চট্টগ্রামে ফায়ার সার্ভিসের কোন নিয়ম মানছে না ভবন কর্তৃপক্ষ
বিপ্লব কান্তি নাথ
কয়েক দিন ধরে সারাদেশে আলোচনা-সমালোচনা ছিল বেশ কিছু দুর্ঘটনা নিয়ে। কিন্তু প্রশাসন কেন দুর্ঘটনার ব্যাপারে আগে থেকে জানলেও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে না ? ঘটনার ঘটার আগে কেন জরুরী ভিত্তিতে কর্মপরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে না প্রশাসন। এই রকম অনেক প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মনে দৈনিক খোরাক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকা-ের পর প্রশাসন ও সরকারের পক্ষথেকে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও বাস্তববে কত টুকু কার্যকর হবে সেই নিয়ে সারাদেশে শুরু হয়েছে নানা রকম জল্পনা-কল্পনা। রাজধানীর ন্যায় চট্টগ্রামেরও বড়ধরনের অগ্নিকান্ড সংঘটিত হওয়ার পরও জানমালের ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ ছিল কম। প্রত্যেকবার চট্টগ্রামে অগ্নিকান্ড সংঘটিত হওয়ার পর নানা পরিকল্পনা নিয়ে প্রশাসন ও সরকারের পক্ষথেকে বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা থাকলেও মূলত কিছুদিনের জন্য কার্যকর হয়। নগরীর বেশির ভাগ বহুতল ভবন নির্মাণ হয়েছে সরু সিড়ি, জরুরী বহিরাগমনের পথ নেই, অপযাপ্ত অগ্নিনিবর্পন ব্যবস্থা এবং বিল্ডিং এর সাথে বিল্ডিং লাগানো। নগরীর বিভিন্ন বাণিজ্যিক ভবনে রয়েছে স্কুল, কলেজ, প্রাইভেট কোচিং সেন্টার, বাসাবাড়ি ও ছোট বড় বিভিন্ন মালালের গুদাম। এই সব বাণিজ্যিক ভবনে কখনো অভিযান পরিচালনা করেনি স্থানীয় প্রশাসন ও চউক কর্তৃপক্ষ। আবার অনেক এলাকায় সিডিএ’র ৫ থেকে ৬ তলা বাণিজ্যিক ভবনের অনুমতি নিয়ে তা গড়ে তুলেছে ৭ থেকে ৯ তলা বিশিষ্ট বাণিজ্যিক ভবন। এই রকম ভবন গুলোতে যেখানে দেয়া যায়, ১ থেকে ৩ বা ৪ তলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক ভবন হিসাবে ব্যবহার হলেও উপরের গুলোতে ফ্ল্যাট হিসাবে বিক্রিকরে দিয়েছে ভবন কর্তৃপক্ষ। এই সব কি দেখেও দেখেনা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা স্থানীয় কোন প্রশাসন। আবার নগরীর অনেক জায়গায় গিয়ে দেখা যায় সরু রাস্তা দিয়ে কোন রকম চলার পথ আছে সেখানেও সিডিএ’র অনুমতি নিয়ে তৈরী করেছে ৮ থেকে ১০ তলা ভবন। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন সিডিএ কি এই সব ভবন তৈরীর অনুমোদনে নক্সায় রাস্তার জন্য কী পরিমাণ জায়গা রয়েছে তা সরেজমিনে গিয়ে দেখছে কি? অনেক জায়গায় আবাসিক এলাকার মধ্যে আবাসিক ভবন তৈরী করে সেখানে নিচে কমিউনিটি সেন্টর, কনভেনশন হল, কোচিং সেন্টর, কিন্ডারগার্টেন স্কুল, বেসরকারী স্কুল এন্ড কলেজ হিসাবে ভাড়া দিয়ে চলেছে। এইসব ভবন গুলোতে কোন ধরনের অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা ও পর্যাপ্ত সিড়ি। অপরদিকে বন্দর নগরীতে অর্ধশতাধিকেরও বেশি বাণিজ্যিক মার্কেট ও বস্তির আগুনের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে তালিকা করে। পরিকল্পনা ছাড়া গড়ে উঠা এসব মার্কেট আর বস্তিতে আগুন নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। সরু গলিতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যাতায়াতেরও নেই ব্যবস্থা। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তদন্তে আগুনের ঝুঁকিতে থাকা বিভিন্ন এলাকার চিত্র উঠে এসেছে। চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালকের ভাষ্যমতে ‘তালিকাভুক্ত মার্কেটগুলোতে ফায়ার লাইসেন্স নেই। প্রতিটি ভবনের ফায়ার লাইসেন্স নেয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হচ্ছে না। ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট ও বস্তিুতে প্রায় সময় সচেতনতামূলক সভা করা হচ্ছে। প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন থাকলে আগুনের হাত থেকে নিজেদের বাঁচানো সম্ভব’। শত বছরের অধিক পুরনো রিয়াজ উদ্দিন বাজারে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে একের পর এক মার্কেট। ছোট বড় একশো ২৭টি মার্কেটে দোকান রয়েছে প্রায় দশ হাজার। মালিক কর্মচারী মিলে এসব দোকানে ৩০ হাজারের অধিক লোকজনের বসবাস। ঐতিহ্যবাহী এ বাজারে আগুন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। মানা হয়নি ইমারত নির্মাণ নীতিমালা। পাঁচতলা ভবনে অনুমোদন নিয়ে তৈরি করা হয়েছে দশতলা। এমনকি পার্কিংয়ের জায়গায় দোকান তৈরি করে বিক্রি করা হয়েছে। যার যেভাবে ইচ্ছে হয়েছে সেভাবে তৈরি করা হয়েছে রিয়াজ উদ্দিন বাজারের মার্কেটগুলো। অভ্যন্তরীণ নালা নর্দমা দখল করেও তৈরি করা হয়েছে একাধিক ভবন। কোন দুর্ঘটনা সংঘটিত হলে উদ্ধার কাজও চালানো যাবে না। নগরীর পাইকারি কাপড়ের বাজার হিসাবে খ্যাত টেরিবাজারে ছোট বড় মিলিয়ে ৮২টি মার্কেটে প্রায় আড়াই হাজার দোকান রয়েছে। জানাযায়, ফায়ার সার্ভিসের দেয়া তথ্য অনুযায়ী নগরীর আটটি ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের আওতাধীন ৫৪ টি মার্কেট ও বস্তিতে আগুন নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা নেই। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো হলো- কালুরঘাট ফায়ার স্টেশনের আওতাধীন হক মার্কেট, স্বজন সুপার মার্কেট, বখতেয়ার মার্কেট, নজু মিয়া হাট মার্কেট, বলিরহাট মার্কেট, লামার বাজার ফায়ার স্টেশনের আওতাধীন চাউল পট্টি, শুঁটকি পট্টি, খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ, মিয়া খান পুরাতন জুট মার্কেট ও ওমর আলি মার্কেট। বন্দর ফায়ার স্টেশন এলাকার পোর্ট মার্কেট, বড়পুল বাজার, ইশানমিস্ত্রির হাট, ফকির হাট মার্কেট, নয়বাজার মার্কেট, ফইল্লাতলি বাজার ও চৌধুরী মার্কেট। ইপিজেড ফায়ার স্টেশন এলাকার কলসি দিঘির পাড় এলাকার কলোনি, আকমল আলী এলাকার কলোনি, মহাজন টাওয়ার। এছাড়া রেলওয়ে বস্তিতে আগুন নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা নেই। একইভাবে চন্দনপুরা ফায়ার স্টেশনের আওতায় চকভিউ সুপার মার্কেট, কেয়ারি শপিং মল, গোলজার মার্কেট, মতি টাওয়ার ও শাহেনশাহ মার্কেট, নন্দনকান ফায়ার স্টেশন এলাকার জহুর হকার্স মার্কেট, টেরিবাজার, তামাকুম-িলেন, গোলাম রসুল মার্কেট, বাগদাদ ইলেকট্রিক সুপার মার্কেট, হাজি সরু মিয়া মার্কেট ও নুপুর মার্কেটেও রয়েছে অগ্নিকা- ঝুঁকিতে। আগুন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই আগ্রাবাদ ফায়ার স্টেশেনের ঝাউতলা বস্তি, আমবাগান বস্তি, সেগুন বাগান বস্তি, কদমতলি রেলওয়ে বস্তি, সিঙ্গাপুর সমবায় সমিতি মার্কেট, কর্ণফুলী মার্কেট, বায়েজিদ ফায়ার স্টেশনের দুই নম্বর গেট এলাকার রেলওয়ে বস্তি, অক্সিজেন রেল লাইন সংলগ্ন বস্তি এলাকা, বার্মা কলোনি, দুই নম্বর গেট ড্রাইভার কলোনি, রৌফাবাদ কলোনি, শেরশাহজ কলোনি, শেখ ফরিদ মার্কেট, যমুনা সুপার মার্কেট, ষোলশহর সুপার মার্কেট, ইমাম শপিং কমপ্লেক্স ও চট্টগ্রাম শপিং কমপ্লেক্স। এছাড়াও নগরীর অনেক আবাসিক এলাকা ও তার আশপাশে অনেক অপরিকল্পিত বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে যেন দেখার কেউ নেই। চট্টগ্রাম নগরীতে গত কয়েক বছরে যে পরিমাণ বহুতল ভবন নির্মাণ হয়েছে তাদের অনেক ভবনে গিয়ে দেখা যায় সরু সিড়ি, তাৎক্ষনিক ও জরুরী অগ্নিনির্বাপনের কোন সরঞ্জাম বা সতর্ক সংকেতের ও ব্যবস্থা নেই। দেশের বিভিন্নস্থানে অগ্নিকান্ডের ঘটনাদেখে চট্টগ্রাম বসবাসকারী অনেকে এখন ভিত পরিবেশে বসবাস করছে। অনেক সাধারণ মানুষ মনে করেন সিডিএ, সিটি কর্পোরেশন ও জেলা প্রশাসক যদি একসাথে কাজ শুরু করে অবৈধ ও অপরিকল্পিত ভবন গুলোর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাহলে নগরীর বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে।