৩ মে ২০২৪ / ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ভোর ৫:৩২/ শুক্রবার
মে ৩, ২০২৪ ৫:৩২ পূর্বাহ্ণ

লামার এক গুণি শিক্ষক প্রমোদ চন্দ্র বড়ুয়া

     

 

 মো.কামরুজ্জামান, লামা (বান্দরবান)

লামা উপজেলার প্রমোদ বড়ুয়া, যিনি এক নামে প্রমোদ স্যার হিসেবে পরিচিত। পুরা নাম প্রমোদ চন্দ্র বড়ুয়া। পিতা-পুত্র-মা, সবার কাছে তিনি শ্রদ্ধেয় স্যার। একজন আদর্শ শিক্ষকের যতগুলো গুণ থাকার কথা, তার মধ্যে সবই আছে । অবসরে গিয়েও তিনি তার সন্তানতুল্য সকল ছাত্রদের খবরা খবর রাখেন। কিভাবে শিশুদেরকে পাঠদানে যত্নবান হতে হবে, এখনো কনিষ্ট শিক্ষদেরকে সেসব দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন। তার যাদু হাতের ছোঁয়াই লামা নুনারবিল আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি এখনো নাম করা বিদ্যাপিঠ পরিচয়ে স্বীয় ঐতিহ্য ধারণ করে আছে।

একজন আদর্শ শিক্ষকের আসলে কী কী বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার। কিংবা কোন গুণাবলী গুলো তাকে গড়ে তুলবে একজন আদর্শ শিক্ষক হিসাবে। শিক্ষকতা পেশার সাথে অনেকেই জড়িত, তবে একজন আদর্শ শিক্ষক হতে সবাই পারেন না। একজন আদর্শ শিক্ষকই জাতির মেধা গড়ার কারিগর। তাই তাকে হতে হবে আর দশটি মানুষের তুলনায় সেরা। কেননা তাকে দেখেই শিখবে আগামী প্রজন্ম; যারা গড়ে তুলবে একটি সুন্দর অবয়ব।

সম্প্রতি এ প্রতিনিধি লামা উপজেলার অবসর প্রাপ্ত এই গুণি শিক্ষকের সাথে এক আলাপচারিতায়, মনে রাখারমতো অনেক মুগ্ধকর তথ্য আবিস্কার করেন। কথোপকতনে এ শিক্ষক বলেন, একজন আদর্শ শিক্ষক  নিজেকে সবসময় ছাত্রছাত্রীদের যেকোনো সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। ছাত্রদের সার্বিক প্রয়োজনে পাশে থাকতে হবে। ভালো শিক্ষকরা সব সময় পড়াশুনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। শিক্ষকগন আরো বেশি জ্ঞানার্জন করে, অর্জিত জ্ঞানটুকু ছাত্রদের মাঝে বিলিয়ে দিতে পারেন।

তিনি বলেন একজন আদর্শ শিক্ষক যেকোনো ধরনের পরিস্থিতিতে নিজেকে খুব সহজে মানিয়ে নিতে পারেন। একজন আদর্শ শিক্ষক তার ছাত্রছাত্রীদের সবসময় সত্যের পথে চালিত করে থাকেন। কেননা তার কাছে অন্যায়ের কোনো আশ্রয় নেই। তিনি ছেলেমেয়েদের সবসময় ন্যায়ের সাথে চলতে পরামর্শ দেন। সত্যের আদর্শে ছাত্রদের গড়ে তুলতে নির্দেশ দেন। একজন আদর্শ শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের একটি নির্দিষ্ট উপায়ে, সবসময় উৎসাহ দিয়ে পাঠদান করিয়ে থাকেন। শিক্ষকরা ভালো করে জানেন যে, উৎসাহ ছাড়া একজন শিক্ষার্থী ভালোভাবে এগোতে পারে না। এ কারণে ছাত্রছাত্রীদের কল্যাণে তিনি ছাত্রদের সঠিকভাবে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দিয়ে থাকেন। একজন আদর্শ শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের সাথে এক ধরনের আত্মিক বন্ধন তৈরি করে ফেলেন। যার ফলে ছাত্রছাত্রীরা যেকোনো সমস্যায় শিক্ষকের কাছে চলে যান এবং শিক্ষক খুব সহজ উপায়ে তা সমাধান করে দেন। একজন আদর্শ শিক্ষক পড়ানোর মাধ্যমটিকে আনন্দময় করে তোলেন। এতে করে ছাত্রছাত্রীরা অনেক বেশি আগ্রহী হয়ে পড়ায় মনোযোগী হয়।

প্রমোদ বড়ুয়া এমনই একজন শিক্ষক ছিলেন, যাকে দেখলে শুধু ছাত্ররা নয়, অন্যান্য সহকারী শিক্ষরা তটস্থ হতেন, এমনকি এখনো হন। এখনো তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সাবেক ছাত্ররা সামনে পড়লে পরম শ্রদ্ধায় তাদের প্রিয় স্যারকে প্রণাম/সালাম করে থাকে। পৌর শহরে ছোট-বড় সবাই স্যারকে যতেষ্ট শ্রদ্ধা-সম্মানের সাথে দেখেন। তার হাতে গড়া অনেক ছাত্র দেশের নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা শেষ করে সফলতার সাথে কর্মজীবন পার করতেছেন। অনেকেই দেশ বিদেশে উচ্চ শিক্ষা নিচ্ছেন।

কক্সবাজার জেলার চকরিয়াস্থ মানিকপুর গ্রামে ১৯৫৬ সালের ৩০ জানুয়ারি মাসে এই গুণি শিক্ষকের জম্ম। তার বাবা যুগেন্দ্র লাল বড়ুয়া একজন মাষ্টার মহোশয় ছিলেন। প্রমোদ চন্দ্র বড়ুয়া ১৯৭২ সালে কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। ১৯৭৫ সালে প্রাইমারী শিক্ষক হিসেবে চাকুরীতে যোদান করেন। ১৯৭৯-৮০ সালে সিএনএড কক্সবাজার পিটি আই থেকে ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৮৫ সালে নুনানবিল সরকারি আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়। দীর্ঘ টানা ত্রিশ বছর একই প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করে, ২০১৫ সালের ২৯ জাসুয়ারি অবসর লাভ করেন। তার বাবা প্রয়াত শিক্ষক যুগেন্দ্র লাল বড়ুয়া, তিনিও নুনারবিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন শিক্ষকতাকরে, ৮০’র দশকে অবসর লাভ করেছিলেন।

বাবা যুগেন্দ্র লাল বড়ুয়া শিক্ষকতার সুবাদে ১৯৫৭ সাল থেকে লামা উপজেলায় চাম্পাতলী গ্রামে বসতি শুরু করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি শিক্ষকতা পেশায়যুক্ত হয়। সে থেকে শিশুদের নিয়ে অতিবাহিত হতে থাকে তার সময়। এভাবেই একে একে যৌবন-মধ্যবয়স পেরিয়ে; ২০১৫ সালে অবসর লাভ করে, এখন বেলাশেষের প্রস্তুতি। শিক্ষক হিসেবে তার পাঠদান কৌশল, প্রশাসনিক ব্যাবস্থাপনায় স্বচ্ছতায় সহকারী শিক্ষকদের নিয়ে তিনি নুনারবিল সরকারি আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়টিকে তিন পার্বত্য জেলার শীর্ষাবস্থানে নিয়ে আসেন। হালনাগাদ প্রতিষ্ঠানটি সে সুনাম বঝায় চলছে। শিক্ষার পাশাপাশি এই শিক্ষক সব সময় প্রমোদে মেতে থাকতেন। খেলা-ধুলা, সংস্কৃতি চর্চা করতেন তিনি। ৮০’র দশক থেকে গান-বাজনা, নাটক, কবিতা  ইত্যাদিতে স্যার ছিলেন একজন আমোদি মানুষ। শিশুদের সুশিক্ষার পাশাপশি; ক্রীড়া-সংস্কৃতি মনন বিকাশে এই উপজেলায় যে ক’জন; তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম।

শিক্ষকতা জীবনে তিনি কখনো পাঠদানে অবহেলা করেননি। স্কুল, ছাত্রছাত্রী, সহকারী অন্যান্য শিক্ষকরা ছিলো তার কাছে পরিবার পরিজন। তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক ছাড়াও; প্রকৃত দরদী হিসেবে ছাত্রের বাবা, মা সবাইর কাছে একজন দায়িত্বশীল অভিভাবক। চলনে-বলনে সদা হাসি-আমোদি এই মানুষটি এখনো সবার কাছে চির সবুজ ‘প্রমোদ স্যার”।

অবসর কিভাবে কাটে; এর উত্তরে তিনি বলেন, মানুষ ও প্রকৃতিকে ভালোবেসে। এখনো শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি ভাবেন। ভাবেন সবুজ প্রকৃতিকে নিয়েও। ফলদ ও বনজ বাগান করে তিনি সে সবের পরিচর্চা করে এবং মাঝেমধ্যে পৌর শহরে সন্তানের ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানে বসে সময় কাটান। লামা সুয়ালক সড়কের পাশে আম বাগান করেছেন। সবুজ প্রকৃতির দোলা আর নির্জনে পাখির গুঞ্জন শুনে তিনি দিনভর সময় কাটিয়ে সন্ধায় শেষ বিকালে ফিরে আসেন আপনালয়ে।

শিশুদের শিক্ষাগ্রহী করতে শিক্ষকদেরকে আরো দায়িত্বশীল হয়ে শিশুবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার আহবান জানান এই গুণি শিক্ষক। তিনি বলেন, প্রতিটি শিশুকে শিক্ষকরা নিজেদের সন্তানতুল্য মনে করতে হবে। তবেই এসব শিশুরা তৈরী হবে তেজোদীপ্ত নাগরিক হিসেবে। পিতা-মাতার পরেই শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হবে আমাদের সোনামনিরা। ওরা জানবে সমাজে মাথা উঁচু করে বাচঁতে হলে শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবলে হবেনা, ভাবতে হবে আমাদের চারপাশ নিয়ে। মানুষের কষ্টে চুপ করে থাকা যাবেনা। নৈতিকতা আর চারিত্রিক মূল্যবোধের আলোয় উদ্ভাসিত হতে হবে। মা-বাবাসহ অন্য সকলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও দায়িত্ববোধ সম্পন্ন হতে হবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে সচেতন হতে হবে।

সরকার শিক্ষকদেরসহ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নানান প্রকার আধুনিক সুযোগ দিয়ে চলছে। এসব সুযোগ সুবিধা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজম্ম শিশুদের শিক্ষানুকুলে কাজে লাগাতে হবে বলে এই গুণি শিক্ষক মন্তব্য করেন।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply