২৬ এপ্রিল ২০২৪ / ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / রাত ৪:৩৬/ শুক্রবার
এপ্রিল ২৬, ২০২৪ ৪:৩৬ পূর্বাহ্ণ

ফজিলতপূর্ণ বরকতময় রজনী লাইলাতুল বরাত ও মাহে রমজানের প্রস্তুতি

     

হে আল্লাহ! আপনি নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর বংশধরদের ওপর রহমত বর্ষণ করুন যেরূপভাবে আপনি ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম ও তার বংশধরদের ওপর রহমত বর্ষণ করেছিলেন। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসিত সম্মানিত।
বছর ঘুরে আবারো আমাদের সামনে উপস্থিত মাহে লাইলাতুল বরাত। ইসলামি শরিয়তে শবে বরাত এর গুরুত্ব অপরিসীম। যে সমস্ত বরকতময় রজনীতে আল্লাহ্পাক তাঁর বান্দাদের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দান করেন শবে বরাত তার মধ্যে অন্যতম। তাফসীর-হাদিস ও বিজ্ঞ আলিমদের পরিভাষায় যাকে শাবানের মধ্য রজনী নামে অভিহিত করা হয়। যে রাতটি হলো শাবান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত।
শাবান মাসের ১৪ তারিখের এ রাতকে মুক্তির রাত বা নাজাতের রাত হিসেবে অবহিত করা হয়। যে রাতে আল্লাহর নির্দেশে তাঁর রহমতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। তাই শবে বরাত অনেক মর্যাদা ও বরকতপূর্ণ রাত। এ রাতে আল্লাহর কাছে পাপ থেকে মুক্তি কামনা করে প্রার্থনা করা হয়। ফারসি ভাষায় শব অর্থ রাত এবং বরাত অর্থ মুক্তি। শবে বরাত অর্থ মুক্তির রাত। এই রাতে মহান আল্লাহ মুক্তি ও মাগফেরাতের দরজা খুলে দেন সৃষ্টিকুলের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন। এটি নিঃসন্দেহে বরকতময় রাত। শাবান মাসের মধ্যবর্তী হওয়ায় হাদিসে এই রাতকে লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান তথা অর্ধ শাবানের রাত বলা হয়েছে।
পবিত্র শাবান মাসের ফজিলতপূর্ণ রাত-লাইলাতুল বরাত। লাইলাতুল বরাত আরবি শব্দ ফারসিতে বলা হয় শবে-বরাত। শব অর্থ রাত বরাত অর্থ ভাগ্য,সেই হিসেবে শবে বরাতের আভিধানিক অর্থ ভাগ্যরজনী। পবিত্র কুরআনে এ রাতকে লাইলাতুম মুবারাকাহ্-বরকতময় রজনি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হাদিস শরিফে রসুল (স.)-এ মহিমান্বিত রাতকে লাইলাতুন নিছফি মিন শাবান-শাবান মাসের মধ্যরজনি বলে উল্লেখ করেছেন। হাদিসের ব্যাখ্যাগ্রন্থসমূহ ও তাফসিরের কিতাবে এ রাতের আরো কিছু নাম উল্লেখ হয়েছে। যেমন-লাইলাতুল কিসমাহ্-ভাগ্যের রাত,লাইলাতুত তাজবিয-রিজিক বণ্টনের রাত,লাইলাতুল ফায়সালাহ্-তকদির নির্ধারণের রাত,লাইলাতুল আফউ-ক্ষমার রাত লাইলাতুল কারামি-দয়ার রাত,লাইলাতুত তাওবাহ্-তাওবার রাত ও লাইলাতুন নাদামাহ্-মিনতির রাত ইত্যাদি।
পবিত্র শাবান মাস আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদাপূর্ণ মাস। এ মাসকে রমজানের প্রস্তুতি মাস বলা হয়েছে। নবি করিম (স.)-অন্য মাসের তুলনায় এ মাসে বেশি নফল রোজা পালন করতেন। শবেবরাতের ফজিলত সম্পর্কে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেন,আমি রসুলুল্লাহ (স.)-এর সঙ্গে কোনো এক রাতে রাত্রিযাপন করছিলাম। এক সময় আমি তাকে বিছানায় না পেয়ে মনে করলাম-তিনি হয়তো অন্য কোনো স্ত্রীর ঘরে গিয়েছেন। আমি তাকে খুঁজতে বের হলাম। গিয়ে দেখি-তিনি জান্নাতুল বাকিতে কবরবাসীদের পাশে দাঁড়িয়ে অঝোর নয়নে কাঁদছেন। নবিজি আমাকে উদ্দেশ করে বললেন-হে আয়েশা! তুমি কি মনে করো আল্লাহর রসুল তোমার ওপর বেইনসাফি করেছেন? আমি বললাম-ইয়া রসুলাল্লাহ! আপনাকে বিছানায় না পেয়ে ধারণা করেছিলাম-আপনি হয়তো অন্য কোনো স্ত্রীর ঘরে গিয়েছেন। এরপর রসুল (স.)-বললেন হে আয়েশা! আজকের রাত সম্পর্কে তুমি জেনে রেখ মহান আল্লাহ এই রাতে দুনিয়ার প্রথম আকাশে অবতীর্ণ হয়ে দুনিয়াবাসীর ওপর তাঁর খাস রহমত নাজিল করেন। কাল্ব গোত্রের মেষের গায়ে যত পশম রয়েছে তার চেয়েও অধিকসংখ্যক বান্দাকে তিনি ক্ষমা করেন।
হজরত আলী (রা.)-সূত্রে বর্ণিত তিনি বলেন রসুলাল্লাহ (স.)-বলেছেন-যখন শাবানের মধ্যরজনি আসবে তখন তোমরা সে রাতে কিয়াম তথা নামাজ পড়বে রাত জেগে ইবাদত করবে এবং পরদিন রোজা রাখবে। কেননা সে দিন সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে এসে বান্দাকে এই বলে ডাকতে থাকেন–আছ কি কেউ ক্ষমা প্রার্থনাকারী যাকে আমি ক্ষমা করব। আছ কি কেউ রিজিক প্রার্থনাকারী যাকে আমি রিজিক দিব। আছ কি কেউ বিপদগ্রস্ত যাকে আমি বিপদ থেকে উদ্ধার করব। এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ ঘোষণা দিতে থাকেন। আল্লাহ এ পুণ্যময় রজনিতে অসংখ্য বান্দা-বান্দিকে ক্ষমা করেন তবে দুই শ্রেণির লোকের জন্য তাঁর ক্ষমার দ্বার বন্ধ থাকে। (এক) মুশরিক-যে তাঁর সঙ্গে অন্যকে উপাস্য বানিয়েছে (দুই) বিদ্বেষপোষণকারী যে তার অন্য মুসলমান ভাইয়ের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। আল্লাহর কাছে পাঁচটি রাত খুবই মর্যাদার। এর মধ্যে শবেবরাতের রাতও রয়েছে। হাদিস শরিফে এসেছে–নিশ্চয়ই পাঁচ রাত্রির দোয়া আল্লাহ কবুল করেন। (১) রজব মাসের প্রথম রাতের দোয়া (২) শবেবরাতের দোয়া (৩) শবেকদরের দোয়া (৪) ঈদুল ফিতরের রাতের দোয়া ও (৫) ঈদুল আজহার রাতের দোয়া।
পবিত্র শবেবরাত মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে উম্মতে মুসলিমার জন্য এক বিশেষ উপহার। তাই এ রাত সম্পর্কে আমাদের বিশেষ যতœবান হতে হবে। এ রাতের বিশেষ কিছু আমল হচ্ছে–(১) রাত জেগে ইবাদত করা। যেমন-নফল নামাজ কোরআন তেলাওয়াত, জিকির-আযকার, তাওবা-ইস্তিগফার ও দোয়া-দরুদ পাঠ করা ইত্যাদি। (২) ১৫ শাবান রাতে জেগে ইবাদত করা এবং পরদিন রোজা রাখা। (৩) সম্ভব হলে আপনজনদের কবর জিয়ারত করা ও দান-সাদকাহ করা। বন্ধুবান্ধব ও সকল মোমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করে দোয়া করা।
রসুল (স.)-নিজের জীবনে এ রাত বারবার পেয়েছেন আমল করেছেন। এ রাতে কী করতে হবে কীভাবে করতে হবে-তা তিনি উম্মতকে শিখিয়ে গেছেন। তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শই আমাদের হুবহু অনুসরণ অনুকরণ করতে হবে। এ রাতের অধিকাংশ ইবাদত নফল। এ রাতের নফল নামাজের ধরাবাঁধা কোনো নিয়ম নেই বরং অন্যান্য নফল নামাজের মতো দুই/চার রাকাতের নিয়ত করে সুরা ফাতেহার পর যে কেনো সুরা মিলিয়ে যত ইচ্ছা পড়া যেতে পারে। তবে অবশ্যই শতর্ক থাকতে হবে যে রাতভর নফল ইবাদত করে ফজরের নামাজ যেন কাজা না হয়। কেননা হাজার রাকাআত নফল নামাজের সাওয়াব কখনো একটি ফরজ নামাজের সমতুল্য হবে না। শবে বরাতে নফল ইবাদত-বন্দেগী করা অতি উত্তম। যত বেশী ইবাদত,যিকির-আযকার,তেলাওয়াতে কোরান হবে তত বেশি ভাল ও সাওয়াব পাওয়া যাবে।
মহিমান্বিত এই রজনীতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা পরম করুণাময়ের অনুগ্রহ লাভের আশায় নফল নামাজ,পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত,জিকিরে মগ্ন থাকেন। অনেকে রোজা রাখেন দান-খয়রাত করেন। অতীতের গুনাহের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা ও ভবিষ্যৎ জীবনের কল্যাণ কামনা করে মোনাজাত করেন। শবে বরাত মাহে রমজানেরও আগমনী বার্তা দেয়।
তবে এই মহিমান্বিত রাতে কোনোভাবেই রাস্তাঘাটে আনন্দ উৎসব অহেতুক ঘোরাঘুরি ও আতশবাজি ইত্যাদি করা উচিত নয়। এতে পবিত্রতাতো নষ্ট হবেই যে ব্যক্তি এসব অপকর্মে লিপ্ত থাকে তিনি অভিশপ্ত হন। যত সম্ভব একাগ্রচিত্তে নফল নামাজ পড়া কোরআন তেলাওয়াত জিকির-আজকার প্রিয় হাবিবের প্রতি দরুদ পড়া কান্নাকাটি করে নিজের গুনাহ মাফ করানো অন্যের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করা সর্বোপরি মহান আল্লাহ পাক ও তাঁর প্রিয় হাবিবের সন্তুষ্টি অর্জন করার মধ্যেই শবে বরাতের সার্থকতা।
মহানবী (সা.)-আরো বলেন-রজব আল্লাহর মাস শাবান আমার মাস আর রমযান আল্লাহর সকল বান্দাদের মাস। (মা‘সাবাতা বিস সুন্নাহ)। যে পাঁচটি রাতে বিশেষভাবে দোয়া কবুল হওয়ার ওয়াদা করা হয়েছে তার মধ্যে শবে বরাতের রাত একটি। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। হে আল্লাহ! তোমার করুণাধারায় আমাদের সিক্ত করো,আমাদের ইসলামী শরিয়ত মতে খালেস নিয়্যতে এবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে এই সৌভাগ্যের রজনীতে পবিত্র শবে বরাত পালন ও উত্তম আমলের তওফিক দিন। আমিন।লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply