২৮ এপ্রিল ২০২৪ / ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / রাত ৮:৪১/ রবিবার
এপ্রিল ২৮, ২০২৪ ৮:৪১ অপরাহ্ণ

হবিগঞ্জে সম্পত্তির লোভে শিকার ভাই-বোন “৪ বছর ধরে শিকলবন্দি”

     

 

সম্পত্তি পাওয়ার লোভে মজিদকে একা নয় তার ছোটবোন মাহিদা আক্তারকে একই অবস্তায় পাগল সাজিয়ে শিকলবন্দি করে রাখার সন্ধ্যান পেয়েছি; ওসি ইয়াছিনুল হক

এ.কে কাওসার, হবিগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি : হবিগঞ্জ জেলা শহরের বহুলা গ্রামে বড় ভাইয়ের সম্পত্তির লোভে শিকার হয়ে আব্দুল মজিদ নামে এক ব্যাক্তি কে শিকলবন্দি থাকা অবস্থায় উদ্ধার করেছে পুলিশ । অভাবের তাড়না আর ভাইদের লোভে শিকার সাজানো পাগল জীবন থেকে মুক্ত পরিবেশে এনে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন পুলিশ ও সচেতন মহলের ব্যক্তিবর্গরা। তাকে উদ্ধারের পর শারীরিক সুস্থতার জন্য হবিগঞ্জ আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) ওসি মোঃ ইয়াছিনুল হকের নেতৃত্বে ওসি (অপারেশন) ডালিম আহমেদসহ একদল পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় বহুলা গ্রামে অভিযান চালিয়ে শিকলবন্দি মজিদ কে উদ্ধার করেন।

বর্তমানে শিকল মুক্ত মজিদ জেলা সদর হাসপাতালে পুরুষ মেডিসিন কক্ষে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

এর আগে ওসি ইয়াছিনুল হক শহরের লোকজনের আর্থিক সহায়তা চেয়ে, স্বপ্রণোদিত হয়ে শিকলবন্দি আব্দুল মজিদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য একটি ফান্ড গঠন করেন।

ওসি জানান, ওই ফান্ডে ১ লাখ টাকা জমা হয়েছে। এ টাকা দিয়ে মজিদের ঘর তৈরি করে দেয়া হবে। এ বিষয়ে তদারকি করার জন্য বহুলার হেলাল আহমেদ, কুদরত আলী ও লাল মিয়া কে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে দেয়া হয়েছে। এদিকে ওসি ব্যক্তিগত উদ্যোগে দুইটি শার্ট, ২টি লুঙ্গি, গেঞ্জি, জুতা, লেপ-তোষক ও পালংকসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী মজিদকে উপহার দেন। রাতে হাসপাতালে গিয়ে মজিদকে উন্নত মানের খাবার দেন এবং চিকিৎসার খবরাখবর নেন।

অপরদিকে মজিদের বাড়িতে একই অবস্থায় তার ছোটবোন মাহিদা আক্তারের (২৮) এর সন্ধান পাওয়া গেছে। আদালতের নির্দেশমতে আগামী রবিবার পুলিশ তাকে উদ্ধার করে তারও পুনবার্সনের ব্যবস্থা করবেন বলে জানান তিনি। ওসি ইয়াছিনের এমন কর্মকান্ডে শহরবাসি তাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন।

উল্লেখ্য, হবিগঞ্জ জেলা শহরতলীর বহুলা গ্রামের মৃত আব্দুর রশিদের পুত্র পয়ত্রিশোর্ধ আব্দুল মজিদ। অভাবের তাড়নায় আব্দুল মজিদ প্রায় ৪ বছর আগে পরিবারের লোকজনের সাথে রূঢ় আচরণ করতেন। শরীর স্বাস্থ্য ভাল না থাকায় কাজ করতে পারতেন না। তিনবেলা খাবার জোগাড় করা তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। এতে সংসারে মজিদকে নিয়ে ঝগড়া-ঝাটি লেগেই থাকতো।

বিয়ে করেছেন বাহুবল উপজেলার উত্তরসুর গ্রামে। দুই সন্তানের জনক আব্দুল মজিদ। সাংসারিক বিষয় নিয়ে স্ত্রীর সাথে প্রায়ই খারাপ আচরণ করতেন। এ সুযোগে সুচতুর বড় ভাই আব্দুল হামিদ তাকে পাগল সাজানোর ফন্দি আঁটে এবং সফলও হয়।
একদিন সন্ধ্যাবেলা মজিদ খাবার খেতে বসলে হামিদ ও ছোট ভাই আব্দুল মোতালিব তাকে জোরপূর্বক বেঁধে ফেলে। এরপর শুরু হয় অমানবিক নির্যাতন। তারপর এলাকায় প্রচার করতে থাকে মজিদ পাগল হয়ে গেছে। সেই থেকে অদ্যাবদি শিকলবন্দি জীবন কাটাচ্ছেন আব্দুল মজিদ।

শিকলবন্দি আব্দুল মজিদ জানান, তার বড় ভাই আব্দুল হামিদ সম্পত্তির লোভে পড়ে তাকে হাত-পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখে পাগল সাব্যস্থ করতে চাইছে। দুই বছর আগে প্রতিরাতেই তাকে মারধোর করতো। সপ্তাহে একদিন শুধু রাতে তাকে খাবার দেয়া হতো। উদ্দেশ্য ছিল তাকে খাবার না দিয়ে মেরে ফেলা। গ্রামের কোন লোক খোঁজ নিতে এলে বাড়ির লোকজন বলতো মজিদ পাগল হয়ে গেছে। তাই তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। লোকজনও বিশ্বাস করতো। কারণ, তার বড় ভাই মোশাহিদ ছিলেন পাগল। তার মতো মোশাহিদকেও শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। খাবার চাইলে তার উপর চালানো হতো নির্যাতন। খাবার না পেয়ে মোশাহিদ মারা যায়। একদিন অন্ধকার ঘর থেকে মোশাহিদের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়।

মজিদ আরও জানান, তার স্ত্রীর জমানো ৬০-৭০ হাজার টাকা ছিল। তাকে চিকিৎসা করানোর কথা বলে আব্দুল হামিদ সেই টাকা আত্মসাত করে। আজ পর্যন্ত তাকে কোন চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যায়নি। উপরন্তু তার স্ত্রী-সন্তানকে নির্যাতন করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

মজিদ জানান, সম্প্রতি আব্দুল হামিদ চিকিৎসা এবং শিকলমুক্ত করার আশ্বাসে তার এক কেদার জমি বিক্রি করে। ওই জমি বিক্রির টাকা দিয়ে চিকিৎসাতো দূরের কথা বরং জিজ্ঞাস করায় তার উপর চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। আত্মসাত করা হয় জমি বিক্রির পুরো টাকা।

এ ব্যাপারে আব্দুল মজিদের স্ত্রী হালেমা খাতুন জানান, সম্পত্তির লোভে ভাসুর আব্দুল হামিদ তার স্বামীকে শিকলবন্দি করে পাগল সাজিয়েছে। খাবার না দিয়ে রাতদিন মারধোর করছে। সন্তানসহ তাকে বাড়ি থেকে মারধোর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। দুই সন্তানকে নিয়ে এখন তিনি পিত্রালয়ে অবস্থান করছেন। হালেমা খাতুনের দাবি, চিকিৎসা দিলে তার স্বামী ভাল হয়ে যাবে।

হালেমা খাতুন জানান, আইনের আশ্রয় থেকে বিরত থাকতে তাকে হুমকি-ধমকি দিয়ে যাচ্ছে তার ভাসুর আব্দুল হামিদ। শুধু তাই নয়, আইনের আশ্রয় নিলে তার দুই সন্তানের ক্ষতি হবে বলেও প্রতিনিয়ত শাসিয়ে যাচ্ছে ভাসুর। এ অবস্থায় আব্দুল হামিদের নির্যাতন সেল থেকে স্বামীকে মুক্ত করতে প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেছেন হতভাগী হালেমা খাতুন।

প্রতিবেশী নূরুজ্জামান চৌধুরী জানান, আব্দুল মজিদের কথা বার্তায় মনে হয় না সে পাগল। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ কয়েকবার চেষ্টা করেছেন তাকে শিখলমুক্ত করতে। কিন্তু মজিদের পরিবারের লোকজন তাকে মুক্ত করতে নারাজ। তারা মজিদকে অহেতুক পাগল বলে প্রচার করছেন। তিনি জানান, তাকে শিকলমুক্ত করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে সে ভাল হয়ে যাবে। যেভাবে মজিদকে শিকলবন্দি করে রাখা হয়েছিল তা মানবাধিকার লংঘনের সামিল। তাকে শিকলমুক্ত করতে পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করছেন তিনি। প্রতিবেশী হাবিবুর রহমান, আবু তাহের সুমন, নাজমুল হোসেন, নূরুল আমীনসহ অনেকেই জানান আব্দুল মজিদ পাগল নয়। শুধু শুধু তাকে পরিবারের লোকজন শিকলবন্দি করে রাখে।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply