২০ এপ্রিল ২০২৪ / ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / সন্ধ্যা ৭:১৭/ শনিবার
এপ্রিল ২০, ২০২৪ ৭:১৭ অপরাহ্ণ

বেপরোয়া চালক, চাকায় পিষ্ট প্রাণ

     

বেপরোয়া চালকদের কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটলেও চালকরা থামছেন না। আগের দিন ২৪ ঘন্টায় ২৫ জনের প্রাণহানির পর গতকাল রবিবারও নরসিংদীতে একটি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১২ জন। প্রতিদিনই সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘতর হচ্ছে। ঘর থেকে বের হয়ে গন্তব্যে না পৌঁছে লাশ হয়ে ফিরছে অনেক মানুষ। চালকের অসাবধানতা, অদক্ষতা, যানবাহনের যান্ত্রিক ত্রুটি, অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বহন, গাড়ির ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিযোগিতা, রাস্তার দুরবস্থাসহ নানা কারণেই বাড়ছে দুর্ঘটনা।

আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা আমাদের সবার দায়িত্ব। এটা যে কেবল সরকারি আইন করে প্রতিরোধ করা যাবে তা নয়। তিনি বলেন, আমি নিজে সড়ক দুর্ঘটনার একজন ভিকটিম। আমার স্ত্রী ১৯৯১ সালের পহেলা জানুয়ারি সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন এবং ২ জানুয়ারি মারা যান। তাই আমি জানি সড়ক দুর্ঘটনা কি জিনিস। আমি মনে করি সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করার জন্য সামাজিকভাবে সচেতন হতে হবে। চালকদের অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে এবং সরকারের পক্ষ থেকে চালক-হেলপারদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে চালক হেলপারদের ন্যূনতম একটা শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা সেই চিন্তা-ভাবনা করছি। সরকারের পক্ষ থেকে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার তা নিশ্চয়ই নেওয়া হবে।

দুইদিনে প্রাণ গেল ৩৭ জনের : সর্বশেষ গতকাল নরসিংদীতে মহাসড়কে চলাচল নিষিদ্ধ একটি সিএনজি চালিত অটোরিক্সাকে ওভাটেক করতে গিয়ে বাস ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখি ভয়াবহ সংঘর্ষে দুই পরিবারের ৭ জনসহ ১২ জন মাইক্রোবাস যাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত ১০ জন। ভৈরব হাইওয়ে থানা পুলিশের ইনচার্জ মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, মাইক্রোবাসটি অটোরিক্সাকে পাশ কাটিয়ে যাবার সময় বিপরীত দিক থেকে অগ্রদূত পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস দ্রুত বেগে এলে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে মাইক্রোবাসটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়।

আগের দিন ২৪ ঘণ্টায় সড়কে প্রাণ গেছে ২৫ জনের। ফরিদপুরের নগরকান্দায় শুক্রবার রাতে গ্যাস সিলিন্ডারবাহী কাভার্ড ভ্যানের সঙ্গে বেপরোয়া গতির যাত্রীবাহী বাসের সংঘর্ষের পর আগুন ধরে যায় দু’টি গাড়িতেই। এতে পুড়ে মারা যায় ১৩ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে দু’টি গাড়িরই চালক রয়েছেন। অন্যরা বাসচালকের সহকারী ও ১০ জন যাত্রী। এ দুর্ঘটনায় দগ্ধ ও আহত হয়েছেন ৩৩ জন। এ ছাড়া শুক্রবার রাত থেকে শনিবার রাত পর্যন্ত মাগুরা, গাজীপুর, নাটোর ও রাজশাহীতে সড়ক দুর্ঘটনায় আরও ১২ জন নিহত ও ৪২ জন আহত হন।

পুলিশ প্রধানের ভাষ্য : পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক ইত্তেফাককে বলেন, ‘যেহেতু চালকদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, সেহেতু আমরা প্রতি জেলার এসপিদের নির্দেশ দিয়েছি, চালক ও হেলপারদের প্রশিক্ষণ দিতে। সেখানে তাদের দায়িত্বশীলতা ও সচেতনতার বিষয়ে শেখানো হবে। তাদের ভিডিও চিত্র দেখিয়ে সমস্যাগুলো বুঝিয়ে বলা। এই প্রশিক্ষণ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। আমার বিশ্বাস এখান থেকে একটা ভালো ফল পাওয়া যাবে। আর এর বাইরে সীমিত জনবল দিয়ে এই বিশাল মহাসড়ক পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তারপরও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

বছরে গড়ে ২ হাজার মানুষের প্রাণহানি :পুলিশের হিসাবে, গত তিন বছরে গড়ে দুই হাজার মানুষের প্রাণ গেছে সড়ক দুর্ঘটনায়। তবে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, ২০১৬ সালেই ৪ হাজার ৩১২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ৬ হাজার ৫৫ জন। আহত হয়েছে প্রায় ১৬ হাজার মানুষ। আগের বছর প্রাণহানি হয় ৮ হাজারের বেশি মানুষের।

পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ। আহত হয়েছে তিন হাজারেরও বেশি মানুষ। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এক হিসাবে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে যাত্রাবাড়ী, দারুসসালাম ও বিমানবন্দর থানা এলাকায়। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৫ হাজার ৩ জন, আহত হয়েছে ৬ হাজার ১৯৭ জন। এসব প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বলা যায়— প্রতিদিন গড়ে ১৩ জনেরও বেশি মানুষ মারা যান।

২০১৪ সালের চিত্রও ছিল একই। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় ৮ হাজার ৬৪২ জন আর আহত হয়েছেন ২১ হাজার ৮৫৫ জন।

গবেষণায় দুর্ঘটনার ৯ কারণ : সম্প্রতি পিপিআরসি ও ব্র্যাকের গবেষণায় সড়ক দুর্ঘটনার নয়টি কারণ চিহ্নিত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালনা, চালকের প্রশিক্ষণের অভাব, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বিভিন্ন গতির যানের একই সড়কে চলাচল, সড়কের ধারে ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকাণ্ড, সড়কের নকশায় ত্রুটি, ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ, সড়ক নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতনতার অভাব ও পথচারীর ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ, দুর্ঘটনা ঘটিয়ে চালকদের পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি ও অপ্রতুল শাস্তির বিধান।

নিরাপদ সড়ক চাই-এর চেয়ারম্যান ও চলচ্চিত্রাভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন বলেছেন, সড়ক দুর্ঘটনার দায় একক কোনো সংগঠনের নয়। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সাধারণ মানুষ, সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, সংগঠন—সবারই দায়িত্ব রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব সরকারের। দেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রায় ৫০টির মতো কারণ রয়েছে। এর মধ্যে মহাসড়কে গাড়ি চালনার নিয়মগুলো না মানা, অদক্ষ ড্রাইভার, বিশেষ করে প্রশিক্ষণ ছাড়া হেলপার থেকে ড্রাইভার বনে যাওয়া, অশিক্ষিত ড্রাইভার, ওভারলোড, ওভারটেকিং, পুলিশের নানা অনৈতিক কাজে জড়িয়ে যাওয়া, গতি সম্পর্কে ধারণা না থাকা অন্যতম। তিনি বলেন, দুর্ঘটনার কারণে বছরে জিডিপির দেড় থেকে দুই শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply