২৮ নভেম্বর ২০২৩ / ১৩ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ / সন্ধ্যা ৭:৩৩/ মঙ্গলবার
নভেম্বর ২৮, ২০২৩ ৭:৩৩ অপরাহ্ণ

স্মার্টফোনের যাদুর ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ খেলাধুলা

 

     

 

মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন

স্মার্টফোন যেন আরেক পৃথিবী। তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশই নিজেদের ডুবিয়ে রেখেছে স্মার্ট ফোনের মধ্যে। স্মার্ট ফোনের যাদুর ছোঁয়া তরুন প্রজন্ম ছাড়িয়ে শিশুদের মধ্যেও বিস্তার লাভ করছে। কোন কোন পরিবারে পিতা-মাতা দু,জনই চাকুরিজীবি। আবার  কিছু অভিভাবক আছেন সকালে অফিসে যায় আর ফিরে আসেন সেই সন্ধ্যায়। কোন কোন দিন রাতও হয়। বাসায় শিশুটির ঠিকমতো সময় দেওয়ার সুযোগ হয়ে উঠে না। ফলে শিশুটির সময় কাটছে স্মার্টফোনে। নাম তার আরহান, বয়স ২ বছর ৭ মাস, ভালো করে মা-বাবা ডাকতে পারেনা। জানেনা সম্পর্কে কে, কি হয়। তবে স্মার্টফোন চালাতে পারে। স্মার্টফোন হাতে দিয়ে সারাদিন বসিয়ে রাখা যায় তাকে। সকাল থেকে সন্ধ্যা, আবার সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত মোবাইল হাতে নিয়ে নীরবে সময় কাটাচ্ছে সে। হাত থেকে মোবাইল নিলেই শুরু করে কান্নাকাটি। মোবাইল হাতে দিয়ে তাকে গোসল, কাপড় পড়ানো কিংবা খাওয়ানো যায়। মোবাইল ছাড়া যেন সে অচল। মুনতাসির এর বয়স ৫ বছর, বাবা চট্টগ্রাম শহরে চাকুরিজীবি। মা শিক্ষার্থী, ছেলেকে তেমন সময় দেওয়ার সুযোগ হয়ে উঠেনা তাদের। পেশাগত ও সাংসারিক কর্মব্যস্থতার মাঝে তাদের হারিয়ে যাচ্ছে সকাল থেকে সন্ধ্যা। পাশ্ববর্তী আত্মীয়-স্বজনদের বাসাতে ঘুরে-ফিরে সময় কাটছে মুনতাসিরের। তারও যেন মোবাইল ছাড়া চলে না। কোন খেলনা নয়, নয় কোন বাহানা, শুধু স্মার্টফোন চাই তার। শহরের পর গ্রামের শিশুরাও এখন মুনতাসির আর আরহানের মতো মোবাইল আসক্ত হয়ে পড়েছে। স্মার্টফোনের যাদুর ছোঁয়ায় তাদের সময় কাটছে রুমে বসে। ফলে তারা অপরিচিত থাকছে গ্রামীণ খেলাধুলার সাথে।

বাড়বকুণ্ডের নতুন পাড়া থেকে কাজী মোহাম্মদ হানিফ জানান, এক সময় গ্রামাঞ্চলে মাঠে-ঘাটে, পথে-প্রান্তরে শিশু থেকে বৃদ্ধরাও গ্রামীণ যেসব খেলায় মগ্ন থাকতো এখন আর সে সব খেলা তেমন চোখে পড়েনা। এসব খেলায় থাকতো শরীরচর্চা ও বিনোদন। শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সাধন হতো। গ্রামীণ এসব খেলায় থাকতো গ্রাম বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। যেমন কানামাছি ভোঁ-ভোঁ, যাকে পাবি তাকে ছোঁ, গোল্লা ছুট, দাঁড়িয়া বান্দা, কুতুকত, নুনতা বউছি, ডাংগুলি, মৌরগ লড়াই, মার্বেল, লাটিম ঘুড়ানো, ঘূড়ি উড়ানো, চাকা নিয়ে রাস্তায় দৌড়ানো,মেয়েদের লাফ দিয়ে রশি খেলা, পুতুল খেলা, বালিশ খেলা, সুঁই সুতা, জোড়-বিজোড়, হাড়ি ভাঙ্গা, ষোল ঘুঁটি, লুডু খেলা, বাঘবন্দী, উচ্চ লাফ, দৌড় ও সাঁতার ইত্যাদি। ছোটদের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলের বড়রাও মগ্ন থাকতো নানান খেলায় যেমন লাটিখেলা, বলীখেলা, নৌকা বাইচ,  উচ্চ লাফ, ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাটমিন্টন, ভলিবল এবং মেয়েরা ঘরে ঘরে চাউল উঠিয়ে রান্না করা খাবার বিতরন করতো। আর তৃপ্তি নিয়ে সে খাবার খেতো ছোট বড় সবাই। কখনো কখনো মাটি দিয়ে চুলা তৈরি করে পৌষ-মাঘে খেজুরের রস সংগ্রহ করে চলতো শিন্নি কিংবা সেমাই রান্না। কলা পাতার ঘর তৈরি করে সোনালু সহ রকমারি ফুলে বর-কনে সাজানো খেলা খেলতো গ্রামীণ শিশু মেয়েরা। সীতাকুণ্ডের ছোট দারোগার হাটস্থ তাহের-মনজুর কলেজের অধ্যক্ষ মুকতাদের আজাদ খান জানান, হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ এ খেলাগুলোতে বিনোদন ছাড়াও ছিল শিক্ষামূলক। খেলা থেকে শিশুরা বড়দের সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হয়, তা যেমন শিখতো ঠিক তেমনি ভাবে ছোটদের প্রতিও থাকতো স্নেহ, ভালোবাসা শিক্ষা। গ্রামীণ এসব খেলায় শিশুরা বন্ধুত্ব, ধৈর্য, শৃঙ্খলা, একতা, নেতৃত্ব ও নৈতিকতার প্রশিক্ষণ নিতো দারুণ ভাবে। গ্রামীন এসব খেলা আর আগের মতো চোখে পড়েনা। গ্রাম-বাংলার অধিকাংশ শিশু এসব খেলার সাথে অপরিচিত। শিশুদের এসব খেলার সেই স্থানটি আজ দখল করেছে স্মার্টফোন।

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply