১৯ মার্চ ২০২৪ / ৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ / সকাল ৮:১৬/ মঙ্গলবার
মার্চ ১৯, ২০২৪ ৮:১৬ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামে ১২ সিন্ডিকেটের চোরাই তেলের কারবার : বছরে ৫শ কোটি টাকার ব্যবসার ভাগ পায় অনেকেই

     

   চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় তেলের ডিপুকে ঘিরে ১২ সিন্ডিকেট মিলে চোরাই তেলের অবৈধ কারবার চালাচ্ছে ।কর্ণফুলী নদীকে  কাজে লাগিয়ে  দুই পাড়ের প্রভাবশালী ১২টি সিন্ডিকেট বছরে প্রায় ৫শ কোটি টাকার চোরাই তেলের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। এই কারবারে জনপ্রতিনিধি, সরকার ও বিরোধী দলের পদ-পদবীদারী নেতা, দূর্নীতিবাজ প্রশাসনের চিহ্নিত কতিপয় লোকজনও রয়েছে।এই সিণ্ডিকেট বছরে ৫শত কোটি টাকার চোরাই তেল পাচার করে অর্থলোপাট করে চলছে দীর্ঘদিন ধরে।  নিষ্ঠাবান রাজনীতিবীদ ও সৎ প্রশাসনিক ব্যাক্তিদের তোয়াক্কা না করেই সমাজকে অস্হিতিশীল করে তুলছে এসব সিন্ডিকেটের লোকজন।এদেরই কারণে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি ও  ক্ষমতাসীন দলের সুনাম ক্ষুন্ন হলেও যাদের এসব বিষয়ে দেখার কথা তারা অনৈতিক লাভের লোভেই নিরব রয়েছে।

  সুত্রমতে, পতেঙ্গা গুপ্তখাল এলাকার দেশের তেল বিপণনকারী পদ্মা, মেঘনা, যমুনার প্রধান স্থাপনাগুলো থেকে চোরাই পথে তেল পাচার  করে এসব সিন্ডিকেটের লোকজন। এ ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের বহির্নোঙরে আসা বিদেশি জাহাজ, দেশীয় কার্গো ভ্যাসেল, ব্যক্তি মালিকানাধীন নৌকা, ফিশিং বোট থেকে তেল সংগ্রহ করে তেল কালো বাজারি সিন্ডিকেট।

জানা গেছে, জনৈক আলী  নামের ব্যাক্তি থেকে শুরু এই কারবার বর্তমানে ১২টি সিন্ডিকেটে  শতাধিক ব্যক্তি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত । কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে পতেঙ্গা থানাসহ  উত্তর পাড়ে নগরীর কর্ণফুলী, বাকলিয়া, কোতোয়ালী, সদরঘাট, বন্দর ও পশ্চিমে  ইপিজেড এলাকা ঘিরে চোরাই সিন্ডিকেটের তৎপরতা রয়েছে। পতেঙ্গা ও কর্ণফুলী এলাকার বেশীরভাগ লোক এসব সিন্ডিকেটে জড়িত।ইপিজেড থাকার জনৈক  সরকার দলীয় কমিশনার ও কর্ণফুলী থানার এক সাবেক শীর্ষনেতা এসব দুই নম্বরী ব্যবসার নিয়ন্ত্রয়ক । তার পরিবেশ দূষণকারী ইটের ভাটাও রয়েছে। এদের রয়েছে আরো দেশধ্বংশী কাজে সহযোগিতা করে মাসোহারা  গ্রহণের অভিযোগ।ওই কমিশনার করোনাকালে চানখালীমুখেও একটি ক্যাসিনো চালানোর উদ্দোগ নেয়।তার বিরুদ্ধে ইপিজেড গেইটে মন্দিরের পাশে বরিশালের লোকজন দিয়ে জুয়ার আসর চালানোর গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে।সম্প্রতি র‌্যাব এই আসর ভেঙ্গেও দিয়েছে।যদিও এই কাজে পুলিশের সক্রিয় ভুমিকা ছিল।জনৈক চাদাঁবাজ সোলতান এইসব দুইনম্বরী কাজ পরিচালনা করে থাকে।

জানা গেছে, চোরাই এসব তেল কেনাবেচার জন্য ব্যবহার করা হয় কর্ণফুলী নদীর ঘাটগুলো। এর মধ্যে ১১ নং মাতব্বর ঘাট, ১২ নং তিন টেইগ্যার ঘাট,  ১৩ নং ঘাট,  ১৪ নং কালু মাঝির ঘাট, ১৫ নং মেরিন একাডেমি ঘাট,  জুলধা ইউনিয়নের  চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের বাংলাবাজার ঘাট, অভয়মিত্র ঘাট, চরপাথরঘাটা পুরনো ব্রিজ ঘাট, চাক্তাই ঘাট, সদরঘাট ও ফিশারিঘাট অন্যতম।

স্থানীয় সূত্র জানায়,  কর্ণফুলী থানার জুলধা ইউনিয়নের তেল শুক্কুর হলো এই ব্যবসার মূল হোতা । কর্ণফুলী জুলধা ইউনিয়নের ৭ নং পাইপের গোড়া এলাকার আব্দুস শুক্কুর(৪২) যিনি ‘জলদস্যু’, ‘চোরাকারবারি’ এমন নানা নামে এলাকাবাসীর কাছে পরিচিত। পতেঙ্গা গুপ্তখাল ডিপোসহ বঙ্গোপসাগরের চোরাই তেলের বৃহৎ একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। তার পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা। স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর লোপাট করা হচ্ছে সরকারি তেল। আর এর মাধ্যমে বিপুল বিত্ত গড়ে তোলেন শুক্কুর। হালে চোরাই তেলের কারবার করেই সে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। রয়েছে তার কোটি টাকার বাড়িও। জানা যায়, যুবক বয়সে শুক্কুর মেষ চড়াতেন জুলধার হাশেম মেম্বারের। এক সময় তার পরিচয় হয় চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের জলদস্যু আবুল কালামের সঙ্গে। জাহাজের রশি কাটা দিয়ে ডাকাতিতে তার হাতে খড়ি হয় বলে জনশ্রুতি আছে।স্থানীয় পর্যায়ে প্রচলিত আছে, ২০০৫ সালের আগে সন্দ্বীপ চ্যানেলে ডাকাতি ও কর্ণফুলী নদীতে জলদস্যুতা করে শুক্কুর বনে যান নামকরা ডাকাত। এর পর থেকে তাকে অনেকে চেনে  ‘ডাকাত শুক্কুর’ ও ‘জলদস্যু ত্রাস শুক্কুর’ নামে। তার নামের পাশে নতুন বিশেষণ ‘চোরাকারবারি তেলচোর শুক্কুর’। এখন কর্ণফুলী নদীতে একচেটিয়া রাজত্ব তার।

শুক্কুরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় রয়েছে বহু মামলা, অভিযোগ ও জিডি। চট্টগ্রাম চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চাঁদাবাজি মামলা সিআর ৪৪/১৭, বন্দর থানার জিআর মামলা নং ২১৫৫/৯৬, পটিয়া থানায় ০১/৯৬, কর্ণফুলী থানার জিআর মামলা নং ১০/২০০২, স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল মামলা নং ১২২/আদেশ নং ১৫ ,কর্ণফুলী থানার মামলা নং ০১/২০০৯ ,বন্দর থানা মামলা নং ২২/৯৬।

এ ছাড়া হত্যা ও হুমকির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে ১৮ ডিসেম্বর করা কর্ণফুলি থানায় পিপিআর নং ১৬২৭, জিডি ও অভিযোগ ২২/৯৬, ১৭৮১/১৬, পতেঙ্গা থানার পিপিআর নং ২১৯৩, ২০১৭ সালের ৯ মার্চ পিপিআর নং ৩৬০/১৭। তার আপন ভাইও ২০১৬ সালে শুক্কুরের বিরুদ্ধে জিডি করেন কর্ণফুলী থানায়, পিপিআর নং ১৭৮১।

এ ছাড়া  পতেঙ্গার বার্মা ইউসূফ,  চর পাথরঘাটা ব্রিজঘাট এলাকার খোরশেদ, আলী,  শিকলবাহার নুরুচ্ছফা, রফিক, জাফর ইকবাল (মাটির নিচে ট্যাংক ডিপো রয়েছে), জিয়া, জসিম, মহিউদ্দিন, তৈয়ব, বেলাল, হোসেন, নতুন ব্রিজ এলাকার সিসা হারুন, বেনসন নাছির (বর্তমানে কারাগারে) আনছার হাজী (বর্তমানে কারাগারে), মাঝিরঘাট এলাকার আমির, কাদের ও বাংলাবাজারের রফিক। এর মধ্যে মাঝিরঘাট এলাকার আমির চোরাই ডিজেলের ব্যবসা করেন। মাঝিরঘাটের কাদের ও বাংলাবাজারের রফিক চোরাই অকটেন ব্যবসার সাথে জড়িত।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে,  কর্ণফুলী এলাকায় চোরাই ফার্নেস অয়েল মজুদ করার বেশ কয়েকটি চোরাই ডিপো রয়েছে। যেগুলোতে মাটির নিচে ট্যাংকারও রয়েছে। অন্যদিকে গুপ্তখাল থেকে পরিশোধিত ডিজেল ও অকটেন সরাসরি নৌকা করে মাঝিরঘাট, ব্রিজঘাট ও চাক্তাই এলাকার ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যায়।ওমর আলী মার্কেট, ফিশারীঘাটের আশ পাশ এলাকা, ভেড়া মার্কেট, রাজাখালী ব্রীজ দক্ষিণে ও অভয়মিত্র ঘাটে এসব চোরাই তেল দেদারছে পাওয়া যায়।এসব খুচরা ব্যবসায়ী সংশ্লিষ্ট থানা ও ফাঁড়ির ক্যাশিয়ার নামের লোকজন চাঁদা  দিয়ে থাকে।কর্ণফুলী ব্রীজ এলাকার সকল অবৈধ ব্যবসা ও চোরাই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে এস আই জামাল নামে জনৈক পুলিশ।ওই পুলিশের বিরুদ্ধে তার কর্মকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে বলে জানা গেছে।
জানা যায় গত কয়েক মাসে নগরীর চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ ও কর্ণফুলী থানা এলাকায় র‌্যাব-৭ অভিযান চালিয়ে ৫টি ট্যাংক লরি জব্দ করেছে। যেগুলোতে চোরাই ফার্নেস অয়েল বোঝাই হয়েছে কর্ণফুলী থানা এলাকা থেকে। সর্বশেষ ১৫ জুলাই কর্ণফুলী থানার শিকলবাহা এলাকা থেকে দুটি ট্যাংক লরি জব্দ করে র‌্যাব।
এর আগে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পাঁচলাইশ থানাধীন শুলকবহর এলাকা থেকে ৯ হাজার লিটার চোরাই ফার্নেস অয়েলসহ ট্যাংক লরি (নোয়াখালী-ঢ-৪১-০০৩০) জব্দ করে। ওইসময় চোরাই তেলের কারবারি কর্ণফুলী থানার চরপাথরঘাটা পূর্বপাড়া গ্রামের আবদুল মোনাফের ছেলে রিজুয়ানুল ইসলামকেও আটক করে র‌্যাব।
১৩ মার্চ চান্দগাঁও থানাধীন শাহ আমানত সেতু সংযোগ সড়ক এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৪ হাজার লিটার চোরাই তেলসহ ট্যাংক লরি (নারায়ণগঞ্জ-ঢ-৪১-০০৬৫) জব্দ করে র‌্যাব। ওই অভিযানে মহিউদ্দিন আলী নামের এক চোরাই তেল ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। একইভাবে ১৪ মে পাঁচলাইশ থানাধীন শুলকবহর এলাকা থেকে প্রায় ১২ হাজার লিটার ফার্নেস অয়েলসহ ট্যাংক লরি (নেত্রকোনা-ঢ-৪১-০০২৩) জব্দ করে। এসময় কর্ণফুলী থানাধীন শিকলবাহা এলাকার চোরাই তেল ব্যবসায়ী নাছির উদ্দিন প্রকাশ বেনসন নাছির ও হাজী মো. আনছার আহমদ প্রকাশ আনছার হাজীকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। র‌্যাবের হাতে জব্দ হওয়া পাঁচটি ট্যাংক লরিও বোঝাই হয় কর্ণফুলী থানা এলাকা থেকে।

 

 

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply