১৪ মে ২০২৪ / ৩১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / রাত ৮:৫৬/ মঙ্গলবার
মে ১৪, ২০২৪ ৮:৫৬ অপরাহ্ণ

আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির কৃষ্টিধারা সুফি সাহিত্যে অনবদ্য সংযোজন

     

বদরুননেসা সাজু

মাইজভাণ্ডারী গান বা মরমী সংগীত সমূহ অলি আওলিয়া স্মরণে বিরচিত শতোধিক বছরের এক মহান ঐতিহ্যধারা। ভক্ত অনুরক্ত আশিক প্রেমিক দ্বারা এ সকল আধ্যাত্মিক গান রচিত হয়। বিশেষ ঐশী অনুগ্রহ প্রাপ্ত বা অনুকম্পা প্রত্যাশী অনুসারীদের দ্বারা রচিত এই গানগুলো মাইজভাণ্ডারী গান নামে পরিচিত।
মাইজভাণ্ডার শরীফের ঐতিহাসিক কাল সমীক্ষায় দেখা যায়, সেখানে আবিভর্‚ত প্রসিদ্ধ অলি আউলিয়া স্মরণে মুরিদ-শিষ্য অথবা ঐশী দয়া প্রাপ্ত খলিফাদের কেউ কেউ এই গান লিখেছেন। আবার যারা ঐশ সত্তার অধিকারী হিসেবে অলি আওলিয়া বিশ্বাস করেন, যারা নিজেকে চিনেছেন এবং অলিআল্লাহর স্নেহভাজন হয়েছেন অথবা করুণাদৃষ্টি লাভ করেছেন-এমন অনেকেই মাইজভাণ্ডারী গান রচনা করেছেন। সাধারণত ঐশ সুনজর লাভের প্রত্যাশা জানিয়ে আকুতিমূলক মাইজভাণ্ডারী গান ও রচনা করতে দেখা যায়,- অনেক ভক্ত অনুরক্তকে। অর্থাৎ গানের সাধক মাইজভাণ্ডারী আশিক-প্রেমিকই এই গানের রচয়িতা।
সেই ৩০ এর দশকেই মাইজভাণ্ডারের সুফি সাধকদের অবদান ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের সশ্রদ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এ প্রসংগে তিনি মন্তব্য করেন: …….. ‘যুগে যুগে এমন সব সাধু পুরুষের আবির্ভাব ঘটিয়াছে যাঁহারা জগতের শত সহস্র মানুষের ভক্তি ও শ্রদ্ধা অর্জন করিয়াছেন। -সুফি সাধনায় মাইজভাণ্ডারী ধারার প্রবর্তক মাওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (১৮২৬-১৯০৬) ও সৈয়দ গোলামুর রহমান (১৮৬৫-১৯৩৭) এমন সাধু পুরুষদের মধ্যে শীর্ষ স্থানীয়। এই মহান সাধকদ্বয় এবং তাদের উত্তর পুরুষদের কেন্দ্র করে মরমী গানের যে ধারা প্রবহমান, তাই মাইজভাণ্ডারী বা ভাণ্ডারী গান নামে ব্যাপক সমগ্র-বঙ্গ ব্যাপী সুপরিচিতি লাভ করেছেন।’
সমগ্র বিশ্বের নানা প্রান্তে মাইজভাণ্ডারী গানে মাশুক-গুরুর প্রতি প্রেম ভক্তি প্রদর্শন করা হয়, একই সাথে গানের মাধ্যমে আত্মসংশোধনের প্রচেষ্টা ও সাধিত হয়। এরূপ বিশিষ্ট আধ্যাত্মিক সুরেলা মরমী সংগীত তথা মাইজভাণ্ডারী গানকে আরাধনার নিয়তে ধ্যানের অনুষঙ্গ হিসেবে ও চর্চা করা হয়। এইভাবে মাইজভাণ্ডারী গান লোকসংগীতের ধারায় পরিচিত এবং প্রতিষ্ঠিত হয়ে ক্রমান্বয়ে নিজস্ব নামে স্বতন্ত্র আসন লাভ করে।
মাইজভাণ্ডারী গানের প্রচার পরিচর্যা এবং পরিবেশনার প্রাথমিক পর্বে হযরত বাবাভাণ্ডারী কেবলা, ছোট মওলানা সৈয়দ আমিনুল হক ওয়াসেল এর অবদানও শ্রদ্ধাভরে স্বীকৃত এবং স্মরণীয়। যুগে যুগে মাইজভাণ্ডার শরীফের অলি আওলিয়া মনীষী সেই ধারাকে এগিয়ে নিয়েছেন। সেই পথ ধরে শাহসাহেব সৈয়দ নুরুল বখতেয়ার-এর যুগে তিনি ও আধ্যাত্মিক গানের অগ্রযাত্রায় আর ও প্রসারিত রাস্তা বিনির্মাণ করে মাইজভাণ্ডারী ঐতিহ্যের ঘরানা পৌঁছে দিয়েছেন সারা বিশ্বের নানা প্রান্তে।
ঐশ মহিমায় ভাস্বর সকল গুরুর পরিচিতি সর্বসাধারণের কাছে এরূপ মরমী গানের মাধ্যমে প্রচার করা হয়। তাই যে কোন মানুষ মাইজভা রে গিয়ে আপন সমস্যা সমাধানে আর্জি-ফরিয়াদ জানিয়ে উপকার লাভে সমর্থ হয়।
ইতোমধ্যে গীতিকার সুরকার লেখক হাকিম মওলানা ইকবাল ইউসূফ রচিত কিছু গানের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে “আতায়ে নূর গীত” -এর মধ্যে। এ গানগুলো পত্র পত্রিকা ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হলেও আগে পুস্তিকাভুক্ত হয়নি। তাই এগুলো একত্রীকরণের এবং সংরক্ষণের খুব দরকার ছিল। ‘আতায়ে নূর গীত’ এর মাধ্যমে সেই প্রয়োজনীয়তা পূরণ হল। আশা করি, এখন থেকে এই সংগীত মঞ্জরীর সুরসুধা একই সাথে পাঠক গায়ক শ্রোতা সবাই আস্বাদন করতে সক্ষম হবে। এ পুস্তিকায় বিশ্বঅলি শাহানশাহ জিয়াউল হক (ক.) মাইজভাণ্ডারী নিবেদিত ৪টি গানে/গজলে উর্দু আরবী ফার্সী শব্দের মিশ্রণ লক্ষ্যণীয়। এক সময় মাইজভাণ্ডার শরীফে উর্দু আরবী ফার্সী ভাষার চর্চা হতো। গীতিকার সেই ঐতিহ্যের স্মরণে সজ্ঞানে এই শব্দগুলো তাঁর গানে ব্যবহার করেছেন। সাধারণ গান না বলে গজল বললেই যেন এগুলোর ব্যঞ্জনা ও সুরসুধা সবাইকে আকর্ষণ করবে।
একটি ইংরেজি মাইজভাণ্ডারী গান এখানে সংযোজন করা হয়েছে। এটিকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম একটি সুসংগীত বলা যায়। কারণ এর আগে ইংরেজিতে ১টিও মাইজভাণ্ডারী গান রচনা হয়নি। সুফিতত্ত¡ গবেষণা ও মানব কল্যাণ কেন্দ্রের প্রীত সম্মেলনে দ্বৈত কণ্ঠে দু’জন ছেলে মেয়ে এ গান পরিবেশন করে উপস্থিত দর্শক শ্রোতাকে মুগ্ধ করেছে। তখন এই উপমহাদেশের বিখ্যাত ভৌত বিজ্ঞানী ড. জামাল নজরুল ইসলামের মাঝেও প্রীত হওয়ার মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে। ঐ গানটিতে ভক্তিভরে মাইজভাণ্ডার শরীফের অলিকুলের নাম ও তাঁদের মাহাত্ম্য উচ্চারিত হয়েছে।
আতায় নূর গীত এ শাহসাহেবের শানে রচিত কিছু সংগীত রয়েছে। পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও এগুলো ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। তাই পুস্তিকাভুক্ত ও একত্র বিন্যাস করে গীতিকার মুহম্মদ ইকবাল ইউসুফ এগুলোকে সুরারোপ করেন। এতে গায়ক- শিল্পীদের আরও সুবিধা হল। নিম্নে এগুলোর উপর কিছুটা আলোকপাত করা হয়েছে:
হাকিম মওলানা মুহম্মদ ইকবাল ইউসূফ, শাহসাহেব হজরত সৈয়দ বখতেয়ারকে ‘ত্রিকালদর্শী আহলুল্লাহ / সৃষ্টি কুলের হিতাকাংখি’ বলে উল্লেখ করেছেন। একজন অলিআল্লাহর মাধ্যমে মানুষ পার্থিব ও অপার্থিব চাওয়া পাওয়ার মধ্যে সংগতি রেখে কল্যাণ পেতে পারে। আবার অতিরিক্ত পার্থিব লোভ লালসা ও নফস প্রবৃত্তির কুধারণা থেকে আওলিয়া-মুর্শিদের সুনজরের ছায়ায় রক্ষা পাওয়া যায়। উক্ত ‘খোশখবর’ গানে হযরত বখতেয়ার শাহকে উদ্দেশ্য করে গীতিকার লিখেছেন:
ওয়াহাতুল ওজুদে ফানা
গাউছে  মাইজভাণ্ডারীর দিওয়ানা
রহমান রহিম রব্বানার
খলিল তিনি সুবহানাল্লাহ
……. ইজ্জত দৌলত যশ খ্যাতি/ সুখ শান্তি প্রতিপত্তি/ চাইলে নিয়ে বিশ্বাস ভক্তি/ দেবেন তিনি ইনশাল্লাহ। – (খোশখবর)
‘মহাসুসংবাদ’ নামের আরেকটি গজলে বেলায়তের বাগানে হজরত বখতেয়ার শাহকে ফুটন্ত সুর্যমুখী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। – যিনি কামেল দরবেশ অলিআল্লাহরূপে দাতার পূণ্যাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তাই বক্তপুর ভাণ্ডারে গেলে অর্থকড়ি যশখ্যাতি বিদ্যা বুদ্ধি সুখশান্তি পাওয়া যায়। “খাদেমুল ফোকরার কাছে গাউছে পাকের যে ধন আছে / সে ধন পেয়ে ধনী তিনি খেলাফতের মর্তবায়\ আনুগত্য সেবার গুণে জগতের কল্যাণ সাধনে/ আল্লাহর খলিল খেতাব দিলেন দয়াল বাবা শাহানশা’য়\” – (মহাসুসংবাদ)
মনকে ঊর্ধ্বমুখী করে তোলে
‘ভরসার গান’ – মওলানা মুহম্মদ ইকবাল ইউসূফ রচিত ভিন্নমাত্রার একটি গজল-গান। আল্লাহর রহমত পেতে বক্তপুর ভাণ্ডার শরীফে আসার জন্য এ গানের মাধ্যমে তিনি মানুষকে আহবান জানাচ্ছেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন, হজরত সৈয়দ নুরুল বখতেয়ার শাহের উসিলাতে মানুষের সৌভাগ্যের দুয়ার খুলে যাবে, মনের আশা নিশ্চয়ই পুরাবে এবং হতাশার জ্বালা মিটে যাবে। গানের তৃতীয় প্যারায় বলা হয়েছে- জগতের পাপ-পংকিলতায় হয়ে দিশেহারা/মুক্তি পেতে ভক্তি নিয়ে ছুটে আসে যারা / তাদের তরে নেয়ামত বরকত ইজ্জত আশীষধারা / স্বীকার করলে গোনাহগার/ জামিন পরওয়ারদেগার / উসিলাতে হজরত সৈয়দ নুরুল বখতেয়ার\ – (ভরসার গান)
মানুষ নিজের চরম ভুল ত্রুটিকেও অনেক সময় পাপ হিসেবে চিহ্নিত করে; সেগুলো থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আশায় নিজের মনকে ঊর্ধ্বমুখী করে তোলে। বিগত ভুলত্রটি বা কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা হলে ক্ষমা প্রার্থনায় শান্তি মিলে। – না হয় বিষন্নতা মনোবেদনায় অশান্তিতে দিনযাপন করতে হয়। কিন্তু একই রকম ভুল বারংবার না করার জন্য নিজের মন মানসকে পরিবর্তন করতে হবে। অর্থাৎ রিপুতাড়িত মানুষ অলিআল্লাহর উসিলায় প্রথমে নিজের কুধারণা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য চেষ্টা করতে হবে। সিদ্ধ সাধক মুর্শিদ-গুরু ঐশী আলোর অধিকারী বলে মানুষের কল্যাণ সাধন করতে সক্ষম হন। তাই সর্বযুগে মানুষ ভক্তি শ্রদ্ধায় অলিআল্লাহর মাজারের মাধ্যমে অথবা সাজ্জাদানশীন ঐশক্ষমতা প্রাপ্ত আওলাদ-বংশধরের সুদৃষ্টিতে উপকার লাভে সচেষ্ট হন। মওলনা মুহম্মদ ইকবাল ইউসূফের বিষন্নতার গান ইলতেজা। এর কয়েক স্তবক এখানে লক্ষ্যনীয়ঃ ….. সুখশান্তি দুনিয়াতে/পরকালে মুক্তি পেতে/ দয়া মাগি কর আশীর্বাদ\
….. আশা নিয়ে অন্তরে/ এলাম বক্তপুর ভান্ডারে / মিটাও বিষন্নতা অবসাদ। ইকবাল ইউসূফ দিশেহারা/ নাই যে গতি তুমি ছাড়া/ বিনয় করি শুন আর্তনাদ\ –
তব দ্বারে পেতেছি দু’হাত/ কুতুবুল ইরশাদ/ কবুল কর মম ফরিয়াদ\ – (ইলতেজা)
‘দয়া কামাই ল’ – চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত আরেকটি গান; যেখানে বলা হয়েছে রোগ থেকে অভাব থেকে মুক্তি পেতে এবং আরও যাবতীয় পারিবারিক সমস্যা থেকে রেহাই পেতে বক্তপুর ভাÐার শরিফে গিয়ে আরজি জানাতে। কারণ সেখানে কামেল দরবেশ-মস্ত বড় অলিআল্লাহ বসে আছেন দাতার পূণ্য আসনে। তাঁর কাছে গিয়ে –
‘মনের কথা খুলি বুঝাই ক’।… তোঁয়ার কথা ফেলাই দিত ন’। – (দয়া কামাই ল’)
সুফি সাধনার আলোক নির্যাস
মাইজভাণ্ডারী  তরিকার বাণী বাহক এবং প্রচারকের ভ‚মিকা পালন করার চেতনা থেকে জনাব মুহম্মদ ইকবাল ইউসূফ এরূপ মরমী সংগীত মঞ্জরী রচনা করেন। -এটি তাঁর অভিমত।
মাইজভাণ্ডারী সংগীতের ইতিহাসে প্রথম ইংরেজি গান রচয়িতা গীতিকার মুহম্মদ ইকবাল ইউসূফ। তিনি উক্ত সংগীতে গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী দ্বয় এবং তাঁদের সুযোগ্যতম আধ্যাত্মিক প্রতিনিধি হিসেবে যে সকল অলি আওলিয়ার নাম উল্লেখ করেছেন, হজরত সৈয়দ নুরুল বখতেয়ার শাহ তাঁদের সবারই মারফতী আশীর্বাদের প্রাবন শুভাশীষ – ধারায় ধন্য হয়েছেন। কারণ প্রেমাস্পদ গুরুর পায়ের ধূলা তুলতে কেঁদে কেঁদে অশ্রুধারায় গঙ্গা বানিয়েছেন তিনি! মুর্শিদের প্রেম-বাসরে আলো দিতে জ্বলেছেন সারা নিশি… দিনভর ….. সারাটি জনম!! সুফি কাব্যগীতে বিরহ জ্বালার সংস্থাপন প্রেমিক প্রেমাস্পদ বা আশিক মাশুকের অপূর্ব লীলা। হজরত বখতেয়ার শাহের প্রেমাস্পদ তাঁর কণ্ঠে প্রেমালংকার সুরের হার পরিয়েছেন। সেই সুরের ঝংকারে প্রাণ শীতলকারী তাঁর আঁখির চাহনিতে পাষাণ মনও গলে যায়। – তা দেখে পবিত্র অলিআল্লাহর সান্নিধ্যে মহাপবিত্র ঐশী প্রেম-পরশে অহংকার মুছে যায় দাম্ভিকের! নেপথ্যে মধুর সুর-শারাব ঢেলে তিনি মানুষের ঘুমন্ত সত্ত¡া জাগিয়ে দিতেন। তাইতো ভক্ত প্রেমিক দলে দলে হজরত সৈয়দ নুরুল বখতেয়ার শাহের আঙ্গিনায় সুর-সমাবেশে ভীড় জমাতো। সাড়া পড়ে যেত আশিক-ভক্তদের মাঝে ঐ অঙ্গনে আসার জন্যে। মওলানা মুহম্মদ ইকবাল ইউসূফ এরূপ আধ্যাত্মিক ফ্ল্যাটফরমে তাঁকে পীর মেনেছেন।
জীবনের সঠিক পথ খুঁজে পেতে, আত্মসংশোধন করে চলতে এবং অলি আওলিয়ার রহস্য অনুধাবনে প্রত্যেকের কাছে ‘আতায়ে নূর গীত’-পুস্তিকার মরমী সংগীতাবলী গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে করি। মাইজভাণ্ডারী দর্শনের মানসপুত্র হজরত বখতেয়ার শাহের একমাত্র ছেলে সৈয়দ নুরুল আতাহার আসিফের (ম.) ভাষায়: ‘বর্তমান সামাজিক অবক্ষয়ের যুগে অস্থির অস্থিতিশীল মানব চিত্তের জন্য উক্ত মরমী সংগীতের প্রকাশনা পুস্তিকাগুলো অলি আওলিয়ার প্রতি ভক্তি বিশ্বাসে শান্তির দিশা, ভোগ বিলাসিতামুক্ত আত্মনির্ভরশীল জীবন অন্বেষা এবং জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য কল্যাণ সাধনের সহায়ক। অন্যথা নৈতিক চরিত্র উন্নত না হলে, মানুষের কলুষিত আত্মার সুপথ প্রাপ্তি এবং সংশোধনের প্রয়াস না নিলে সুফি সাধনার আলোক নির্যাসের সন্ধান পাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে।’
আল্লাহর প্রেমে নিজকে নিয়োজিত করা সুফি সাধনার মূল কথা। কুরআন পাকের ২নং সূরা বাকারা-এর শেষ দিকের একটি আয়াতে উল্লেখ আছে- ‘আল্লাহর রঙে রঞ্জিত হও’। সুফি সাধনা ছাড়া আল্লাহর রঙে রঞ্জিত হওয়ার জন্য অন্য কোন পন্থা সত্যিকার অর্থে সৃষ্টি বা আবিষ্কার এখনো হয়নি। সুফি বলতে বুঝায় যিনি ঐশী জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে অন্তরের বিশুদ্ধতা ও পবিত্রতা অর্জন করেছেন। -এবং তা অর্জন করার প্রক্রিয়া। অর্থাৎ সুফিদের সাধনায় সিদ্ধি লাভের যে পথ বা তৎসম্পর্কীয় মতবাদ হল সুফিবাদ। আধ্যাত্মিক সাধক এবং সুফিদের জগত ও জীবন সম্পর্কীয় ধারণা হল সুফি জীবন দর্শন। এই দর্শন শাস্ত্র বলতে সত্যের সন্ধান লাভ এবং মিথ্যা থেকে দূরে অবস্থান করা বুঝায়। এটি একাধারে আত্মা কেন্দ্রিক, অপরদিকে ¯্রষ্টা প্রেম এবং তার সৃষ্ট অপরাপর জীবের প্রতি ও ভালোবাসা জাগায়।
আত্মপরিচয় জ্ঞানই মনোজগতের অন্ধকার বিনাশ করতে সক্ষম। মানুষের চেতন সত্ত¡া জাগ্রত হলে আত্মপরিচয় ঘটে। পীর মুর্শিদ গুরুকে বিশ্বাস ভক্তি ও জানার মাধ্যমে আত্মজ্ঞান লাভ হয়। এভাবে আল্লাহ ও রসুলুল্লাহকে (স.) চেনা যায় এবং সৃষ্টিকর্তার নির্দেশিত পথে চলা যায়।
আবার অন্তরালোকে সত্য অবলোকন করে সাধক এবং গীতিকারেরা যে মরমী সংগীত রচনা করেন, সেগুলো সুফিসাহিত্যে এক অনবদ্য সংযোজন। অনুরূপ বাংলাদেশের মাইজভাণ্ডারী সুফিধারার কৃষ্টি ঐতিহ্যের বিভিন্ন দিকের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে হাকিম মওলানা মুহম্মদ ইকবাল ইউসূফ রচিত উক্ত  মরমী সংগীত সমূহে। আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হিসেবে সঠিক সুর তাল বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে গীত এই মরমী গানগুলো বা সংগীত সমূহ মানুষের মাঝে ঐশী জীবনের আলো এবং বোধ শক্তি জাগিয়ে তুলছে
লেখক: বিভাগীয় প্রধান এবং সহকারী অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, মহিলা কলেজ , ৪৯ এনায়েত বাজার চট্টগ্রাম।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply