১৭ মে ২০২৪ / ৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / রাত ১:২৮/ শুক্রবার
মে ১৭, ২০২৪ ১:২৮ পূর্বাহ্ণ

২৯০তম জন্মদিবসে শ্রদ্ধা নিবেদন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইতিহাসের এক ভাগ্যাহত বীর ও দেশপ্রেমিক

     

সোহেল মো. ফখরুদ-দীন

বাংলা বিহার উডিষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব-নবাব সিরাজউদ্দৌলার ২৯০ তম জন্মবার্ষিকী ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭। ২৯০তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করছি। তাঁর কর্মজীবন বর্তমান প্রজন্ম, দেশপ্রেমিক ও দেশবাসীকে জানানোর লক্ষ্যে এই প্রবন্ধ। তাঁর জীবনকর্ম পাঠে প্রতিনিয়ত মানুষ দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত হবে। সে ক্ষেত্রে আমরা অনেকটা পিছিয়ে আছি। নবাব সিরাজউদ্দৌলার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী যথাযথ ভাবে পালিত হয় না। পালিত হয় না ২৩জুন ঐতিহাসিক পলাশী দিবসও। এপার বাংলা ওপার বাংলায় তেমন কোন বড় সংগঠন নবাবের জীবন কর্মের উপর আলোচনা, সেমিনার করেছেন তেমনভাবে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশও হয় না। এটি আমাদের জন্য দুঃখজনক। আমাদের প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ব করতে নবাব সিরাজউদ্দৌলার জীবনকর্ম ও পলাশী যুদ্ধের ইতিহাস সঠিক ভাবে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা জরুরী। কারণ এখনও দেশ ও জাতির উন্নয়নকে বাধাগ্রস্থ করতে নব্য মীরজাফররা উৎপেতে আছে। তাদের থেকে সাবধান হতে হবে। চিহ্নিত করতে হবে মীরজাফরদেরকে। নবাব সিরাজউদ্দৌলার ২৯০তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে এবারই প্রথমবারের মতো ঐতিহাসিক চট্টগ্রাম সম্মিলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে চট্টগ্রামে। সম্মিলনের আয়োজন করছেন যৌথভাবে চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র ও বাংলাদেশ সমাজ উন্নয়ন ও তমদ্দুনী সাহিত্য মজলিশ। ১৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস (পার্ট-২, জিয়া অডিটরিয়াম)-এ এই সম্মিলন অনুষ্ঠিত হবে। সম্মিলনের উদ্বোধন করবেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার নবম বংশধর নবাজাদা আলী আব্বাসউদ্দৌলা। আজ থেকে ২৬০ বছর আগে ২৩ জুন পলাশীর আ¤্রকাননে ইংরেজদের সঙ্গে এক যুদ্ধে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার স্বাধীন শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা ঘাতকের হাতে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে অস্তমিত হয় বাংলার স্বাধীনতার শেষ সূর্য। ফলে প্রায় ২০০ বছরের জন্য বাংলা স্বাধীনতা হারায়। পরাজয়ের পর নবাবের বেদনাদায়ক মৃত্যু হলেও উপমহাদেশের মানুষ নবাবকে আজও শ্রদ্ধা ও সম্মানের সহিত মর্যাদা দিয়ে আসছেন। প্রতি বছর সেই জন্য ২৩ জুন পলাশী দিবস হিসাবে পালিত হয়। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব আলিবর্দী খাঁ মৃত্যুর আগে দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলাকে নবাবের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী করে যান। নবাব আলিবর্দী খাঁর মৃত্যুর পর ১৭৫৬ সালের এপ্রিল মাসে সিরাজউদ্দৌলা সিংহাসনে বসেন। নবাবের খালা ঘষেটি বেগম ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলান। সেনাপতি মীরজাফর আলি খান, ধনকুবের জগৎশেঠ, রাজা রায় দুর্লভ, উমিচাঁদ, ইয়ার লতিফ প্রমুখ ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন। ধূর্ত ইংরেজরা সন্ধির চুক্তি ভঙ্গ করে চন্দননগরের ফরাসীদের দুর্গ দখল করে নেয়। এরপর ১৭৫৭ সালের ১৭ জুন কাইভ কাটোয়ায় অবস্থান নেয়। নবাব ২২ জুন ইংরেজদের আগেই পলাশী পৌঁছে শিবির স্থাপন করেন। ১৭৫৭ সালে ২৩ জুন সকাল ৮টায় যুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু প্রধান সেনাপতি মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাবের পরাজয় ঘটে। সেই সঙ্গে বাংলার স্বাধীন সূর্য অস্তমিত হয়। পলাশীর ষড়যন্ত্রে যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার শোচনীয় পরাজয় ঘটলেও ইংরেজরা ক্ষান্ত হয়নি সেদিন। এরপর তারা নবাবের চরিত্রে নানাভাবে কলঙ্কলেপন করতে থাকে, অন্ধকূপ হত্যা, লাম্পট্য ইত্যাদি। সিরাজউদ্দৌলার চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করে কলকাতায় একটা মনুমেন্ট তৈরি হয়েছিল। তার নাম ছিল “হলওয়েল মনুমেন্ট”। পরবর্তিতে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে, ৩রা জুলাই, ১৯৪০ এ “হলওয়েল মনুমেন্ট” অপসারণের জন্য সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ডাক দিলেন। বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানেরা এক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করে ইংরেজদের বাধা করে ঐ হলওয়ের মনুমেন্ট তুলে নিতে। পরবর্তীতে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর উদ্যোগে ২৩শে জুন প্রথম পলাশী দিবস উদযাপিত হয়েছিল কলকাতায়। সাথে ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং মওলানা আকরম খাঁ। এ ব্যাপারে কবি কাজী নজরুল ইসলাম একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছিলেন, ‘দৈনিক আজাদ’ এবং ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকায় ১৯৩৯ সালের জুনে। “বিবৃতিতে কবি কাজী নজরুলের আহ্বান ছিল, “মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর নেতৃত্বে কলিকাতায় সিরাজউদ্দৌলা স্মৃতি কমিটি উক্ত অনুষ্ঠানকে সাফলমন্ডিত করিবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করিতেছেন। কলিকাতা কমিটিকে সর্বপ্রকার সাহায্য প্রদান করিয়া আমাদের জাতীয় বীরের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করিবার জন্য আমি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের নিকট আবেদন জানাইতেছি। বিদেশীর বন্ধন-শৃঙ্খল হইতে মুক্তি লাভের জন্য আজ আমরা সংগ্রামে রত। সিরাজের জীবনস্মৃতি হইতে যেন আমরা অনুপ্রাণিত হই। ইহাই আমার প্রার্থনা”। এ প্রার্থনা বিফলে যায়নি। পলাশী দিবস প্রতি বছরই আসে। কখনো সরবে, কখনো নীরবে। জাতীয় বীর সিরাজউদ্দৌলাকে স্মরণ করে অনুপ্রাণিত হয়, ব্যথিত হয়। একথা সথ্য, নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইতিহাসের এক ভাগ্যাহত বীর, ও দেশপ্রেমিক। নবাব সিরাজউদ্দৌলার সংক্ষিপ্ত জীবনী নবাবের নবম বংশধর সৈয়দ গোলাম আব্বাস আরেব লিখেছেন, “নবাব সিরাজউদ্দৌলার মাতামহ আলিবর্দী খাঁ এসেছিলেন ইরান থেকে। ১৬৭৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তার জন্ম হয়েছিল ইরানে। মৃত্যু হয় ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল বাংলায়। তাঁর প্রাণপ্রিয় নাতি সিরাজউদ্দৌলা জন্মেছিলেন ১৭২৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর বাংলার রাজমহলে। তিনি শহীদ হয়েছিলেন ২ জুলাই ১৭৫৭ সালে, জন্মভূমি বাংলায়। লুৎফুন্নেসা বেগম ছিলেন নবাব সিরাজের প্রিয়তমা স্ত্রী। তিনিও জন্মেছিলেন এই বাংলায়, ৭৩৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। প্রিয় স্বামীর শোকে তার মৃত্যু হয় ১৭৮৬ সালের ১০ নভেম্বরে। নবাব আলিবর্দী, সিরাজউদ্দৌলা ও লুৎফুন্নেসার জন্মের তারিখ ও মাস একই অর্থাৎ ১৯ সেপ্টেম্বর। নবাব আলিবর্দী খাঁ বাংলার নবাব হন ১৭৪০ সালে, তখন তার বয়স ছিল ৬৬, তিনি দীর্ঘ ১৬ বছর শাসন কার্য পরিচালনা করেন। নবাব আলিবর্দী খাঁর মৃত্যুর পর ১৭৫৬ সালে বাংলার মসনদে বসেন তার নাতি সিরাজউদ্দৌলা। শাসনকাল এক বছর হলেও তিনি ভারত তথা বিশ্বের ইতিহাসে খ্যাত হয়ে রইলেন। এই তিনজন ছিলেন একে অন্যের প্রাণপ্রিয়, তাদের ভালোবাসা ছিল হৃদয়ের বন্ধনে। মুর্শিদাবাদ থেকে সামান্য দক্ষিণে ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে প্রাচীরবেষ্টিত সমাধি ভবনে চিরনিদ্রায় শায়িত বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলা। পাশে তার প্রিয়তমা স্ত্রী লুৎফুন্নেসা, আলিবর্দী খানের কবরও একই সমাধি ভবনে। আজো ভাগীরথীর পানি ক্ল ক্ল শব্দে বয়ে যায় সমাধি ভবনের পাশ দিয়ে। ঐহিতাসিক এই সমাধি দেখতে ভ্রমণকারীরা হতভাগ্য সিরাজের করুণ পরিণতির কথা ভেবে এখনো ফেলেন চোখের পানি। সিরাজউদ্দৌলার ইতিহাস আমাদের জাতীয় ইতিহাস। এ ইতিহাস নতুন প্রজন্মের শিক্ষা নেওয়ার ইতিহাস। এ শিক্ষা প্রিয়জনের প্রতি ভালোবাসা, দেশের প্রতি ভালোবাসা, দেশি-বিদেশি দুষ্ট শক্তির চক্রান্তের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ানোর শিক্ষা। নবাব সিরাজউদ্দৌলার ২৯০ তম জন্মবার্ষিকী এই প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম সম্মিলনের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের নবাব সিরাজউদ্দৌলার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য আন্দরকিল্লা সিটি কর্পোরেশনের বিপরীত সড়কটি চকবাজার পর্যন্ত নবাব সিরাজউদ্দৌলা সড়ক নামকরণের মাধ্যমে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করে। চট্টগ্রামের কয়েকটি জায়গায় নবাব সিরাজউদ্দৌলার কর্মকাণ্ডকে ধরে রেখে এখনো অনেক প্রবীণ ও বর্ষীয়ান নাগরিকবৃন্দ তাঁর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী এবং ঐতিহাসিক ২৩ জুন পালন করেন। নবাবের ২৯০তম জন্মদিবসে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

 

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply