২৭ এপ্রিল ২০২৪ / ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / সকাল ৮:২৮/ শনিবার
এপ্রিল ২৭, ২০২৪ ৮:২৮ পূর্বাহ্ণ

সড়ক আইনের সুফল পেতে যাত্রী কল্যাণ সমিতির ৯ দফা সুপারিশ

     

অবকাঠামো ছাড়া আইন বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে

ঢাকা ৩০ নভেম্বর ২০১৯ শনিবার
সড়ক-মহাসড়কের আইন উপযোগী অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা না হলে নতুন সড়ক পরিবহন আইনে সুফল মিলবে না বলে দাবী করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
আজ ৩০ নভেম্বর শনিবার সকালে নগরীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি আয়োজিত “সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ সমূহ” শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তারা উপরোক্ত মন্তব্য করেন। সভায় বক্তারা বলেন, নতুন সড়ক আইনে বেশ কিছু ইতিবাচক দিক থাকলেও প্রস্তুতি ও প্রচারের অভাবে এই আইন বাস্তবায়ন সরকারের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়াঁবে। তবে আইন প্রয়োগকারীসংস্থা, মালিক-শ্রমিক ও সর্বস্তরের জনসাধারণের আন্তরিক সহযোগীতা পেলেই কেবল এই আইন বাস্তবায়ন সম্ভব। কেননা যানজট ও দুর্ঘটনায় আমরা সকলেই ক্ষতিগ্রস্থ। পুরোনো আইনের মতো নতুন আইনেও যাত্রী সাধারণের প্রতিনিধিত্ব না রাখায় মালিক-শ্রমিকরা জনগণকে জিম্মি করলে সরকারের অসহায়ত্ব আরো বেড়ে যাবে বলে অভিযোগ করা হয়।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোঃ মোজাম্মেল হক চৌধুরী সভার ধারণা পত্র পাঠ করেন । এতে বলা হয়, র্দীঘদিনের পুজ্ঞিভূত সমস্যা এই পরিবহন সেক্টরে জেকে বসেছে।এই সব সমস্যা সমূহ এই আইন বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাড়াঁবে। এইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারের সময়োপযোগী ডিজিটাল প্রযুক্তি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন জরুরি।
তিনি এই সেক্টরের নিম্মবর্ণিত প্রধানতম চ্যালেঞ্জ সমূহ তুলে ধরেন ঃ
১. নিরাপদ চালক ও ড্রাইভিং লাইসেন্স ঃ দীর্ঘদিন যাবত এই সেক্টরে ওস্তাদের কাছ থেকে শিখে হেলপার থেকে চালক তৈরী হয়েছে। ফলে তারা অনেকেই আইন কানুন বা বিধিবিধান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এইসব চালকরা পারদর্শী নয় বলেই প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় হাজার হাজার তাজা প্রাণ ঝরছে। এছাড়াও বর্তমানে দেশে ৭০ লক্ষ চালকের বিপরীতে বিআরটিএ কর্তৃক ইস্যুকৃত ড্রাইভিং লাইসেন্স রয়েছে ২১ লক্ষ, প্রায় ৪৯ লক্ষ চালকের হাতে ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। তারা এই সেক্টরের চালিকা শক্তি। এদের প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষাগত যোগ্যতার বেড়াজাল পার হয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স গ্রহণ বা বিশাল সংখ্যক এই চালক শ্রেণীকে লাইসেন্স প্রদান ছাড়া এই আইন বাস্তবায়ন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
২. ফিটনেসবিহীন যানবাহন ঃ বর্তমানে দেশে যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ তার মধ্যে বিআরটিএ নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৪৭ লাখ। অনিবন্ধিত, ভুয়া নাম্বারধারী, নসিমন করিমন প্রায় ১৩ লাখের মত। এছাড়াও আরো প্রায় ১০ লাখ ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশা সড়ক মহাসড়কে চলছে। নিবন্ধিত যানবাহনের প্রায় ৫০ শতাংশ ফিটনেসবিহীন। গণপরিবহন সংকটের কারণে এইসব ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও নসিমন করিমন রাজধানীসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাতায়াতে ভূমিকা রাখে। এই বিশাল সংখ্যক যানবাহন বন্ধ করা বা ফিটনেসের আওতায় আনা সরকারের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ।
৩. ফুটপাত ও পথচারী ঃ দেশের জাতীয় মহাসড়কগুলোর করিডোর ভিত্তিক না হওয়ার কারণে এবং মহানগরীর ফুটপাত হকারদের দখলে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় যে পরিমাণ লোকজন হতাহত হয় তার ৪৬ শতাংশ পথচারী। ফুটপাত দখল মুক্ত করার পাশাপাশি সড়ক থেকে আলাদা করা, দেশব্যাপী সড়ক মহাসড়কে ফুটপাত, জেব্রাক্রসিং, আন্ডারপাস ওভারপাস নিমার্ণ ব্যতিরেখে যত্রতত্র পথচারীদের পারাপার বন্ধ করা যাবে না।তাই এসব অবকাঠামো তৈরীর আগে পথচারীকে বা জেল জরিমানার আওতায় আনা সরকারের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ।
৪. অবৈধ পার্র্কিং ঃ সড়কে বিশৃংখলা ও যানযটের অন্যতম কারণ যত্রতত্র অবৈধ গাড়ি পার্কিং। এসব অবৈধ পার্কিং বন্ধে নতুন সড়ক পরিবহন আইনে জেল জরিমানার বিধান থাকলেও আইন কার্যকরের গত এক মাসেও দেশ ব্যাপী বৈধ পার্কিং প্লেজ নির্ধারণ করা হয়নি।এক্ষেত্রেও অবকাঠামো গড়ে তোলার আগে আইন প্রয়োগ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়াঁবে।
৫. সড়কে চাদাঁবাজি ঃ দেশের সড়ক মহাসড়ক থেকে দৈনিক প্রায় ২ কোটি টাকার বেশী চাদাঁবাজি হয়। এই চাদাঁবাজির সাথে যারা জড়িত তারা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করে এই সেক্টরে অনিয়ম ও নৈরাজ্য চালিয়ে আসছে। তাদের গাড়িগুলো আইন কানুনের তোয়াক্কা করে না। এই অবৈধ অর্থ তথা সড়কে চাদাঁবাজি বন্ধ না হলে নতুন সড়ক আইন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
৬. মহাসড়কে সার্ভিস রোড না থাকা ঃ আমাদের জাতীয় বা আঞ্চলিক মহাসড়কে কোন সার্ভিস রোড নাই। মহাসড়ক গুলো গ্রামীন এলাকা এমনকি কোন কোন গ্রামের মাঝেও চলে গেছে। কোন কোন এলাকায় একটি মাত্র মহাসড়ক ছাড়া যাতায়াতের কোন মাধ্যম নাই। এইসব মহাসড়কে সার্ভিস রোড না থাকায় দুরপাল্লার ভারী যানবাহনের সাথে পাল্লা দিয়ে নসিমন করিমন, ইজিবাইক, মোটরসাইকেল, অটোরিকশা, ভটভটি প্রভৃতি যানবাহন চলে। ফলে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ছে। প্রতিটি জাতীয় মহাসড়কে সার্ভিস রোড নির্মাণ ব্যতিত এই আইন বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
৭. বিআরটিএর সক্ষমতা ঃ দেশে যানবাহনের সংখ্যা ৬০ লাখ তার মধ্যে বিআরটিএ নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৪৭ লাখ। অনিবন্ধিত, ভুয়া নাম্বারধারী, নসিমন করিমন প্রায় ১৩ লাখের মত। ৭০ লাখ চালকের মধ্যে লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা ২১ লাখ। অথচ বিআরটিএর জনবল মাত্র ৭০০ জন। সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নের প্রধানতম দায়িত্ব প্রাপ্ত এই প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্বির পাশাপাশি জনবল বৃদ্ধি করা এবং জন ভোগান্তি লাঘবে উপায় খুজেঁ বের করার মত একটি টেকনিক্যাল গ্রæপ গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবী।
৮. বড় অঙ্কের জেল জরিমানা বনাম দুর্নীতি ঃ নতুন আইনে জেল জরিমানা বৃদ্ধি করা হয়েছে। আইনে কোন কোন অপরাধের দায়ে ৩ থেকে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা রয়েছে। বিপরীতে আমরা লক্ষ্য করি যেসব সার্জেন্ট এইসব অপরাধ লংঘনের বিপরীতে প্রসিকিউশন পড়বে তাদের দুর্নীতি মুক্ত করা জন্য সিসি ক্যামরা পদ্ধতিতে প্রসিকিউশন চালু না করলে দুর্নীতি বৃদ্ধি পাবে। আইনের মূল উদ্দেশ্য ব্যহত হবে। এই কারনে আইনের অপপ্রয়োগের স¤ভাবনা থেকেই যায়।ফলে এই আইন বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।
৯. নিবন্ধনবিহীন গাড়ি ঃ ছোট যানবাহন বিশেষ করে অটোরিকশা ও অটোটেম্পো অবাধে আমদানি করা হচ্ছে। কিন্তু বিআরটিএ কর্তৃক নিবন্ধন বন্ধ রাখায় সারা দেশে এইসব গাড়িগুলো পুলিশ বা বিভিন্ন ব্যক্তি বা সমিতিকে চাদাঁ দিয়ে অবৈধ উপায়ে চালাচ্ছে। এইসব যানবাহন নিবন্ধন দিলে বৈধতার পাশাপাশি সরকারও কোটি কোটি টাকার রাজস্ব পায়। এইসব দুরদর্শী সিদ্বান্ত সমূহ দ্রæত বাস্তবায়ন করা না গেলে এই আইন বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।

সর্বোপরি আমরা উদে¦গের সাথে লক্ষ্য করছি যে, আইন কার্যকরের পর থেকে সচেতনতা কার্যক্রমের নামে প্রথমে এক সপ্তাহ, পরবর্তী সময়ে আরো এক সপ্তাহ সময় বৃদ্ধি করা হয়। বর্তমানে প্রায় মাস ব্যাপী সচেতনতা কার্যক্রমের নামে প্রসিকিউশন বন্ধ রাখায় আইন কার্যকরের সময়কালে সড়কে কিছুটা শৃংখলা দেখা গেলেও বর্তমানে বিশৃংখলা আগের মতোই ফিরে এসেছে। আইনের সাথে সংগতিপূর্ণ বিধি প্রণয়ন করা না হলে আইনের অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। তাই জরুরী ভিত্তিতে বিধি প্রণয়নের দাবি জানাচ্ছি। পাশাপাশি আইনের সঠিকতম প্রয়োগ নিশ্চিত করা না গেলে এই বিশৃংখলা থেকে বেড়িয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়বে।
উক্ত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন – ডিটিসিএ’র সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সালেহ উদ্দিন, বিশিষ্ট সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, আন্তঃজেলা মালামাল পরিবহন সংস্থা ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাফর চৌধুরী, এফবিসিসিআই’র পরিচালক ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ আবদুল হক, সিপিবি কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, নাগরিক সংহতির সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য শরীফুজ্জামান শরীফ, ড্রাইভার্স ট্রেনিং সেন্টার’র চেয়ারম্যান নুর নবী শিমু, নেমস মোটরস লিঃ’র জিএম নুর উদ্দিন জাহাঙ্গীর, ড্রাইভার ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান বাদল আহমেদ, সাংবাদিক সিরাজুম মুনিরা নীরা, যাত্রী কল্যাণ সমিতি যুগ্ম-মহাসচিব এম. মনিরুল হক প্রমুখ।
আজকের সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সহ-সভাপতি তাওহিদুল হক লিটন।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply