ছাবের আহমদ চৌধুরী
প্রতিটি মানুষকেই সৃষ্ঠিকর্তা বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। মাহাতা-পাঠনীকোঠা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা আসে শিক্ষাই শিক্ষিত হতে। কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, যেগুলো ছাত্রছাত্রীদেরকে শুধু পূথিগত শিক্ষা নয়, দেশপ্রেম, ধর্ম, সাহিত্য, সংস্কৃতি, খেলাধূলা মানবিক গুনাবলী ইত্যাদি বিষয়েও শিক্ষিত করে একটি পরিপূর্ণ শিক্ষার্থীরূপে শিক্ষিত করে তুলে। আনোয়ারা উপজেলায় মাহাতা-পাঠনীকোঠা আর্দশ উচ্চ বিদ্যালয় তাদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৭৪ সালে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে স্কুলের দীর্ঘভবন, বিশাল খেলার মাঠ, খোলামেলা পরিবেশ দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। এইটা যেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছোট্ট একটি গন্ডি থেকে বিশালতায় পদার্পণ, যা আমার হৃদয়কে প্রচন্ডভাবে নাড়া দিয়েছিল। ক্লাস নাইনে ছিলাম আমি নির্বাচিত ক্লাস ক্যাপ্টেন। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে ছিল কালাম, হামিদ, শহীদ, ফজলুল কাদের, জামাল উদ্দিন, শান্তিপদ, দুলাল, প্রদীপ, রাজিয়া, রূপনা, খালেদা, রতন, বাবলা চক্রবর্তী, রনজিত, ইউনুস সহ নাম না জানা অনেকেই।

আমাদের প্রিয় শিক্ষকদের মধ্যে জামাল স্যার, আজিজ স্যার, নুর হোসেন স্যার, সুনীল স্যার, দীপক স্যার, তুষার স্যার, এস এম কালাম স্যার, প্রত্যেকেই খুব স্নেহ করতেন। স্যারদের ঋণ কখনো শোধ করার মত না। ওই স্কুলের জমি দাতা ছিলেন পাঠনিকোঠা গ্রামের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক প্রফুল্ল চন্দ্র রুদ্র মাহাতা-পাটনীকোঠা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ছিলেন আতাউর রহমান খান কায়সার। ১৯৭৩ সালে মাহাতা পাঠনীকোঠা আর্দশ উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য মাহাতা গ্রামের এক তরুণ যুবক মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কমান্ডার মোহাম্মদ ইদ্রিস এর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে এই স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ালেখার যাত্রা শুরু হয়। এই মোহাম্মদ ইদ্রিস এর অবদানের কারণে ১৯৭৪সালে আমি ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। এরপর থেকে আমাদের ওষখাইন, মামুরখাইন, শিলালিয়া, তিশরী-গুজরা, পাঠনীকোটা, মাহাতা, তালসরা, পূর্ব কন্যারা, দেওতলা, খাসখামা সহ আশেপাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনায় মাহাতা পাঠনীকোঠা আর্দশ উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়ে আনোয়ারায় ঐ স্কুলটি শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে চট্টগ্রামে পরিচিতি লাভ করে। এই পরৈকোড়া ইউনিয়নের ওষখাইন গ্রামে শায়িত আছেন ১৮শতকের কবি, সাধক ও ৩৬ বছর জঙ্গলে সাধনা করে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে যার নাম লেখা হযরত শাহ্ আলী রজা প্রকাশ কানু শাহ্ (রাঃ) এর মাজার শরীফ। প্রতি বছর ১৪ জানুয়ারী ওরশ মোবারক অনুষ্ঠিত হয়।
পরৈকোড়ায় অবস্থিত রাজা রাজবল্লভের বাড়ি, বাংলাদেশের স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ্-দৌল্লাহর বিশ্বস্থ লোক হয়েও রাজা রাজবল্লভ, মীর জাফর ও ঘষেটি বেগম সহ অনেকে সিরাজউদ্দৌল্লার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন, সে রাজবল্লভের বাড়ী পরৈকোড়া গ্রামে। পরৈকোড়া ইউনিয়নে আছে যোগেশ চন্দ্র রায় ও প্রসন্ন বাবুর বাড়ী। ঐ জমিদার বাড়ীর সামনে প্রাচীন আমলের সুবিশাল দিঘী, অট্টলিকা বাড়ী, জলসাগর অন্দরমহল, সুদৃশ্য তোরণ ও নাচ গানের জলসা ঘর ভ্রমণ পিপাসুদের মনোমুগ্ধ করে। এই ইউনিয়নে আছে খান বাহাদুর আবদুস ছত্তারের বাড়ী যিনি চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালটি প্রথম পৌরসভার চেয়ারম্যান (বর্তমানে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন) উনার নামে আন্দরকিল্লায় কর্পোরেশন অফিসের ২য় তলায় কে.বি আব্দুস ছত্তার মিলানায়তন ও রহমতগঞ্জে কে.বি আব্দুস ছত্তার নামে একটি রাস্তার নামকরণ হয়েছে। এই ইউনিয়নে আছে মাষ্টারদা সূর্যসেনের অনেক অনুসারী।এই ইউনিয়নে আরো আছে চট্টগ্রাম জাকির হোসেন হোমিওপ্যাথিক কলেজের প্রতিষ্টাতা ডা: জাকির হোসেনের বাড়ি। আরো আছে ১৯৭১সালে ২৬ই মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার সময় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের দায়িত্বরত আবাসিক প্রকৌশলী মোসলেম খানের জন্ম ওষখাইন গ্রামে। জ্ঞানের আলোকে বিজ্ঞানের প্রত্যাশা নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামী মোহাম্মদ ইদ্রিসের প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারায় ঐতিহ্যে মন্ডিত মাহাতা-পাঠনীকোঠা আর্দশ উচ্চ বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৭৩সালে। বিভিন্ন বাঁধা অতিক্রম করে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ২০২৪সালে গৌরবময় ৫০ বছরের মাইলফলক স্পর্শ করেছে। এই স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ না পেলে হয়তো আমার পড়ালেখা করার সুযোগ হতো না। স্কুলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বন্ধুবান্ধবদের সাথে মিলেমিশে পড়ালেখা করতে খুব ভালো লাগত।এই স্কুল থেকে এস.এস.সি পাশ করার পর পটিয়া থানার হুলাইন ছালেহ্-নূর ডিগ্রী কলেজে ভর্তি হয়ে ঐখান থেকে পড়া লেখা শেষ করি। আমাদের পথ চলায় শৈশব-কৈশোরের মধুময় স্মৃতিকে ধারণ করে অনুষ্ঠিত হয়েছে আমাদের স্কুলের মহা-মিলনমেলা গত ২৮শে ডিসেম্বর ২০২৪ মাহাতা-পাঠনীকোঠা আর্দশ উচ্চ বিদ্যালয়ের বিশাল মাঠের প্যান্ডেলের নীচে, বন্ধুরা যেন আয়োজন উপভোগ করতে পারে, সেজন্য গত ৬মাস যাবৎ রাত দিন পরিশ্রম করে শৈশবের স্মৃতি নিয়ে যেন ফিরে যেতে পারে সে ব্যাপারে সকলের আপ্রাণ প্রচেষ্ঠা অব্যহত রেখেছিল।প্রত্যেকের প্রবল আগ্রহ ও আন্তরিক প্রচেষ্ঠায় বিশাল কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়ে বন্ধু-বান্ধবদের চেষ্ঠার কোনো কমতি ছিল না। অনুষ্ঠানের আয়োজক কমিটির বৈঠকের মূল ঠিকানা ছিল জিইসির মোড়ে আমার বন্ধু হামিদুল ওয়াহেদের অফিসে।ওখানে বসে সবাই নিজেদের ব্যক্তি জীবন ভুলে মহামলিনকে সুষ্ঠ এবং প্রাণবন্ত করার লক্ষ্যে অক্লান্ত প্রচেষ্ঠা চালিয়ে যায়।অতিথি কাকে করা হবে, ডেকোরেশন কেমন হওয়া উচিত, ষ্টেজ কেমন হবে, খাবারের মেন্যু কি রকম হওয়া উচিত, অনুষ্ঠানের কোন সময় কি হবে, প্রশাসনিক অনুমতি, পুলিশ প্রশাসনকে অবহিতকরণ, রেজিষ্ট্রেশনের বিভিন্ন কাজ সম্পাদন করা ইত্যাদি কাজ নিয়ে চলতে থাকা মহাযজ্ঞের ব্যাপারে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছি। ফেলে আশা শৈশবের স্মৃতি যেন ফিরে পেতে পারি সে ব্যাপারে আমার বন্ধু শহীদুল ইসলাম ও ফজলুল কাদের আপ্রাণ প্রচেষ্ঠা অব্যাহত ছিল। বন্ধু স্কুলের মাস্টার আবুল কালামের সাথেও প্রায় সময় যোগাযোগ হতো। অসংখ্যা স্মৃতি ঘিরে প্রথম স্কুলের অনুষ্ঠান করার পিছনে এই মহা-মিলনের মাধ্যমে আমাদের স্মৃতির মাঝে বেচে থাকলেই প্রত্যেকের এই ক্ষুদ্র পরিশ্রম স্বার্থক হয়েছে। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং সহযোগিতার মাধ্যমে আমাদের আয়োজন সফল হয়েছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। আমার লেখার মধ্যে কোন ভুলক্রটি হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্ঠিতে দেখে আগামী পথ চলা আরো সুগম করবে এই আশা ব্যক্ত করি। যুগে যুগে সভ্যতার বাক বদল হয়েছে তরুণদের হাত ধরেই। হে তরুণ! বিশ্বাস কর- তুমিই এ পৃথিবীতে কিছু করে যেতে এসেছ। জন্ম একটাই, কাজেই মৃত্যু তো অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু এমন ভাবনাহীন চিত্তে, জ্যোতির্ময় মৃত্যুর মাধ্যমে জেন-জি দেখিয়ে দিয়েছে হিমালয়সম অন্যায়ের চূড়া কীভাবে সততা, নৈতিকতা আর সাহসিকতার চাপে গুড়িয়ে দিতে হয়। ‘আগে কেবা প্রাণ করিবে দান, তারি লাগি তাড়াতাড়ি’ করে ‘দারুণ বিপ্লব-মাঝে’ এই জেন-জি যেন রূপকথার ফিনিক্স।