২৬ এপ্রিল ২০২৪ / ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / দুপুর ২:২৯/ শুক্রবার
এপ্রিল ২৬, ২০২৪ ২:২৯ অপরাহ্ণ

মহৎ ভালোবাসা

     

রোমানের সাথে আমার পরিচয় মাত্র কয়েক মাসের। কয়েক মাস হল সে এলাকায় নতুন এসেছে। সবসময় তার ঠোটে এক চিলতে হাসি লেগে থাকত। তাকে কখনও বিষন্ন এবং হতাশ হতে দেখিনি।

 

মানুষকে কাছে টেনে নেওয়ার এক অদ্ভূত সম্মোহনী শক্তি ছিল রোমানের। তাই খুব অল্পসময়ে তার সাথে আমার ভাল একটা সম্পর্ক গড়ে উঠে। সে গল্পের বই পড়তে ভালবাসত আর ভালবাসত কবিতা লেখতে। সে ভালবাসত নজরুল এবং জীবনানন্দ দাশকে। তার কাছে ছিল প্রচুর রুশ উপন্যাসের সমগ্র। তার গানের গলাও ছিল চমৎকার। আমিও মাঝেমাঝে কবিতা লেখার চেষ্টা করতাম। দু’জন প্রতিদিন কে কি কবিতা লেখতাম একজন আরেকজনকে শেয়ার করতাম।

 

এভাবে চলতে লাগল দিনগুলো। এর মধ্যে আমার অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা শুরু হল। তাই কিছুদিন ওর সাথে বেশি মিশতে পারিনি। তবে প্রতিদিনই আমাদের কিছু সময়ের জন্য হলেও দেখা হত এবং অল্প কথা হত। আমার পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর আমি আমার গ্রামের বাড়িতে চলে যাই। তবে প্রতিদিনই ফোনে ওর সাথে আমার কথা হত।

হঠাৎ একদিন ও আমাকে ফোন করে কাঁদতে লাগল। আমি কান্নার কারন জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু সে কোন ভাবেই তার কান্নার কারন বলল না। বলল তুমি বাড়ি থেকে এসো দেখা হলে সরাসরি বলব। ইচ্ছে ছিল বাড়িতে অনেক দিন থাকার। কিন্তু রোমানের সাথে দেখা করার জন্য বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসলাম। এসে সরাসরি তার সাথে দেখা করলাম। দেখলাম এই কয়েকদিনে সে অনেকটা শুকিয়ে গেছে এবং তার চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে তোমার? সে কোন কথা বলল না। আমার হাতটা ধরে সে আমাকে তাদের বাসার ছাদে নিয়ে তার কষ্টের কথা বলা শুরু করল।

আমার আর চৈতির পরিচয় একটা বিয়ের গায়ে হলুদের অনুষ্টানে। চৈতি আমার গান শুনে আমার সাথে পরিচিত হয় এবং আমার সেল নাম্বার টা নেয়। তারপর থেকে তার সাথে প্রতিদিনই আমার কথা হতে লাগল এবং মাঝে মাঝে দেখাও হত। এভাবে তার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়তে লাগল। যে কোন ব্যাপারে সে ছিল আন্তরিক। তার এ আন্তরিকতা আমাকে মুগ্ধ করত। এক পর্যায়ে আমি তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ি। কিন্তু বন্ধুত্ব হারানোর ভয়ে তাকে প্রপোজ করার সাহস পেতাম না। এভাবে হাসি কান্না এবং আনন্দের মধ্যে দিন গুলো পার হচ্ছিল। আর তার প্রতি আমার ইমোশন এর মাত্রাটা বেড়ে যাচ্ছিল।

হঠাৎ একদিন রাতে সে কল করে বলতে লাগল দুই সপ্তাহ পর ওর বিয়ে এবং বিয়ের সব কাজ আমাকেই করতে হবে। আরও বলল ওর হবু বর বিরাট ব্যাবসায়ী এবং দেখতেও খুব ‍সুন্দর। এসব কথা ‍শুনে আমি খুব হতাশ এবং বিমর্ষ হয়ে পড়ি। খুব বলতে ইচ্ছে করছিল আমি যে তাকে ভালোবাসি সে কথাটা। কিন্তু অদৃশ্য এক কারনে বলতে পারলাম না। আমি আর কথা না বাড়িয়ে ফোনটা অফ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। একটুও ঘুম হয়নি সে রাতে।

চৈতির বিয়ে কথা শুনে আমার মন ভেঙ্গে গেয়েছিল। তাই আমি সিন্ধান্ত নিয়েছিলাম চৈতির বিয়ের আগ পর্যন্ত তার সাথে কোনোরকম যোগাযোগ রাখব না। তাই আমি শহরের বাসা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে গেলাম দুই সপ্তাহের জন্য এবং মোবাইল অফ করে দিলাম। দুই সপ্তাহ পর ভাঙ্গামন নিয়ে আমি বাড়ি থেকে শহরে ফিরে মোবাইলটা অন করলাম। কিছুক্ষন পর চৈতির নাম্বার থেকে কল এলো। আমি রিসিভ না করে কেটে দিলাম। আবারও সে কল করল। আবারও আমি কেটে দিলাম। এভাবে কয়েকবার লাইন কেটে দেয়ার পর অনিচ্ছাসত্ত্বেও চৈতির কল রিসিভ করলাম। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে চৈতির উত্তেজিত কন্ঠে প্রশ্ন করতে লাগল। তুমি এতোদিন কোথায় ছিলে? মোবাইল অফ ছিল কেন? কেন তুমি এতোক্ষন ধরে কল রিসিভ করছো না? বলো, বলো, বলো?

আমি হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ি। তাই গ্রামের বাড়ি ফেনীতে চলে যাই। আমি মিথ্যা কথা বললাম তাকে।

তুমি গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ার সময় তো আমাকে একটু জানাতে পারতে? আমি এই কয়দিন তোমাকে খুজতে খুজতে হয়রান। চৈতি অভিমান কন্ঠে বলল।

কেন খুজছিলে আমাকে? তোমার হ্যান্ডসাম হাজব্যান্ডের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য নাকি? আমি ব্যঙ্গঁ করে বললাম। আমার কথা শুনে চৈতি চুপ করে ছিল। একটু পর বলল, সেদিন আমি তোমার সাথে মিথ্যা বলেছিলাম। তখন আমার বিয়ে ঠিক হয়নি। তবে এখন সত্যি সত্যি আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। দুইদিন পর আমার বিয়ে। একটু থেমে সে আরো বলল। তোমার সাথে আমার জরুরী কথা আছে। আমি এখনই তোমার বাসায় আসছি।

ঘন্টাখানেক পর চৈতি আমার বাসায় এসে হাজির হলো। তার হাতে ছিল ছোট একটা ব্যাগ। তাকে চেনা-ই যাচ্ছিল না। চোখ দুইটা ভেতরের দিকে ঢুকে গেছে। অনেকটা শুকিয়ে গেছে এবং কিছুটা কালো ও হয়ে গেছে। সে খাটে আমার পাশে বসতে বসতে বলল। রোমান তোমাকে তো চেনা-ই যাচ্ছেনা। এ কয়েদিনে তুমি অনেক শুকিয়ে গেছো।

আমি বলালম, তুমিও তো অনেক শুকিয়ে গেছো। কিভাবে এতো শুকিয়ে গেলে তুমি?

তোমার জন্য।

আমার জন্য?

হ্যাঁ, তোমার জন্য।

চৈতির কথা শুনে আমি তার দিকে তাকালাম। তার চোখের কোন বেয়ে পানি ঝরছিল। ইচ্ছা করছিল তার চোখের পানি মুছে দিই। কিন্তু সাহস হয়নি। গলায় কিছুটা জোর এনে বললাম, চৈতি তোমার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। কি জরুরী কথা বলার জন্য তুমি এখানে এসেছ সেটা বলো।

রোমান, দুই সপ্তাহ আগে আমি তোমাকে জানিয়েছিলাম আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সেটা মিথ্যা ছিল। আমি দেখতে চেয়েছিলাম আমার বিয়ের কথা শুনে তুমি কিরকম প্রতিক্রিয়া দেখাও। কারন, আমি জানতাম তুমি আমাকে ভালোবাস। কিন্তু তুমি তা প্রকাশ করতে পারতে না।

আমার বিয়ের কথা শুনার পর তুমি যে কষ্ট পেয়েছিলে সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম ওদিন মোবাইলে তোমার কন্ঠ শুনে। আমি সিন্ধান্ত নিয়েছিলাম পরেরদিন তোমাকে সত্যটা জানাব আর জানাব তোমাকে যে আমি ভালোবাসি সেটা। কোনোটা তোমাকে জানানো সম্ভব হয়নি। কারন, যেদিন জানাব সেদিন থেকে তোমার মোবাইল বন্ধ ছিল।

চৈতির কথা শুনে আমার র্হাটবিট বেড়ে গেল। আমি তার হাত দুটি আমার হাতের মুঠোই নিয়ে বললাম, তুমি যে আমাকে ভালোবাস সেটা এতোদিন আমাকে কেন বলোনি? আমি কতবার আমার ভালোবাসা প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু ভয়ে পারিনি। ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে যদি তোমার বন্ধুত্ব হারিয়ে ফেলি সে ভয়ে তোমাকে আমার ভালোবাসার কথা বলিনি। আসলে আমি চাইনি তোমাকে হারিয়ে ফেলতে। চৈতি, যখন তোমার বিয়ের

যখন তোমার বিয়ের কথা শুনলাম তখন আমার মনে হয়েছিল কেউ যেন ছুরি দিয়ে আমার হৃদয়টা কেটে ফেলল। তোমাকে হারানোর কথা ভাবতে গিয়ে আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। তাই কাউকে না জানিয়ে আমি গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম।

আমার কথা শেষ হবার পর চৈতি আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, জানি রোমান। আমাকে তুমি অনেক ভালোবাস। তাই তো আমি তোমার কাছে চলে এসছি।

 

চৈতির কথা শুনে আমি আৎকে উঠলাম। তার হাত দুটা ছেড়ে দিয়ে প্রশ্ন করলাম, তুমি আমার কাছে চলে এসেছ? তুমি না বলেছ দুইদিন পর তোমার বিয়ে? হ্যাঁ দুইদিন পর আমার বিয়ে। যেদিন তোমার সাথে মিথ্যা বলেছিলাম তার চারদিন পর আমেরিকা প্রবাসি একজন ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়। আমার সম্মতিতেই আমার আব্বা-আম্মা আমার বিয়ে ঠিক করে। তোমার ওপর অভিমান করেই আমি এই বিয়েতে রাজি হই। চৈতি একনাগাড়ে কথা গুলো বলল।

আমার ওপর অভিমান করে তুমি এই বিয়েতে রাজি হয়েছ? আমি অবাক বিশ্ময়ে প্রশ্ন করলাম।

 

আমি ভেবেছিলাম, আমার বিয়ের কথা শুনে তুমি চিৎকার করে বলবে, চৈতি আমি তোমাকে ভালবাসি। তুমি অন্যকারো হতে পারো না। আমি তোমাকে অন্যকারো হতে দেব না। কিন্তু তুমি করলে উল্টোটা। তুমি আমার বিয়ের কথা শুনে কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখাওনি। বরং এরপর থেকে মোবাইলটা অফ করে দিয়েছ আর কাউকে না জানিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছ। তোমার কোনো সাড়া না পেয়ে আমি ভাবতে বাধ্য হলাম তুমি আমাকে ভালোবাস না। তাই তোমার ওপর অবিমান করে এই বিয়েতে রাজি হয়ে যাই। কিন্তু বিয়ের সময় যতই ঘনিয়ে আসতে লাগল ততই তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা তীব্র হচ্ছিল। আমার জীবন সঙ্গি হিসাবে তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে কল্পনা করতে পারছিলাম না। তাই তো আজ তোমার কাছে ছোটে এসেছি। কথা গুলো বলে চৈতি আমার বুকে ঝাপিয়ে পড়ল।

আমি তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললাম, চৈতি তুমি তো জানো আমি এখনো ছাত্র। দু’টা টিউশনি করে কোনো রকম চিটাগাং শহরে টিকে আছি। তোমাকে বিয়ে করে খাবাবো কি? রাখবো বা কোথায়? চৈতি, তার হাতের ব্যাগটা দেখিয়ে বলল, এখানে সাড়ে তিন লাখ টাকা আছে। আমার বাবা আমার অ্যাকাউন্টে রেখেছিল। এখানে আসার সময় ব্যাংক থেকে তুললাম। আর আমার হাতে গলায় যে স্বর্নের গহনা আছে যে গুলোর দাম কম হলেও দুই লাখের ওপরে হবে। এই গুলো দিয়েই তুমি ছোট খাটো একটা ব্যবসা করবে। এতে আমাদের দুই জনের ছোট্ট সংসারটা ভালোভাবে চলবে।

চৈতির কথা শেষ হতেই আমি কাঁপা কাঁপা গলা কন্ঠে বললাম। চৈতি, দুইদিন পর যে বিয়েটা হচ্ছে সেটা তোমার সম্মতিতেই হচ্ছে। এই বিয়ে করতে তোমার মা-বাবা তোমাকে বাধ্য করেনি। তুমি যদি এখন এই বিয়েটা না কর তাহলে তোমার মা-বাবা কষ্ট পাবে। তারা সমাজে অপমানিত হবে। আত্মীয় স্বজনদের মুখ দেখাতে পারবে না। তুমি কি চাও তোমার মা-বাবা তোমার জন্য অপমানিত হোক? চৈতি, মনে রেখ আমি তোমাকে যতটুকু ভালোবাসি তার চেয়ে অনেক বেশি তোমাকে ভালোবাসে তোমার মা-বাবা। পৃথিবীতে মা-বাবার ভালোবাসার চেয়ে আর কারো ভালোবাসা বড় হতে পারে না। প্রতিটি সন্তানের উচিত বাবা মাকে খুশি করা। তোমারই উচিত হবে তোমার মা-বাবার কাছে ফিরে যাওয়া।

আমার কথা শুনে চৈতি কান্নায় ভৈঙ্গে পড়ল। সে কিছুতেই আমাকে ছেড়ে যেতে চাচ্ছিল না। অনেক বুঝিয়ে তাকে তার মা-বাবার কাছে ফেরত পাছিয়েদিলাম আমি। এর দুইদিন পর তার বিয়ে হয়ে যায়।

রোমান তার কথা শেষ করে পকেট থেকে টিস্যু পেপার বের করে চোখ মুছতে লাগল। আমি তার কাঁধে হাত রেখে বললাম। তুমি সত্যিই মহৎ একজন মানুষ। তোমার বন্ধু হতে পেরে আমি গর্ববোধ করছি। আমার কথা শেষ হতেই রোমান আমাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো হুহু করে কাঁদতে লাগল আর বলতে লাগল। আমি এতো মহৎনা হলেই ভালো হতো। চৈতিকে হারাতে হতো না।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply