২৬ এপ্রিল ২০২৪ / ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / সকাল ৬:২২/ শুক্রবার
এপ্রিল ২৬, ২০২৪ ৬:২২ পূর্বাহ্ণ

কোচিংবাজ-প্রশ্নপত্র ফাঁস : সমাধান নিয়ে আলোচনা

     

মোমিন মেহেদী

সারাদেশে হাজার হাজার কোচিং সেন্টার আর লক্ষ লক্ষ কোচিংবাজ যেখানে নিত্যদিনই একটু একটু করে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংশ করে দিচ্ছে; তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় অগ্রসর হচ্ছে মন্থর গতিতে। একদিকে শিক্ষা মন্ত্রী-সচিব আর মন্ত্রণালয়ের অদক্ষ-অথর্বদের শিক্ষা নিয়ে অপরিকল্পিত পথচলায় অন্ধকার নেমে আসে প্রতিদিন। সেই অন্ধকারের কারিগরদের যোগসাজশে শিক্ষার নামে অশিক্ষা-কুশিক্ষার রাস্তা তৈরি হচ্ছে। যে কারনে লক্ষ লক্ষ কোচিংবাজদেরকে কেউ দেখতে পারছে না; খুঁজে পাচ্ছে না অন্যায়ের রাস্তায় কারা রোজ হাটছে। তথাকথিত আইনগত জটিলতায় কোচিংবাজ ১১১ শিক্ষকের শাস্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অভিযুক্ত এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কোনো ক্ষমতা যেমন দুদকের নেই, তেমনই কোচিং বন্ধের জন্য ২০১২ সালে প্রণীত নীতিমালাতেও যথেষ্ট ফাঁক রয়েছে। বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান নিয়ে এগিয়ে চলা সময়ে একটি কথা হলফ করে বলতে পারি; আর তা হলো- দুর্বল এ নীতিমালায় পরিবর্তন আনা ছাড়া শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য থেকে বিরত রাখা অসম্ভব।

গণমাধ্যমেপ্রকাশিত সংবাদে দুদকের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহীমের নেতৃত্বে ৬ সদস্যের অনুসন্ধান টিম প্রায় আট মাস ধরে রাজধানীর নাম করা ৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুসন্ধান শেষে শিক্ষকদের এ তালিকা তৈরি করে তা কমিশনে জমা দেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আইনগত জটিলতায় অনুসন্ধান টিম অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে না পেরে কোচিং বন্ধে নতুন আইন প্রণয়নের সুপারিশ করেছে। একই সঙ্গে নতুন আইন হলেও সে আইন দিয়ে পূর্বের অপরাধের বিচার বা শাস্তির ব্যবস্থা করা যাবে না বলেও দুদকের তরফ থেকে যায়যায়দিনকে জানানো হয়েছে। এ অবস্থায় রাজধানীসহ সারা দেশে কোচিংবাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ দেখছে না দুদকের কর্মকর্তারা। আর এ কারণে দুদকের অনুসন্ধানও থমকে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।

জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক ও অনুসন্ধান টিমের প্রধান মোহাম্মদ ইব্রাহীম গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমরা অনুসন্ধান করেছি। আমাদের অনুসন্ধানে যেসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোচিং করানোর বিষয়টি নিশ্চিত হতে পেরেছি তাদের নামই এ তালিকায় রাখা হয়েছে। তবে আইন বা নীতিমালায় অভিযুক্ত এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ না থাকায় আমরা এ বিষয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি আইন পরিবর্তনের সুপারিশ করেছি। কিন্তু একথাই শেষ কথা নয়; আমরা চাই সমাধান; নতুন প্রজন্ম পরিবর্তনে বিশ্বাসী। আইন পরিবর্তন হলে কোচিংবাজ এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে একজন কর্মকর্তা বলেছেন, পূর্বে সংঘটিত কোনো অপরাধের বিচার পরবর্তীতে প্রণীত আইন দিয়ে করা যায় না। ফলে অভিযুক্ত এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে আমরা এখনি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছি না। আইন পরিবর্তন দীর্ঘমেয়াদি বিষয়। তবে পরিবর্তন হলে তখন কোচিংবাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। এ জন্য আমাদের প্রতিবেদনে আইন পরিবর্তনের সুপারিশও করা হয়েছে।’ এখন কথা হলো যে যদি ভূত ছাড়ানোর জন্য আনা সরিষাতে ভূত ঢুকে বসে থাকে; তখন কি করতে হবে? তখন নতুন প্রজন্মকেই এগিয়ে আসতে হবে বায়ান্ন-একাত্তর আরা গণমুখি সকল আন্দোলন-সংগ্রামের মত করে। যাতে চনগন সচেতন হয়; এগিয়ে আসে সাহসের সাথে সকল অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে।
তা না হলে একের পর এক শিক্ষা খাতে অন্যায়ের রাজত্ব তৈরি হবে আর শুনতে হবে যে, আইনগত জটিলতায় দুদক কোচিংয়ে জড়িত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হলে তা মন্ত্রণালয় নিবে। দুদকের হাতে এ বিষয়ে কোনো ক্ষমতা দেয়ার পরিকল্পনা এ মুহূর্তে সরকারের নেই। তবে ব্যক্তিগতভাবে কেউ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হলে প্রচলিত আইন অনুসারে দুদক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই পারে।

তবে ভূতে ধরা দুদকের অনুসন্ধান টিমের প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে যে, অনুসন্ধানকালে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কোচিংবাণিজ্যে যুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রেখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিংবাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২’ করলেও কোচিং বন্ধে কোনো আইন হয়নি। সুনির্দিষ্ট আইনের আলোকে শাস্তির বিধান না রাখলে চূড়ান্তভাবে কোচিং বন্ধ করা কঠিন। ফলে সুনির্দিষ্ট শাস্তির বিধান রেখে কোচিংবাণিজ্য বন্ধে আইন প্রণয়নের সুপারিশ করা যেতে পারে। একই সঙ্গে কোচিংবাণিজ্য রোধে এর সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী এক বিদ্যালয় থেকে অন্য বিদ্যালয়ে, এক শাখা থেকে অন্য শাখায়, দিবা শিফট থেকে প্রভাতি শিফটে বা প্রভাতি শিফট থেকে দিবা শিফটে নির্দিষ্ট সময় অন্তর বদলির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা যেতে পারে। সময়ের আয়নায় চোখ রাখলে দেখি যে, ২০১২ সালের ২০ জুন কোচিংবাণিজ্য বন্ধ করতে নীতিমালা তৈরি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নীতিমালায় নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কোচিং অথবা প্রাইভেট পড়াতে নিষেধ করা হলেও ভিন্নভাবে তা রেখে দেয়া হয়। নীতিমালা অনুসারে, কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ জন ছাত্রছাত্রীকে নিজ বাসায় পড়ানোর সুযোগ রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে লিখিতভাবে ছাত্রছাত্রীর নাম ও রোল নম্বরসহ তালিকা জানাতে বলা হয়েছে। ওই নীতিমালা অনুসারে কোনো শিক্ষক বাণিজ্যিকভাবে গড়ে ওঠা কোচিং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত হতে পারবেন না। তবে অভিভাবকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ক্লাস টাইমের পূর্বে বা পরে প্রতিষ্ঠানের ভিতরে গ্রাম-শহরভেদে ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বিষয় প্রতি নিয়ে অতিরিক্ত ক্লাস (কোচিং) করানোর ব্যবস্থা করতে পারেন প্রধান শিক্ষক। কিন্তু বাস্তবতা হলো-সম্পূর্ণ বিপরিত। শুধু এখানেই শেষ নয়; আমাদের এই নতুন নীতিমালায় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভিতরেই কোচিং করানোর সুযোগ রেখে দেয়ার পাশাপাশি অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনূর্ধ্ব দশজনকে বাসায় পড়ানোরও অনুমতি দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় বর্তমানে থাকা নীতিমালা দিয়ে কোচিং বন্ধ করা এক প্রকার অসম্ভব। বলছেন, অতিরিক্ত ক্লাস বা অন্য যে নামেই বলা হোক না কেন তা যেহেতু টাকার বিনিময়ে পড়তে হবে সেহেতু তার সঙ্গে কোচিংয়ের কোনো পার্থক্য নেই। বরং কৌশলে এ নীতিমালা বিদ্যালয়ের ভিতরেই কোচিংকেই বৈধতা দিয়েছে।

এখন কথা হলো এভাবে কতদিন? যেখানে সারাদেশে শত শত, হাজাার হাজার কোচিং সেন্টার সেখানে দুদকের তালিকায় স্থান পাওয়া ১১১ শিক্ষকের মধ্যে রয়েছে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মতিঝিল শাখার ৩২ জন ও বনশ্রী শাখার ৪ জনসহ মোট ৩৬ জন, মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ২৪ জন, খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১ জন, মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ১২ জন, মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৪ জন, ভিকাররুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৭ জন, মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের ১৪, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের ৮ জন এবং রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৫ জন শিক্ষকের নাম উঠে এসছে। তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে ছলে বলে কৌশলে কোচিংবাজদেরই পক্ষে কাজ করছেন শিক্ষামন্ত্রী-সচিব-আমলাসহ সকলে! সেক্ষেত্রে তো জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা
প্রশ্নফাঁস রোধে চার পদক্ষেপ নিয়ে কিচ্ছুটিই হবে না। বরং ৩০ মিনিট আগে কেন্দ্রে ঢুকতে হবে, সব শিক্ষার্থী কেন্দ্রে ঢোকার পর প্রশ্নের প্যাকেট খুলতে হবে, পরীক্ষার সময়ে কোচিং বন্ধ, কন্দ্রে কেবল সচিব ক্যামেরাবিহীন মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন বলে নতুন প্রজন্মকে কোন না কোনভাবে ভয়াবহ হতাশার রাস্তায় ঠেলে দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

কোচিং সেন্টারের রাজত্ব তৈরি হচ্ছে, কোচিংবাজগণ নিজেদের রাজত্বে সহি সালামতে আছেন; আর তখন জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস রোধে চারটি পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে বলেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় অ-নে-ক বড় দায়িত্ব পালন করছে প্রমাণ করতে চাইছে। তাও আবার ‘ছাত্রছাত্রীদের সকাল সাড়ে ৯ টার মধ্যে পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশ করতে হবে, সব শিক্ষার্থী কেন্দ্রে ঢোকার পর প্রশ্নের প্যাকেট খোলা হবে। পরীক্ষার সময়ে কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকবে। পরীক্ষার হলে শুধু কেন্দ্র সচিব ক্যামেরাবিহীন মোবাইল ব্যবহার করতে পারবেন।’ টাইপের বুলি আউড়িয়ে। যেখানে প্রায় ২৫ লাখ শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে সেখানে নিয়ম করেই এই দুর্নীতির রাম রাজত্ব তৈরির পেছনে যারা রয়েছেন সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সময় এখন। সেই ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নেই; তবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন গর্বের সাথে বলছেন যে, ‘যে পরীক্ষা মূল্যায়ন হয় না এবং অসাধু উপায় অবলম্বনের পথ প্রশস্ত করে, সেটি রাখা না রাখা সমান কথা। এ ব্যাপারে এখনই কোনো সিদ্ধান্ত নয়। এর সঙ্গে যেহেতু কারিকুলাম ও পাঠ্যক্রম সংশোধনের সম্পর্ক আছে। তাই করণীয় নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট ফোরামে আলোচনা করা হবে।’ এভাবে বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থাকে পঙ্গু করতে কারা কাজ করছে? সেই ব্রিটিশরা কি আবারো ফিরে এসেছে; যারা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার নেপথ্য কারিগর হিসেবে পেছনে থেকে কাজ করেছে শুধুমাত্র মুসলিমদেরকে-বাঙালিদেরকে মূর্খ রাখার চিন্তা থেকে? এমন হাজারো প্রশ্নের ভীড়ে ধিরে ধিরে এগিয়ে যেতে চাই সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরির পাশাপাশি ‘শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা নয়-জ্ঞান ছড়িয়ে আনবো জয়’ শ্লোগানকে লালনের মধ্য দিয়ে। এক্ষেত্রে সবার আগে গড়ে তুলতে হবে ফরমালিন টাইপের শিক্ষকমুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান; যারা ঘুষ দিয়ে এবং নিয়ে শিক্ষক নিয়ে দেয় তাদেরকে ক্যাম্পাস ছাড়া করতে পারলেই শিক্ষক-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা পাবে বিনয় আবাস; আর তার লক্ষ্যেই এগিয়ে যেতে হবে।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply