দুর্নীতির দুই মামলায় দণ্ডিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার আপিল করে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ আটকে গেছে হাই কোর্টের এক আদেশে। হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ মঙ্গলবার বলেছে, সংবিধানের ৬৬ (২) (ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কারও দুই বছরের বেশি সাজা বা দণ্ড হলে সেই দণ্ড বা সাজার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না, যতক্ষণ না আপিলে ওই দণ্ড বাতিল বা স্থগিত হয়।
দুর্নীতির দায়ে বিচারকি আদালতের দেওয়া দণ্ড ও সাজা (কনভিকশন অ্যান্ড সেন্টেন্স) স্থগিত চেয়ে বিএনপির পাঁচ নেতার করা আবেদন খারিজের আদেশের সঙ্গে হাই কোর্টের এই পর্যবেক্ষণ আসে।
জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১০ বছর এবং জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ৭ বছরের দণ্ড নিয়ে গত ফেব্রুয়ারি থেকে কারাগারে আছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
সংবিধানের ৬৬ (২) (ঘ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কেউ অন্যুন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে মুক্তির পর পাঁচ বছর পর্যন্ত তিনি সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য বিবেচিত হবেন না।
বিএনপি নেতারা আশা করছিলেন, বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে এবং উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে অতীতে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার নজির থাকায় খালেদাও একইভাবে আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। ফেনী ও বগুড়ার তিনটি আসন থেকে তাকে ধানের শীষের মনোনয়নও দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু মঙ্গলবার হাই কোর্টের আদেশের ফলে খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ আর থাকছে না বলে জানিয়েছেন দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।
তিনি বলেছেন, “সম্পূর্ণ খালাস পেলে অথবা দণ্ড বাতিল হয়ে গেলে, তখন উনি পারবেন। আজকের আদেশে এটা আরও স্পষ্ট হল।”
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম অবশ্য দাবি করেছেন, ওই দুই মামলায় আপিল করে খালাস পেলে বা সাজা বাতিল হলেও পাঁচ বছর তিনি সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।
অন্যদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হাই কোর্টের আদেশে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, এর পেছনে তারা সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছেন। এই রায় তারা মেনে নেবেন না।
সুপ্রিম কোর্ট
কী বলেছে হাই কোর্ট?নিম্ন আদালতে দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত বিএনপি নেতা আমান উলাহ আমান, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, ওয়াদুদ ভূঁইয়া, মো. মশিউর রহমান ও মো. আব্দুল ওহাবের পক্ষ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য হাই কোর্টে আপিল চলমান থাকা অবস্থায় তাদের দণ্ড বা সাজা স্থগিতের আবেদন করেছিলেন।
বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের হাই কোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার ওই আবেদন খারিজ করে দেয়।
আদেশের পর দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সাংবাদিকদের বলেন, “সংবিধানের ৬৬(২) এর (ঘ) ধারায় যে বিধান দেওয়া আছে, আদালত বলেছে সেটা সুপ্রিম ল অব দ্য কান্ট্রি। কাজেই ফৌজদারি কার্যবিধিতে কনভিকশন স্টে করার কোনো বিধান নাই। সাসপেন্ডের বিধান থাক আর না থাক, সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে প্রাধান্য পাবে।
“সুতরাং অনুচ্ছেদ ৬৬(২) এর (ঘ) অনুযায়ী উনারা নির্বাচন করার যোগ্য নন এবং দণ্ড স্থগিত চাওয়ার কোনো এখতিয়ার রাখেন না। এ কারণে উনাদের দরখাস্ত খারিজ করে দিয়েছে।”
খুরশীদ আলম খান বলেন, আদালত আরও কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছে, যা মূল রায় পেলে বিস্তারিত জানা যাবে।
“দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে সংসদ নির্বাচনে অ্যাটেন্ড করা এবং ক্ষমতায় যাওয়া- আদালত এগুলো ডিসকারেজ করেছে। বলেছে, দুর্নীতি এমন একটা ব্যপার যে, এ বিষয়ে আমাদের সবার সজাগ থাকা উচিৎ। কাজেই কনভিকশন মাথায় নিয়ে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া সংবিধানের মূল স্পিরিটের পরিপন্থি। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪২৬ ধারায় যাই থাকুক না কেন, সংবিধান সবার উপরে প্রযোজ্য।”
এক প্রশ্নের জবাবে খুরশীদ আলম বলেন, “এখন পর্যন্ত হাই কোর্ট বিভাগ যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এটা নির্বাচন কমিশনের জন্য বাইন্ডিং। আজকে যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে তার বাইরে যাওয়ার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের আইনে নেই।”
অন্যদিকে আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী ব্যারিস্টার খায়রুল আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, হাই কোর্টে সাজা ও দণ্ড স্থগিতের আবেদন করার উদ্দেশ্য ছিল, যাতে তাদের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন।
“আদালত বলেছে, দুটি গ্রাউন্ডে এ আবেদন ‘বিবেচনার যোগ্য নয়’। একটি হল, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪২৬ ধারা অনুযায়ী সেনটেনস (সাজা) স্থগিত করা যায়, কিন্তু কিনভিকশন (দোষী সাব্যস্ত করা) স্থগিত করা যায় না। দ্বিতীয় গ্রাউন্ড হল- সংবিধানের ৬৬ (২) (ঘ) অনুচ্ছেদে বলা আছে, সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি নির্বাচন করতে পারবে না।
“কিন্তু এর আগেও আমরা ভারতসহ বিভিন্ন দেশের নজির দেখিয়েছি। যেখানে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এ আদেশের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল দায়ের করা হবে।”
সাবেক প্রতিমন্ত্রী আমান উল্লাহ আমানের পক্ষে হাই কোর্টে শুনানি করেন আইনজীবী জাহিদুল ইসলাম। এ জেড এম জাহিদ হোসেনের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, আহসানুল করীম ও খায়রুল আলম চৌধুরী ।
ওয়াদুদ ভুঁইয়া ও আব্দুল ওহাবের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক, ও ব্যারিস্টার একেএম ফখরুল ইসলাম। মশিউর রহমানের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার আমিনুল হক ও ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক।
অন্যদিকে দুদকের পক্ষে মো. খুরশীদ আলম খান এবং রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক আদালতে ছিলেন।
যা বললেন অ্যাটর্নি জেনারেল
হাই কোর্টের আদেশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নিজের চেম্বারে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে তিনি (খালেদা জিয়া) যদি তার দণ্ড থেকে মুক্তিলাভ করেন বা তার সাজা যদি বাতিল হয়ে যায়, সেই ক্ষেত্রে বাতিলের তারিখ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।”
এই বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দিয়ে মাহবুবে আলম বলেন, “এখানে কন্ডিশন হল মূলত দুইটা। তিনি যদি দণ্ডিত হন, তাহলে পারবেন না। আর ইতোমধ্যে তিনি যদি তার দণ্ড থেকে মুক্তিলাভ করেন বা তার সাজা যদি বাতিল হয়ে যায়, সেই ক্ষেত্রে বাতিলের তারিখ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত তিনি পারবেন না।”
“মানে দুটো প্রতিবন্ধকতা তার (খালেদা জিয়ার) আছে। এটা সাংবিধানিক প্রতিবন্ধকতা। কাজেই যে কোনো আদালত রায় দিয়ে এই সাংবিধানিক প্রতিবন্ধকতা ওভারকাম করতে পারেন না বা এটাকে অগ্রাহ্য করতে পারেন না।”
কিন্তু বিচারিক আদালতে ১৩ বছরের সাজা হওয়ার পরও আপিল করে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। আর দুর্নীতির দায়ে তিন বছরের কারাদণ্ড হওয়ার পরও হাই কোর্টে আপিল করে আওয়ামী লীগের সংসদ আবদুর রহমান বদি তার পদে বহাল ছিলেন।
মায়ার আপিলের শুনানি করে হাই কোর্ট গত অক্টোবরে তাকে খালাস দেয়। সেক্ষেত্রে তিনিও কি ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অযোগ্য হবেন?
সাংবাদিকদের এ প্রশ্নে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “সেটা উনি যদি ফাইল করেন এবং ওইখানে যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, তারা যদি প্রশ্ন উত্থাপন করেন…। এটা আমার বক্তব্য এবং এর আগে এভাবে কেন বলা হয়নি আমি জানি না।”
তাহলে আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন খান আলমগীর ও মোফাজ্জল চৌধুরী মায়া দণ্ডিত হওয়ার পরও কী করে নির্বাচন করলেন এবং মন্ত্রী পদে দায়িত্ব পালন করলেন, এইচ এম এরশাদ কারাগারে থেকে ভোট করেও কীভাবে নির্বাচিত হলেন- সেই প্রশ্ন অ্যাটর্নি জেনারেলের সামনে রাখেন সাংবাদিকরা।
জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, “এরশাদের বিষয়ে তো আমাদের সুপ্রিম কোর্টেরই রায় আছে। তার যে পদ সেটা খারিজ হয়ে গিয়েছিল। আর মহিউদ্দিন খান আলমগীর বা মায়া এদের ব্যাপারে সেই সময় এই সাবমিশনগুলো রাখা হয়েছিল কিনা, এটা আমি বলতে পারব না।”
তাহলে মহিউদ্দিন খান আলমগীর ও মায়ার বেলায় আদালতের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কিনা- এ প্রশ্নে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “এর ব্যাখ্যায় এখন আমি যাব না। আমার সামনে যে মামলাগুলো আছে এসব মামলায় আমার বক্তব্য হচ্ছে এটি।”
খালেদা জিয়া বা বিএনপির অন্য যে নেতারা দণ্ডিত, তাদের সেই দণ্ড যদি আপিল বিভাগ স্থগিত করে, তাহলে তারা নির্বাচন করতে পারেবেন কি না জানতে চাইলে মাহবুবে আলম বলেন, “আপিল বিভাগ কী করবে আমি বলতে পারি না। কিন্তু আমার সাবমিশন হলো সংবিধানের উপরে।”
আশা ছাড়ছেন না খালেদার আইনজীবী
খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কোনো সুযোগ অ্যাটর্নি জেনারেল না দেখলেও তার সঙ্গে একমত নন বিএনপি চেয়ারপারসনের অন্যতম আইনজীবী সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ বিষয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কমালের একটি জাজমেন্ট আছে। সেখানে তিনি বলেছেন, নির্বাচন হচ্ছে ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকার। নিম্ন আদালতে সাজা হলে এর বিরুদ্ধে যদি আপিল করা হয়, তাহলে সংবিধান মোতাবেক তাকে নির্বাচন থেকে দূরে রখা যাবে না।
“যে পর্যন্ত সাজাটা আপিল বিভাগ কর্তৃক কনফার্ম (চূড়ান্ত) না করা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আপিল ইজ দি কন্টিনিউয়েশন অব দ্য প্রসেস। সেই ক্ষেত্রে আমার মতে আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে কোনো বাধা নেই।”
তবে আপিল বিভাগকে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আদেশ দিতে হবে বলে মনে করেন এই আইনজীবী।
সেজন্য বিএনপির পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ আদালতে কোনো আবেদন করা হবে কিনা জানতে চাইলে জয়নুল বলেন, “আমরা তো বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে মনোনয়ন দাখিল করেছি। এখন নির্বাচন কশিন যদি তার নমিনেশন পেপার রিজেক্ট করে, তাহলে আমাদের আপিল বিভাগে যেতে হবে।” বিডিনিউজ থেকে