভাগ বাড়ি রোহিঙ্গাশূন্য হওয়ায় আগুন দেওয়ার সময় তেমন কেউ হতাহত হচ্ছে না। তবে  রাস্তাঘাটে দু’চারজন করে রোহিঙ্গা প্রতিদিন হতাহত হচ্ছে। সেনারা এখন কৌশলে রোহিঙ্গাদের রাখাইন ছাড়তে বাধ্য করছে।

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় কর্মরত আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন বলছে, গত মাসের মাঝামাঝি থেকে রোহিঙ্গাদের আসার হার কমে গেলেও তা পুরোপুরি থামেনি। মাঝখানে দুই সপ্তাহ রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসার হার একদম কমে গিয়েছিল। কিন্তু এরপর থেকে এখনো প্রতিদিন ২/৩ হাজার রোহিঙ্গা রাখাইন থেকে পালিয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বলছে, সেখানে গত একমাসে চারশর বেশি গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং আগুন দেয়ার ঘটনা এখনো অব্যাহত আছে।

আইওএম’র ন্যাশনাল কমিউনিকেশন অফিসার শিরিন আক্তার ইত্তেফাককে জানিয়েছেন, গত ২৫ আগস্ট থেকে ১ অক্টোবর পর্যন্ত ৫ লাখ ৯ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এরপরের চারদিনে অর্থাত্ ৫ অক্টোবর পর্যন্ত পালিয়ে এসেছে আরো ছয় হাজার। এরপরের হিসেব এখনো করা হয়নি। যদিও রোহিঙ্গা শরণার্থী এলাকায় কাজ করা অন্যসূত্রগুলোর মতে, এই সংখ্যা সাড়ে পাঁচ লাখ ছাড়িয়েছে অক্টোবরের শুরুতেই। যেসব রোহিঙ্গা ছড়িয়ে গেছে, তাদের অনেকের হিসেব কারো কাছে নেই।

এদিকে গত শুক্রবার জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের মানবিক ত্রাণ দফতরের প্রধান মার্ক লোকক আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন, মিয়ানমার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির উপর যে অভিযান চালাচ্ছে তা ‘তাদেরকে জাতিগতভাগে নির্মূল করার’ কার্যক্রম। এভাবে চলতে থাকলে মিয়ানমার থেকে আবারো বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামবে।

অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের এই মানবেতর অবস্থা মোকাবিলা এবং সেখানে পর্যাপ্ত ত্রাণ তত্পরতা শুরুর জন্য শান্তি আলোচনায় বসতে চায় আরসা। গত ২৫ আগস্ট এই সংগঠনের হামলার কারণেই ‘সন্ত্রাস দমন অভিযান’ চলছে বলে দাবি করে আসছিলো মিয়ানমার সরকার। এরমধ্যে গত মাসের ১০ সেপ্টেম্বর এই সংগঠনটি মানবিক কারণ দেখিয়ে অস্ত্র বিরতির ঘোষনা দিলেও মিয়ানমার সরকার তা প্রত্যাখ্যান করে। দেশটির সরকার, সেনাবাহিনী ও প্রশাসন সংস্থাটিকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ দাবি করে।

গতমাসে দেয়া আরসার অস্ত্রবিরতির সময়সীমা আগামীকাল সোমবার শেষ হচ্ছে। এরপরই তারা সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় যেতে চায় বলে জানিয়েছে। সংগঠনটির টুইটার একাউন্টে তাদের কমান্ডার ইন চিফ আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনীর স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিবৃতিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে।সৌজন্য ইত্তেফাক

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply