২৬ এপ্রিল ২০২৪ / ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / দুপুর ১:০৭/ শুক্রবার
এপ্রিল ২৬, ২০২৪ ১:০৭ অপরাহ্ণ

‘রমেশ বলে কি করিবে জাতে আর কুলেএই নিশা কি ছুটবে আমার গলায় ছুরি দিলে

     

 

লায়ন ডাঃ বরুণ কুমার আচার্য বলাই

১৮৭৭ সালে ৯ মে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলা পূর্ব গোমদণ্ডীর শীলপাড়ার অতিসাধারণ এক হীন-গরিব ঘরে রমেশ শীলের জন্ম। ১১ বছর বয়সে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় পিতৃহারা হন। তার উপর নেমে আসে পরিবারের ছয় সদস্যের ভার। জীবিকার তাগিদে গমন করেন বার্মায় (মিয়ানমার)। কিন্তু তার মন-প্রাণে মিশে আছে বাংলার সোঁদা গন্ধ। ১৮ বছর বয়সে ফিরে আসেন মাতৃভূমিতে। পেশা হিসেবে তাকে বেছে নিতে হয়েছে পৈতৃক পেশা ক্ষৌরকর্ম, স্বর্ণশিল্পী, মুদি-চালের গুদামে চাকরি, শল্য-কবিরাজি-হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা, কবিগান ও গণসংস্কৃতি চর্চা। ১৮৯৭ সালের কথা। চট্টগ্রামের মাঝিরঘাটে কবিগান পাগল বন্ধুদের সাথে জগদ্ধাত্রী পূজায় গান শুনতে গিয়েছিলেন বালক রমেশ শীল। দুই প্রবীণ কবিয়াল মোহন বাঁশি ও চিন্তাহরণের কবিগানের আসর। আসরে উঠে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন কবিয়াল চিন্তাহরণ। গলা বসে গেল, পদ শোনা যায় না। তখন মাইকের ব্যবহার ছিল না। শ্রোতাদের মধ্যে দেখা দেয় চরম উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলা। আয়োজকরা ঘোষণা দিলেন, আসরে কোনো কবি থাকলে মঞ্চে আসার জন্য। বন্ধুরা মিলে রমেশ শীলকে উঠিয়ে দিলেন আসরে। ভয়ে কাঁপা পায়ে আসরে উঠলেন তিনি। পরিচয় পর্বে প্রতিপক্ষ প্রবীণ-কৌঁসুলি মোহন বাঁশি পুঁচকে ছোঁড়া, নাপিত… বলে অশোভন ভাষায় আক্রমণ শুরু করেন। উত্তরে রমেশ শীলের প্রথম পদ ছিল- ‘উৎসাহ আর ভয়/লজ্জাও কম নয়/কেবা থামাইবে কারে?/পুঁচকে ছোঁড়া সত্য মানি/ শিশু ধ্র“ব ছিল জ্ঞানী/চেনা-জানা হোক না এই আসরে…।’ শুরু হল লড়াই। প্রবীণ-বিজ্ঞ মোহন বাঁশির সাথে জীবনের প্রথম কবিগানেই লড়াই চলল টানা ১৮ ঘণ্টা। কেউ কাউকে হারাতে পাচ্ছেন না। শেষতক আপোষ জোটকের ব্যবস্থা করলেন আয়োজকেরা। গান শুনতে গিয়ে ২১ বছর বয়সেই রমেশ হয়ে গেলেন কবিয়াল। তার পরিচয় হল ‘নতুন কবির সরকার’। কবিগান পাগল রমেশ শীল পরে হয়ে উঠলেন কবিগানের সম্রাট। বঙ্গের সেরা কবিয়াল। তিনি আজীবন গেয়েছেন- এদেশের মাটি ও মানুষের জয়গান। দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে তার কথা, সুর, গান ও লেখনি ছিল রণতূর্যের মতো। কণ্ঠ ছিল রুদ্রবীণা, আগ্নেয়গিরির মতো। যেমন-১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের পরাজয়ের পরে কবিগান বন্ধ হয়ে যায়। রমেশ ব্রিটিশ সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে কলম ধরলেন। তিনি লিখলেন- ‘পাঁচ গজ ধুতি সাত টাকা/দেহ ঢাকা হয়েছে কঠিন/রমেশ কয় আঁঁধারে মরি/পাই না কোরোসিন।’ ১৯২২ সালে দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের নেতৃত্বে আসাম-বেঙ্গল রেল ধর্মঘটে রমেশ শীল আন্দোলন নিয়ে রচনা করেন ‘আর যায় না চুপ করে থাকা/যতীন্দ্র বাবুর নেতৃত্বে বন্ধ হবে রেলের চাকা/মজদুরের একবার জোরে রেলের বিট মরিচা পরে/আমার রক্তে উদর পুরে, আমাকে ডেম ব্লাডি ডাকে।’ ভাষা আন্দোলনে কবিতা লিখে তাকে এক বছর কারা নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে পাক-হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় দোসরেরা তার বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়। তার অনেক কবিতা, গান, লেখা ও সৃষ্টি পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলে। তার সৃষ্টিকর্ম অযতেœ-অবহেলায় বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল থেকে রমেশ সমাধিকে কমপ্লেক্স করার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল অনেকবার। সেই ঘোষণা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। রমেশ শীলের সার্বজনীন পরিচয় তিনি কবিয়াল সম্রাট। স্বদেশ চেতনার কবি কিংবা মাইজভাণ্ডারী গানে নবযুগের স্রষ্টা হিসাবেও তাঁর খ্যাতি কিংবদন্তীতুল্য। তবে জীবনাচার ও সৃষ্টির আলোকে রমেশ শীলের সর্বশেষ পরিচয় হলো তিনি মানবতার মহাকবি। তাঁর প্রায় প্রতিটি সৃষ্টির মর্মমূলে মানবতারই জয়গান। বিশেষ করে রমেশ শীলের মরমী গান (যেটা ভাণ্ডারী গান হিসাবে বহুল পরিচিত) অধ্যয়নে দেখা যায় তিনি সুফীসাধনা বা মারফতী ভাব দ্বারা পরমভাবে অনুরক্ত। তাই রমেশের মরমী গানের পরতে পরতে মানবধর্ম ও সহজিয়া মতবাদের ছায়া। একটি গানে তারই সাক্ষ্য পাওয়া যায়-
‘মিমের পর্দা উঠাইলে দেখবি ওরে মন
রাম রহিম কৃঞ্চ করিম মূলেতে একজন।’
আমরা জানি ৪৬ বছর বয়সে ১৯২৩ সালে রমেশ শীল মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফের ওরশে গিয়ে দরবারের ধর্মসাধক সৈয়দ গোলামুর রহমান প্রকাশ বাবা ভাণ্ডারীর প্রেমে পড়ে যান। রমেশ লিখেছেন-‘গদি উপরে উলংগ অতি উজ্জলবরণ এক পুরুষ নির্বাক। সিদ্ধ বলে মেনে নিলাম।’ এই সিদ্ধ পুরুষকে দেখেই গান রচনার কথা মনে আসে রমেশের। কবিয়ালের জবানীতে-’ …তথায় উপস্থিত হওয়া মাত্র প্রাণ যেন কি একটা অনির্বচনীয় আনন্দ হিল্লোলে খেলিতে লাগিল এবং কে যেন কানে কানে বলিল, রমেশ এই মাইজভাণ্ডারের ভক্তগণকে গান শুনাইতে হইবে। প্রাণ কাঁপিয়া উঠিল, শরীর আড়ষ্ট হইল।’ পরবর্তী দুই দশকে রমেশ শীল নিয়মিত মাইজভান্ডারে যাতায়াত করেন এবং তাঁর গান দরবারের ওরশের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায়। কিন্তু হিন্দু রমেশ শীলের মাইজভান্ডারের মুসলমান পীরের প্রতি এই ভক্তি তাকে শীল সমাজে প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি করে দেয়। রক্ষণশীল সমাজপতিরা গো-মাংস আহারের অভিযোগ এনে রমেশ শীলকে ‘একঘরে’ করার চেষ্টা চালায়। রমেশ তাই লিখেন-
আমার নাগর বন্ধু শ্যাম
তোমার জন্যেতে কলঙ্কী হইলাম।।
আমার জাত গেল কুল গেল বলে এই ঘোষণা করে
জানি সবর্বজাতির ভাত খায় অমার জাত নাশা ঠাকুরে।।

রমেশ বলে কি করিবে জাতে আর কুলে
এই নিশা কি ছুটবে আমার গলায় ছুরি দিলে।।
(আশেক মালা-কবিয়াল রমেশ শীল)
আমাদের বলবার বিষয় হলো, ধর্ম সম্পর্কে নিজস্ব সাধনা ও মাইজভাণ্ডারের পীরের দর্শন রমেশ শীলকে এক নতুন আলোর সন্ধান দেয়, হয়তো সেখান থেকেই রমেশ শীল মানবধর্মের শিক্ষায় নিজেকে সমর্পণ করেন। যদিও জীবনাচারে রমেশ শীল সবসময় মানবধর্মের অনুসারী বলে মত আছে। তবে মাইজভাণ্ডার দরবার থেকে আত্মস্থ করা রমেশের লোকধর্মের শিক্ষা মনপ্রাণে লালন করে আসছেন তাঁর বংশধররাও। শুধু রমেশের বংশধররা নন বোয়ালখালীর গোমদন্ডীস্থ রমেশ সমাধি প্রাঙ্গণ-সন্নিহিত এলাকার মানুষের মধ্যে মানবধর্ম চর্চার এক অভূতপূর্ব রূপ দেখা যায়, যা বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় অসাধ্য বলেই প্রতীয়মান হয়। কিন্তু স্থানীয় মানুষের ভাষায় ‘রমেশ ভাণ্ডার’ এলাকার মানুষ এই অসাধ্য সাধন করছে। ১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমী ৫৩৫ পৃষ্ঠার ‘রমেশ শীল রচনাবলী’ প্রকাশ করেন। ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করেন। কবিয়াল সম্রাট-লোককবি রমেশ শীল ১৯৬৭ সালের ৬ এপ্রিল দেহত্যাগ করেন। কবিয়াল মনমহষী ২১ পদকপ্রাপ্ত কিংবদন্তি রমেশ শীলের ৫২তম মৃত্যুবার্ষিকী তাঁর প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধা।লেখক: প্রাবন্ধিক, মরমী গবেষক, বহুগ্রন্থপ্রণেতা।

 

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply