সাহাবুদ্দিন আহাম্মদ চৌধুরী
বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের জন্য যে কয়জন অলীয়ে কামেল ও পীর বুজুর্গানে দ্বীন এসেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন হযরত শাহ্ খাজা শরফুদ্দিন চিশতি (র:)। উনার মাজার বর্তমানে সুপ্রীম কোর্ট মসজিদের পাশে বিদ্যমান। উনার জীবন কাহিনী নিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরী করার চেষ্টা করেছি।
এ পর্যন্ত বিভিন্ন সুত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে সুনির্দিষ্টভাবে জানা গেছে যে ওলিয়ে বাংলা’ হিন্দুলওলী খাজা গরিবে নেওয়াজ হযরত শাহ খাজা মঈনউদ্দিন চিশতি(রহ:) এর ২য় স্ত্রী হযরত বিবি ইসমত-এর গর্ভে ও খাজা মঈনুদ্দিন চিশ্তির ঔরষে তিনি ১২৩০ খৃষ্টাব্দে তথা ৬২৮ হিজরীতে ভারতের রাজস্থানের অন্তর্গত আজমীর শরীফে জন্ম গ্রহণ করেন।
বিগত ৭৯৪ বৎসরব্যাপী লিখিত বিভিন্ন “মালফুজাত” ‘তাজকিরাত’ ও ‘মাকতুবাত’ সুত্রে বিশেষ করে হযরত শাহ্ খাজা গরীবে নেওয়াজ মঈনুদ্দিন চিশ্তি (রহ:)-এর ২য় প্রধান খলীফা হযরত হামিদউদ্দিন সাভালী(রহ:) কর্তৃক ১২৫০ খৃষ্টাব্দে রচিত ‘সুরুবা সুদূর’এ তথ্য প্রদান করা হয়েছে।
এ ছাড়া হযরত খাজা নিজামুদ্দিন আওলিয়া(রহ:) কর্তৃক রচিত ‘ফাতেয়াইদুল ফুয়াদ’ ও তার খলিফা হযরত নাসির উদ্দিন চেরাগী কর্তৃক রচিত ‘খায়রুল মনজিল’ পুস্তকের যে বর্ণনা করা হয়েছে তাতেও এ বিষয়ে পুর্নাঙ্গ আলোকপাত করা হয়েছে। ওলী-এ-বাংলার পিতৃপ্রদত্ত প্রকৃত নাম ছিল ‘খাজা হুসাম উদ্দিন আবু সালেহ্ চিশ্তি (রহ:)। তাঁর জৈষ্ঠভ্রাতা হযরত শাহ খাজা ফখরুদ্দিন আবুল খাইর চিশ্তি (রহ:) হযরত শাহ খাজা গরীব-এ-নেওয়াজ(রহ:) এর ১ম স্ত্রী বিবি আমাতুল্লাহর গর্ভজাত ও একই মাতার গর্ভে তার একমাত্র ভগ্নী হযরত বিবি হাফেজা জামাল(রহ:) জন্ম গ্রহণ করেন। তার কনিষ্ঠভ্রাতা হযরত খাজা গিয়াসউদ্দিন আবু সাইয়্যেদ চিশ্তী (রহ:) তার গর্ভধারিণী মাতা বিবি ইসমত এর গর্ভজাত ছিলেন। পিতৃকূলে এ মহান ওলী সাঈদ ছিলেন তার বংশধারা পিতা হযরত খাজা গরীব-এ-নেওয়াজ(রহ:)এর মাধ্যমে রাসুলে করীম (সা:) এর রক্তধারার সাথে সংমিশ্রিত ছিলেন।
ওলী-এ-বাংলার ৫ বছর বয়সকালে ৬ই রজব ৬৩৩ হিজরী মোতাবেক ১২৩৬ খৃষ্টাব্দে তার পিতা হযরত খাজা গরীব-এ-নেওয়াজ মঈনুদ্দিন চিশতি(রহ:) ইন্তেকাল করেন। ফলে সে সময়ে যুবক বয়স্ক তার জৈষ্ঠ্যভ্রাতা হযরত খাজা ফখরুদ্দিন আবুল খাইর চিশতির(রহ:) পরিচর্যায় তিনি লালিত পালিত হন। পরবর্তীতে কিশোর বয়সে তিনি দিল্লীতে হযরত খাজা নিজামউদ্দিন আওলিয়া(রহ;)এর হাতে মুরিদ হন ও তার কাছে ইল্মে মারেফাতে জ্ঞান অর্জন করেন। পরে ক্রমে ক্রমে তিনি কঠোর সাধনা দ্বারা কামালিয়াতের উচ্চ পর্যায়ে উপনীত হয়ে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের আবদালে পরিণত হন।
এখানে উল্লেখ্য যে, হযরত খাজা মঈনউদ্দিন চিশতী(রহ;) এর ইন্তেকালের পর আজমীর শরীফ পুনরায় এর ভূতপূর্ব হিন্দু রাজা পৃথিরাজ রায়ের পুত্রগণের দখলে চলে যায়। যার কারণে আজমীর শরীফের মুসলমানগণ চরম নির্যাতনের শিকার হন। এ সময় ৬৬৩ হিজরী মোতাবেক ১২৬৫খৃষ্টাব্দে তার জৈষ্ঠ্যভ্রাতা খাজা ফখরউদ্দিন আবুল খাইর চিশতি(রহ:) হিন্দু দুষ্কৃতিকারীদের সাথে যুদ্ধে শাহাদাৎ বরণ করেন। ভ্রাতার মৃত্যুতে হযরত হুসাম উদ্দিন খুবই মর্মাহত হন ও আজমীর শরীফ ত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
তখন তার বয়স ছিল ৪৫ বছর। এসময় এক রাতে তিনি তার পিতা হযরত খাজা গরীবে নেওয়াজ (রহ:) এর নিকট থেকে স্বপ্নে ‘বাশারত’ লাভ করেন ও পূর্বদিকের দেশে গমন করে দ্বীনের খেদমত করার নির্দেশ লাভ করেন। এ অবস্থায় তিনি কাউকে কিছু না জানিয়ে এক গভীর রাতে পদব্রজে দিল্লীর উদ্দেশ্যে আজমীর ত্যাগ করেন। ঠিক একই সময়ের কিছু পূর্বে হযরত শাহ্ জালাল (রহ:) বঙ্গদেশে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে দিল্লীর হযরত নিজামউদ্দিন আওলিয়া(রহ:) কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে ১২ জন আওলিয়াকে সাথে নিয়ে বঙ্গদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথিমধ্য্যে বিভিন্ন স্থান থেকে আরো বহু আওলিয়া দরবেশ তার সাথে এসে যোগদান করেন।
হযরত হুসাম উদ্দিন (রহ:) আজমীর শরীফ থেকে পদব্রজে দিল্লী আসেন এবং সেখানে সংবাদ পান যে, হযরত শাহ জালাল (রহ:) ১২জন সঙ্গীসহ পূর্বদিকে বঙ্গদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছেন এবং বর্তমানে সমরখন্দে অবস্থান করছেন। তিনি পদব্রজে সমরখন্দে গিয়ে হযরত শাহজালাল (রহ:) এর কাফেলার সাথে এসে যোগ দেন। আজমীর শরীফ হতে মুহাম্মদ শরীফ নামে অপর এক দরবেশ একি সময়ে হযরত শাহজালাল (রহ:) এর সাথে যোগ দেন। হযরত শাহজালাল (রহ:) এর কাফেলার সাথে হুসামউদ্দিন (রহ:) মুলতান, ইরান, আফগানিস্তান ও বিহার প্রভৃতি অঞ্চল পদব্রজে পেরিয়ে বঙ্গদেশের সপ্তগ্রাম এসে উপস্থিত হন। সপ্তগ্রাম তকন ছিল মুসলিম সুলতান শামস-উদ-দিন ফিরোজশাহ্ এর রাজ্য লাখনৌতির অন্তর্গত। শ্রীহট্ট তখন ছিল অত্যাচারী হিন্দু রাজা গৌরগোবিন্দের অধীনে। সুলতান শামস-উদ-দিন ফিরোজশাহ্ শ্রীহট্ট অভিযানের উপদেশ দিয়ে হযরত শাহজালাল (রহ:) সুলতানের সেনাবাহিনীর সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিন এর বাহিনীর সাথে হযরত হুসামউদ্দিন (রহ;) ও হযরত শাহজালাল (রহ:) এর সঙ্গী ৩৬০জন ওলী দরবেশ ৭০১ হিজরী মোতাবেক ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে বিজয়ীর বেশে শ্রীহট্টে প্রবেশ করেন। অত:পর শ্রীহট্ট বা সিলেটে হযরত শাহজালাল(রহ:) এর সাথে তিনি দুই বছর অবস্থান করেন ও তার সহবতে ফায়েজ ও বরকত লাভ করেন।
এ সময়ে খাজা গরীব-এ-নেওয়াজ(রহ:) এর পুত্র হিসেবেতার পিরিচিতি প্রকাশ পেলে হযরত শাহজালাল (রহ:) হযরত হুসামউদ্দিন (রহ:) নাম বদলে রাখেন খাজা শরফুদ্দিন চিশ্তি(রহ:) । যার আরবী অর্থ হচ্ছে বদলানো বা পাল্টানো। সেই থেকেই হযরত হুসামউদ্দিন চিশতি(রহ:) হযরত খাজা শরফুদ্দিন চিশতি(রহ:) হিসেবে পরিচিত হন। হযরত শাহজালাল(রহ:) এর নির্দেশে দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্যে শ্রীহট্ট থেকে দক্ষিণ বঙ্গের দিকে নৌকাযোগে রওয়ানা হন।
পথিমধ্যে সোনারগাঁওয়ের হযরত শরফ উদ্দিন আবু আওয়ামা’র প্রতিষ্ঠিত খানকাহ্ শরীফে কিছুকাল অবস্থান করে সেখানকার সূফী-দরবেশদের পরামর্শে ঢাকার ‘রমনা’ নামক এক গ্রামে অবস্থিত এক কালী মন্দিরের পাশে বসবাসকারীদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে উক্ত অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের সংকল্প করেন। তিনি সেই রমনা’র উদ্দেশ্যে সোনারগাঁও থেকে নৌকাযোগে রওয়ানা হন। উক্ত নৌকার মাঝির দেখানো পথে তিনি উক্ত কালী মন্দিরের কাছাকাছি স্থানে আসার জন্য বুড়ীগঙ্গা নদীর সাথে সংযুক্ত এক খাল পথের শেষ প্রান্তে গভীর জঙ্গলাকীর্ণ এবং সরু এক পায়ে চলা পথের পাশে অবতরণ করেন। স্থানটি নির্জন ও লোকালয় শুণ্য হওয়ায় তার খুব পছন্দ হয়। এখানেই তিনি আস্তানা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। আজ যে স্থানে মাজার ও মসজিদ অবস্থিত এটাই সেই ভীষণ জঙ্গলাকীর্ণ স্থান। বয়োবৃদ্ধরা জানিয়েছেন-মাজার মসজিদের সামনের এই জাতীয় ঈদগাহ মাঠটি ছিল একটি খালের শেষ মাথা। এ খাল দিয়েই ওলী-এ-বাংলা এ স্থানে এসে নৌকা থেকে অবতরণ করেন। এখনো সেই কালী মন্দির সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতর পুন: প্রতিষ্ঠাক্রমে দাড়িয়ে আছে। খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে রমনা গ্রামটি ছিল সংখালঘু বৌদ্ধ ধর্মালম্বী এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু অধ্যুষিত। অষ্টম শতাব্দীতে এখানে শিখ ধর্মগুরুর পথ স্মৃতি হিসেবে শিখ ধর্মালম্বীরা ‘গুরুদুয়ারা নানকশাহী” প্রতিষ্ঠা করে। ১১০০ খৃষ্টাব্দে নেপালের ‘বদ্রিনাথ যোশী মঠ’ এর শংকরাচার্য্য স্বামী গোপাল গিরির নেতৃত্বে একদল তীর্থ দর্শনার্থী রমনা গ্রামে আগমন করে সেখানে আখড়া’ গড়ে তুলে। তারা কালী মাতার মন্দির প্রতিষ্ঠাকল্পে একটি কাঠের তৈরী মন্দির নির্মাণ করে। এভাবে তথায় কালী পূজার সুচনা হয়। ক্রমে ক্রমে এ কালীপূজার মন্দিরে কাপালিকদের প্রাধান্য বিস্তৃত হয়। তারা নরবলিরযজ্ঞসহ নানান যাগযজ্ঞ দ্বারা স্থানীয় নিরীহ হিন্দু ধর্মালম্বী ও অপরাপর বসবাসকারীদের মাঝে ভীতির সঞ্চার করেন। এসব কাপালিকদের তান্ডবে সনাতন ধর্মের সৌন্দর্য্য প্রায় বিলীন হয়ে গেলে সেখানকার হিন্দু-বৌদ্ধরা ব্রাহ্ম্রণ্য ধর্মের দিকে ধাবিত হতে থাকে। এমনি এক ক্রান্তিলগ্নে ওলী-এ-বাংলা এখানে তার খানকাহ্ গড়ে তোলেন।
এ সময় অত্র এলাকা ছিল উৎকট তান্ত্রিক হিন্দু গুরুবাজদের প্রভাব এবং সুরাপায়ী তান্ত্রিকবাদের অনুসারী পুরোহিতরা উৎসর্গ করতো নরবলি। ভয়ে উৎকন্ঠায় এই গ্রামীন মানুষগুলো যখন অস্থির ছিল তখন মানব সেবার ব্রত নিয়ে এই মহান ওলীর কন্ঠে ধ্বনিত হলো ‘আল্লাহু আকবার’, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ”। এই উচ্চারনের উদাত্ত আহবানে সিরাতুল মোস্তাকিম’ স্পষ্ট হয়ে উঠে পথভ্রষ্ট মুক্তিকামী মানবকূলের সামনে।
হিজরী ৭০৪ মোতাবেক ১৩০৬ খ্রিষ্টাব্দে ওলি-এ-বাংলা এখানকার আস্তানা থেকে দ্বীন প্রচারে নিয়োজিত হন। তার চারিত্রিক মাধূর্য্য ও শ্রদ্ধেয় পুণ্যাত্মার পরিচয় পেয়ে হিন্দুরা অচিরেই তার প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে এবং ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে থাকে।নিজের জীবিকা নির্বাহের দুশ্চিন্তা না করে তিনি এ অঞ্চলে ইসলামের বাণী প্রচার করতে থাকেন। শত শত হিন্দু তার হাতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। কিন্তু কায়েমী স্বার্থবাদী পুরোহিতরা নানাভাবে বাঁধার সৃষ্টি করতে থাকে। তবে ওলী-এ-বাংলার কঠোর সংগ্রামে তান্ত্রিকদের সকল তন্ত্র-মন্ত্র নিষ্ফল হয়ে যায় এবং এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয় যে কালী মন্দিরের তান্ত্রিকেরা হয় ওলী-এ-বাংলার হাত ধরে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয় অথবা এ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকে কালীমন্দিরটি বিরানা হয়ে বাদুর-চামচিকার আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়। তাঁর কারণে এখানে ধীরে ধীরে মুসলিম লোকালয় গড়ে উঠে। তার নামানুসারে এলাকাটি চিশ্তিয়া মহল্লা’ নামে পরিচিত হয়ে উঠে। চিশতিয়া মহল্লার বাড়ী-ঘর, মসজিদ ও কবরস্থান তাঁর ইন্তেকালের পর কালক্রমে হারিয়ে যায়।
প্রায় ৬০০ বছর পর ১৯০৫ সালে এখানে পূর্ব বাংলা প্রদেশের ইংরেজ বড়লাটের বাসস্থান নির্মাণ পরিকল্পনা গ্রহণ করে বৃটিশ সরকার। এই এলাকার কবরস্থান নিশ্চিহ্ন করে গর্ভনর হাউজ নির্মাণ বা পুরাতন হাইকোর্ট ভবন আজো কালের নির্মম স্বাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে।
উল্লেখ্য,ওলী-এ-বাংলার ইন্তেকালের পরে স্বামী হরিচরণ গিরি রমনা গ্রামের ঐ কাঠঘর’ মন্দিরটি ভেঙ্গে পাকা মন্দিরের পত্তন করলে ভাওয়ালরাজ মহিয়ষী রাণী বিলাসমণি দেবী সেখানে সুউচ্চ শিখর সম্বলিত মন্দিরে পরিণত করে সেখানে হিন্দুদের আচার-আচরণ প্রতিষ্ঠা করেন। ওলী-এ-বাংলা নিজ জীবদ্দশায় ইসলাম প্রচারে যে সংগ্রাম করে গেছেন তারই ফলশ্রুতিতে রমনা গ্রাম ছাড়িয়ে ইসলামের মহান বাণী পৌছে যায় এ এলাকার পাশ্ববর্তী সকল জনপদে। শ’ শ’ মানুষ ক্রমে ক্রমে তার সোহবতে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহন করেন। তার প্রতি শ্রদ্ধা ভালবাসা ও ইসলাম প্রচারে তার কঠোর সাধনার কারণে তিনি ওলী-এ-বাংলা নামে পরিচিত হয়ে উঠেন।
৩৫০ বছর পর ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে যদিও ঢাকা শহর প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু ইসলাম ধর্মের গোড়াপত্তন করেন, তিনি তার জীবদ্দশায় ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে। বর্তমানে বাংলাদেশে ইসলামের যে জ্যোতি বহমান তা ওলী-এ বাংলা হযরত শাহ খাজা শরফুদ্দিন চিশতি (রহ:) এর দ্বীন প্রচার শ্রমের ফসল। এ কারণেই তার মাজার এক পূণ্যময় স্থানে পরিণত হয়েছে।
মহান ওলী শুধু যে অজ্ঞ পথহারা মানুষদের মাঝে ধর্মীয় বাণীই পৌঁছাতেন তাই নয় বরং তাদের সামাজিক জীবনের ইসলামের সংহতির বীজ বপন করে দিতেন। ফলে এই এলাকায় ইসলামের দরজা দিনে দিনে ভীত মজবুত হয়। যা আজও ঢাকাবাসীর জন্য বিদ্যমান। তিনি সুদীর্ঘ ৩৪ বছর যাবত এই এলাকায় অবস্থান করে দীনের খেদমত করে গেছেন।
হিজরী ৭৩৮ মোতাবেক ১৩৪০ খ্রিষ্টাব্দে ওলী-এ-বাংলা ১১০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন(ইন্না লিল্লাহি—-রাজিউন)। তাঁর ভক্ত মুরিদান ও আশেকানগণ চিশতিয়া মহল্লার কবরস্থানের সন্নিকটে তাঁর হুজরার মধ্যে তাঁকে দাফন করেন। সেটিই আজ ওলী-এ-বাংলা হযরত শাহ খাজা শরফুদ্দিন চিশতি(রহ:) এর মাজার শরিফ। ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন সময়ে মাজারটির সংস্কার সাধিত হয়। এ মাজার সংস্কারে ঢাকার তৎকালীন নবাব আহসান উল্লাহ ও নবাব স্যার সলিমুল্লাহ বাহাদুর এবং ঢাকার প্রখ্যাত জমিদার মোহনী মোহন সাহাসহ বহু আশেকানের অবদান রয়েছে। বর্তমানে এই মাজার ও মসজিদ সংরক্ষণের দায়িত্ব সুপ্রীমকোর্ট এবং প্রধান বিচারপতি ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের উপর ন্যস্ত রয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট প্রাঙ্গনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে ৭৬ শতাংশ ভূমির উপর হযরত শাহ্ খাজা শরফুদ্দিন চিশতি (রহ:) এর মাজার মসজিদ কমপ্লেক্স অবস্থিত। হিজরী ৭৩৮ মোতাবেক ১৩৪০ খ্রিষ্টাব্দে এই মহান ওলীর ইন্তেকাল হওয়ার পর ধর্মপ্রাণ ভক্তরা গভীর শ্রদ্ধার সাথে মাজারটি সংরক্ষণ করে এসেছেন। এভাবেই ২৭২ বছর কেটে যায়। পরবর্তীতে ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে মোঘল সাম্রাজের আমলে ঢাকা শহরের প্রতিষ্ঠা হলে “চিশতিয়া মহল্লা’ এলাকাটি ঢাকা শহরের অন্তর্ভূক্ত হয়। এ সময়ের পূর্বের ২৭২ বছর মাজারটি তৎকালীন এলাকাবাসীর কাছে গভীর শ্রদ্ধার সাথে পুণ্যময় স্থানরূপে বিবেচিত হয়ে এসেছে। মোঘল আমলে ইসলাম খাঁ বাংলার সুবেদার নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি রমনা এলাকার এই স্থানে বাগ-ই-বাদশাহী” নামে এক সুরম্য বাগান তৈরী করেন। এ বাগানের একাংশে তিনি ওলী-এ-বাংলার মাজারটির উপর এক গম্বুজ বিশিষ্ট পাকা দালান নির্মাণ করেন। তার নির্মিত এ বাগানটি বর্গাকৃতির। বর্গাকৃতি এ দালানের মধ্য স্থানে হযরত শাহ খাজা শরফুদ্দিন(রহ:) এর মাজার অবস্থিত। মাজারসহ এই বর্গাকার দালানটি এখনো অক্ষুন্নরূপে বিদ্যমান রয়েছে। বর্তমানে মাজারটির চারপাশে সুরম্য মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। ১৯০৫ সালে মাজার এলাকাটি তৎকালীন বৃটিশ সরকার কর্তৃক আবাদ করে এখানে বাংলার ছোটলাটের বাসগৃহ নির্মাণ করা হয় যা ১৯৪৭ সাল পরবর্তী সময়ে ঢাকা হাইকোর্ট ভবনে পরিণত হয়। এ কারণেই ওলী-এ-বাংলার মাজারটি লোকমূখে হাইকোর্টের মাজার শরীফ” হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে।
এরপর ১৯৬৪ সালে ঢাকা হাইকোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ মাজারের সুষ্ঠু পরিচালনার স্বার্থে মাজারটির পরিচালনা কর্তৃত্ব গ্রহন করে।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, গবেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক