লামায় দু’সন্তানের জননী ধর্ষিত, থানায় মামলা আটক-২
মো.কামরুজ্জামান, লামা
লামায় দু’সন্তানের জননী ধর্ষিত, আটক ২ জন। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক পুন:স্থাপন মেনে নিতে পারেননি সমাজ। কতিথ সমাজ কর্তৃক গভীর রাতে গৃহচ্যুাত করায় ধর্ষিত হয় এই নারী। আটককৃত দু’জনকে আসামী করে থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী/০৩)এর ৯ (৩) মামলা রুজু হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ভিকটিম লামা পৌর সভা ৭নং ওয়ার্ড মধুঝিরি বাসিন্দা মালেশিয়া প্রবাসী মো: ইসমাইল এর স্ত্রী। বছর খানেক আগে পরকিয়া প্রেমে পড়ে প্রবাসীর স্ত্রী রাঙ্গামাটির এক যুবকের সাথে পালিয়ে বিয়ে করে। দু’ কণ্যা সন্তানের ভবিষ্যৎ ভেবে প্রবাসী ইসমাইলের সাথে স্ত্রীর সম্পর্ক পুন:স্থাপিত হয়। নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে তারা পরস্পরকে আবার পবিত্র সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ করেন। কিন্তু সকলের অগচোরে হওয়ায় সম্পর্কটি মেনে নিতে পারেননি সমাজ।
সর্বশেষ ২৫ ফেব্রæয়ারি রাতে প্রবাসী ইসমাইল স্ত্রীকে নিয়ে তার ঘরে উঠে। এসময় মধুঝিরি সমাজের একদল নারী-পুরুষ ইসমাইলের বাড়িতে গিয়ে তার স্ত্রীকে নষ্টা-খারাপ অপবাধ দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেয়। এক পর্যায়ে তাকে তার ৫ কিলোমিটার দূরে পিত্রালয়ে চলে যেতে বাধ্য করে। সমাজের লোকদ্বারা নির্ধারিত ভাড়া মোটর সাইকেলে যাওয়ার পথে রাত সাড়ে এগারোটায় সে ধর্ষিত হয় বলে থানায় অভিযোগ করে। ওই দিন গভীর রাতে ধর্ষনের সংবাদ পেয়ে লামা থানার পুলিশ অভিযুক্ত দু’জনকে আটক করেন।
বিষয়টি নিয়ে লামায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। ২৬ ফেব্রæয়ারি সাংবাদিক মানবাধিকার কর্মিরা প্রবাসী ইসমাইলের গ্রামে আশপাশের লোকদের সাথে কথা বলে ঘটনার বিষয় সমুহ জানার চেষ্টা করেন। সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন বান্দরবান জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক এম রুহল আমিন ও লামা উপজেলা শাখার সভাপতি মো.কামরুজ্জামান অনুসন্ধান করেন। অনুসন্ধানে জানাযায়, প্রায় দু’দশক পূর্বে ভিকটিম এর সাথে প্রবাসী ইসমাইলের বিয়ে হয়। তাদের দু’জন কণ্যাসন্তান রয়েছে। বছর খানেক আগে ভিকটিম অন্য এক যুবকের সাথে পালিয়ে বিয়ে করে। সেখানে শান্তি না পেয়ে, দু’কণ্যা সন্তানের ভবিষ্যৎ ভেবে সম্প্রতি ইসমাইলের সাথে নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে পুনরায় সংসার বাধে।
গ্রামবাসীরা জানায়, ভিকটিম ইতোপূর্বে অন্যের সাথে চলে যাওয়ায় তাকে সমাজচ্যুাত করা হয়। ২৫ ফেব্রƒয়ারি রাতে সমাজকে না জানিয়ে প্রবাসী ইসমাইল তার স্ত্রীকে পুনরায় ঘরে আনায় ক্ষুব্দ হন সমাজের কিছু লোকজন। ক্ষুব্দ সমাজের লোকের চাপে ইসমাইলের স্ত্রী ওই রাতেই একটি ভাড়া মোটর সাইকেল যোগে তার পিত্রালয়ে যাওয়ার পথে ধর্ষিত হয় বলে জানাযায়।
ধর্ষিতার স্বামী প্রবাসী ইসমাইল জানান, সে ২৫ ফেব্রæয়ারি নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে ভিকটিমকে তার স্ত্রী হিসেবে পুন মর্যাদা দিয়েছেন। ওইদিন সন্ধায় মাছ তরকারি নিয়ে তারা স্বামী স্ত্রী ঘরে গিয়ে চুলায় রান্না চড়ায়। এক পর্যায়ে সমাজের বেশ কয়েকজন নারী পুরুষ তাদের বসত ঘরে গিয়ে টেনে হেছড়ে তার স্ত্রীকে নষ্টা বলে বের করে দেয়ার চেষ্টা করে। এসময় চুলায় রান্নারত ভাত-তরকারিতে পানি ঢেলে তাও নষ্ট করে দেয় তারা (!)। ইসমাইল জানান, ওই সময় তার দু’ কণ্যা সন্তান ক্ষুধায় কান্না করছিলো। সমাজের অনেক নারী পুরুষের মারমুখি আচরণে তার সন্তানরা প্রচন্ড রকম ভয় পেয়ে যায়। এমন নিষ্ঠুর আচরণ না করার জন্য ইসমাইল ক্ষিপ্ত লোকজনকে বিনয়ের সাথে অনুরোধ জানান, কিন্তু উত্তেজিত লোকজন তাকে ধাক্কা মারলে সেও ভয় পেয়ে যায়। এর পর তার স্ত্রীকে গ্রামের বাসিন্দা খোকন নামের একজন মোবাইল ফোনে একটি ভাড়া মোটর সাইকেল ঠিক করে দেয়। সহযাত্রি হিসেবে প্রতিবেশি সাগর আহম্মেদ নামের এক যুবককে দায়িত্ব দেয়া হয়।
ভিকটিম জানান, মোটর সাইকেল চালক আমির হোসেন ও সহযাত্রি সাগর তাকে তার পিত্রালয়ে না নিয়ে পথে মধ্যে অন্য একটি (সাবেক বিলছড়ি) গ্রামে নিয়ে মোটর সাইকেলের তেল পুরিয়ে গেছে বলে নির্জনস্থানে রাস্তায় গাড়ি বন্ধ করে দেয়। এর পর মৃত্যু ভয় দেখিয়ে তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে, তারা দ্রæত মোটর সাইকেল নিয়ে চলে যায়।
পরে সে কিছুদূর গিয়ে একটি রিক্সায় চড়ে তার বান্ধীর বাসায় গিয়ে সবিস্তারিত জানায়। গভীর রাতে বান্ধবী সংবাদটি ভিকটিমের ভাই লামা কোর্টের এ্যাডভোকেট ইব্রাহিমকে জানালে, সে পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ রাত সাড়ে তিনটায় পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ড বাসিন্দা মোটর সাইকেল চালক আমির হোসেন (২৬) ও মধুঝিরি ৭ নং ওয়ার্ড বাসিন্দা সাগর আহম্মদ (১৯) কে আটক করেন। এদিকে ২৭ ফেব্রæয়ারি ভিকটিমকে বান্দরবান নিয়ে মেডিকেল চেকআপ করান পুলিশ।
২৬ ফেব্রæয়ারি ভিকটিমের স্বামী মো: ইসমাইল বাদী হয়ে এজাহার দাখিল করলে, লামা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হয়। আটককৃত ওই দু’জনকেই মামলার আসামী করা হয়।
এদিকে চাঞ্চল্যকর এই ঘটনায় স্থানীয়রা নানান মন্তব্য করছেন। ঘটনার জন্য দায়ি কারা? এমন প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। একজন নারী ভুল করেছে এবং সে ভুলের জের কি ধর্ষিত হওয়া? রাতের বেলা একজন নারীকে গৃহ থেকে বের করে দেয়া, সমাজের সিদ্ধান্ত কি সঠিক ছিলো?
৭ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর জানান, “ঘটনার তারিখে আমি বান্দরবান ছিলাম। তার পরেও যা শুনেছি, তা অত্যান্ত দু:খজনক এবং লজ্জাস্কর। সমাজের লোকেরা রাতের বেলা একজন নারীকে বের করে না দিয়ে কোন প্রতিনিধিদের জিম্মায় রাখতে পারতো; তা হলে এমন ঘটনা ঘটতো না’’।
মানুষ সমাজবদ্ধ প্রাণি হিসেবে কিছু নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলে, এটা সভ্যতার সূচনা লগ্ন থেকে অনাদিকাল ধরে চলে আসছে। কিন্তু নিয়ম, রীতি-নীতি সমুহ রাষ্ট্রিয় আইন ও মানবাধিকার পরিপন্থি হতে পারে না। কোন ব্যাক্তি বা সংঘবদ্ধ সমাজ কাউকে তার গৃহে অবরোদ্ধ করা বা গৃহ থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করতে পারেন না। একমাত্র দেশের প্রচলিত আইনে কেবল তা করতে পারেন। চুলায় রান্নারত ভাত-তরকারীতে পানি ঢেলে দেয়াও ন্যাক্কার জনক কাজ। এর ফলে কজন মানুষ হয়তো ওই রাতে না খেয়ে ছিলো।
ভিকটিমের বড় ভাই জানান, ধর্ষনের পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়েছে কতিথ সমাজ। যারা সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষার কথা বলে উছশৃঙ্খল হতে উৎসাহ দেয়; তাদের বিচার হওয়া দরকার। বিষয়টি নিয়ে তিনি আইনের দ্বারস্থ হবেন বলে জানান।
সব সময় যাদেরকে বিভিন্ন আত্মীয়র সম্পর্কে শ্রদ্ধা-সম্মান করতেন ইসমাইল এর শিশু সন্তানরা, সেই একই গ্রামের প্রতিবেশি মানুষগুলোর হীংসাত্বক আচরণ তাদের শিশু মানসে ভয়ানক প্রভাব পড়তে পারে; এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায়না। ধর্ষণের বিচার আইন করবে। কিন্তু সমাজের সবাইকে সচেতন হতে হবে, যেন বড় ধরণের কোন অপরাধ সংগঠিত হওয়ার পেছনে সমাজের সুরসুরি না থাকে।