২৮ মার্চ ২০২৪ / ১৪ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ / রাত ৯:১৩/ বৃহস্পতিবার
মার্চ ২৮, ২০২৪ ৯:১৩ অপরাহ্ণ

মন্ত্রী মহোদয়ের নজরদারী দাবী: কর্ণফুলীতে ৩৫ প্রকল্পের কাজ নিয়ে কানাঘুষা

     

 

বিশেষ প্রতিনিধি

কর্ণফুলী উপজেলায় বিভিন্ন চলমান প্রকল্প নিয়ে কানাঘুষা শুরু হয়েছে। গুজব ও সত্যতা খুঁজছে সাধারণ মানুষ । এদিকে এই অঞ্চলের জনপ্রিয় সাংসদ ও ক্লীণ ইমেজের মন্ত্রী সাইফুজ্জামান জাবেদ এমপি’র জনপ্রিয়তা নিয়েও কথা উঠছে। মন্ত্রী মহোদয়ের সাধারণ ভক্তরা চলমান প্রজেক্ট নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আমাদের প্রতিনিধি কর্ণফুলী উপজেলার বহু মানুষের সাথেে কথা বললে এই তথ্য বের হয়ে এসেছে। সাধারণ জনগণ এই উপজেেলার সকল কাজে মন্ত্রী মহোদয়ের নজরধারী দাবী করেছেন।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে চলমান ৩৫টি পিআইসি ও আরএফকিউ নামক উন্নয়ন প্রকল্পে নানা অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ওঠেছে। ফলে উপজেলায় অনিয়ম পরিলক্ষিত হচ্ছে সব ধরনের প্রকল্পে বাস্তবায়নে। উপজেলা চেয়ারম্যান তাঁর একক ক্ষমতাবলে একচেটিয়া ভাবে নিজ বাড়ির আশপাশেই একাধিক প্রকল্প দিয়েছেন। যেহেতু উপজেলা পরিষদের পরিপত্র অনুযায়ী নিয়মিত কোন প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটির সভা হয় না। পাঁচ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মেম্বারদের কাছ থেকে কোন প্রকল্প চাহিদা নেওয়া হয় না।
তালিকা অনুযায়ি ৩৫ প্রকল্পে ২০১৮-১৯ অর্থ বৎসরের রাজস্ব স্কীমের তালিকা সূত্রে জানা যায়, রাজস্ব খাতের ১ কোটি ৩৪ লক্ষ ৬১ হাজার টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন সড়ক উন্নয়নের নামে ২৫টি পিআইসি (প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটি বা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) ও ১০টি রেট ফর কোটেশন (আরএফকিউ) প্রকল্প তৈরি করা হয়। ২৫টি পিআইসি প্রকল্পের মধ্যে দুই লক্ষ টাকার প্রাক্কলিক মূল্যের ২২টি প্রকল্প। বাকি ৩টি পিআইসি প্রকল্প এক লক্ষ টাকা মূল্যের। এর মধ্যে পিআইসি তালিকার ১৪নং ক্রমিকে অস্তিত্ব মিলে ‘বলাকা প্রকাশন’ নামে দুই লক্ষ ১টি প্রকল্পের।এ ছাড়া ১০টি আরএফকিউতে রয়েছে ১০ লক্ষ টাকার ৭টি প্রকল্প। সাথে ৮ লক্ষ টাকার ১টি ও ৫ লক্ষ টাকার ১টি এবং ৪ লক্ষ ৬১ হাজার টাকার ১টি প্রকল্প মিলে মোট ৩৫টি। প্রকল্পের পিছনে বরাদ্দ দাঁড়ায় ১ কোটি ৩৪ লক্ষ ৬১ হাজার টাকা।
প্রকল্পের তালিকায় দেখা যায়, বড়উঠান ৭নং ওয়ার্ডের জাগির পাড়া ড্রেন নির্মাণ নামে দুবার প্রকল্প ওঠানো হয়েছে। একই প্রকল্প ক্রমিক নং ৮ ও ১০ দেখিয়ে ৪ লক্ষ টাকা বরাদ্দ কাটা হয়। একইভাবে পশ্চিম শাহমীরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মেরামত ও সংস্কার নামে ২৩ ও ২৪ নং ক্রমিকে পরপর দু’বার প্রকল্প দেখানো হয়। একটি প্রকল্প দুই লক্ষ টাকার আরেকটি ১ লক্ষ টাকার। এমনকি ৩৫ প্রকল্প বাস্তবায়নের জায়গায় সড়কের পুরাতন ইট ও মালামালের কোন হিসাব নেই মন্তব্যের ঘরে। অথচ তালিকা যাচাই বাচাই করে এতে স্বাক্ষর করেন কর্ণফুলী উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরী, উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহিনা সুলতানা ও উপজেলা প্রকৌশলী মো. গোলাম মোস্তফা।
উপজেলা প্রকৌশলী মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘আমি আসলে উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) প্রকল্প ও কাজ দেখি। পাশাপাশি উপজেলা পরিষদের সড়ক উন্নয়নের প্রকল্প সমূহও দেখতে হয়। পিআইসি ও আরএফকিউ তালিকা যাচাই বাচাই করার পরও কিভাবে ডাবল প্রকল্প ওঠেছে বিষয়টি বুঝছি না। এক এলাকায় ২১টি প্রকল্প ও একটি প্রকাশনের নামে উপজেলা পরিষদ কি কিনেছে তাও মনে পড়ছে না। তবে, প্রকল্পগুলো তৈরি করে নাম দেয় উপজেলা পরিষদ। তারপরেও এলজিইডি অফিসের সহকারি প্রকৌশলী হয়তো কিছু জানাতে পারবেন। কাগজ দেখে বিস্তারিত বলতে পারব।’তালিকায় বেশির ভাগ বড় বাজেটের বরাদ্দ ও প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে বড়উঠান ইউনিয়নের দক্ষিণ শাহমীরপুর গ্রামে।
স্থানীয়রা বলেছেন, জেলা পরিষদ গ্রামীণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে থাকে জনস্বার্থে। একই প্রকল্প বার বার দেয়া মানে সরকারি অর্থের অপচয় হয়েছে। এতটুকু রাস্তা নির্মাণে লক্ষ লক্ষ টাকা বরাদ্দ মানে চরম দুর্নীতি। এছাড়াও জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাদ দিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নিজের এলাকায় একের পর এক প্রকল্প দেয়া মানে জনপ্রতিনিধিদের নীতিরও বৈষম্যকরণ! সবচেয়ে অবাক করা বিষয়, তালিকায় দেখা মিলে ৩৫ প্রকল্পের ২১টি প্রকল্পই বাস্তবায়িত হচ্ছে উপজেলা চেয়ারম্যানের নিজ বাড়ি বড় উঠান এলাকায়। অবশিষ্ট প্রকল্পে শিকলবাহা ইউনিয়নে ৬টি। চরলক্ষ্যা ইউনিয়নে ৫টি ও চরপাথরঘাটা ইউনিয়নে ২টি প্রকল্প। এতে জুলধা ইউনিয়নের ভাগ্যে কোন প্রকল্পই জুটেনি। পক্ষপাতদুষ্ট এসব প্রকল্প দেখে জনপ্রতিনিধিদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কেননা, বরাদ্দ পাওয়া অর্থের দিক হতে প্রতিটি ইউনিয়নে সমবন্টন-সমন্বয় হয়েছে কিনা নজর দিলে বৈষম্যমূলক চিত্রই শুধু চোখে পড়ে। যেমন: ২১টি প্রকল্পে বড়উঠান ইউনিয়ন বরাদ্দ পায় ৮৩ লক্ষ ৬১ হাজার টাকা। দুই প্রকল্পে চরপাথরঘাটা ইউনিয়ন ৯ লক্ষ টাকা। ছয় প্রকল্পে শিকলবাহা ইউনিয়ন ১১ লক্ষ টাকা। আবার পাঁচ প্রকল্পে চরলক্ষ্যা ইউনিয়ন ২৯ লক্ষ টাকা বরাদ্দ পান। বাকি দুলক্ষ টাকা একটি প্রকাশনের নামে ঠাঁই পেয়েছে। এ প্রকল্পে সরকারি টাকায় কি ক্রয় করা হয়েছে। ক্রয় আইন ও বিধিমালা মানা হয়েছে কিনা, না নিম্নমানের কোন সামগ্রী ব্যবহারের জন্য কেনা হয়েছে তা তালিকায় স্পষ্ট করা হয়নি।
পর্যালাচনায় আরো দেখা যায়, মোট বরাদ্দ ১ কোটি ৩৪ লক্ষ ৬১ হাজার টাকা থেকে ৬২% টাকা বা বরাদ্দ পেয়েছে বড়উঠান ইউনিয়ন শাহমীরপুর। জুলধা ইউনিয়ন ফাঁকা। এসব প্রকল্পে আবার বড়উঠানের ৫নং ওয়ার্ডে এক সাথে ৬টি প্রকল্প। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট একই ইউনিয়নের ৪, ৬, ৭ ও ৮ নং ওয়ার্ড পেয়েছে ১৫টি প্রকল্প। যার বেশির ভাগ প্রকল্প উপজেলা চেয়ারম্যানের বাড়ির আশেপাশের এলাকায় বলে স্থানীয়রা জানান।
এ বিষয়ে জুলধা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রফিক আহমেদ বলেন, ‘রাজস্ব খাতের পিআইসি আরএফকিউর প্রকল্পে প্রায় এক কোটি ৩৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দে জুলধা একটা টাকাও বরাদ্দ পায়নি। কেন পায়নি সেটা আমি জানি না। জুলধার একটা সড়কও তালিকায় নেই এখন জানলাম। উপজেলা গিয়ে খবর নিয়ে দেখব কেন জুলধায় বরাদ্দ পায়নি।’ অপরদিকে, একই উপজেলায় বড়উঠান ইউনিয়নের দক্ষিণ শাহমীপুরের ৫নং ওয়ার্ডে একটি সড়ক তৈরি করতে গিয়ে একান্ত ব্যক্তিস্বার্থে পাশে গাইডওয়াল দিয়ে পাকা রাস্তা করা হয়েছে উপজেলার চেয়ারম্যানের শ্বশুরবাড়ির প্রায় ৪০ ফুট সড়ক। ব্যয় করা হয়েছে সরকারি অর্থ।
এছাড়াও চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের চরফরিদ গ্রামে সরকারি বরাদ্দে শুধুমাত্র বাড়ির লোকজনে চলাচলের জন্য ‘সুলতান ভান্ডার বাড়ির সড়ক’ আরসিসি দ্বারা ঢালাই দেয়া হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে পরিষদের দেড় লক্ষ টাকার বরাদ্দ খরচে ৫ ফুট প্রস্থে ১৫০ ফুটের ব্যক্তিগত সড়কটি পাকাকরণ করা হয়েছে।এটি বাস্তবায়ন করেন কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদ। সহযোগিতায় ছিলেন ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য জয়নাল আবেদিন নবী। বরাদ্দের খাত দেখানো হয় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকমাস আগে বসানো স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব সাইফুজ্জামান চৌধুরী (জাবেদ) এমপি’র নাম অঙ্কিত ফলকটিও উধাও হয়ে গেছে। অথচ সড়কটি পাকাকরণ করা হয় সরকারি বরাদ্দে! জানতে চাইলে ইউপি সদস্য জয়নাল আবেদিন নবী বলেন, ‘এসব এডিপি প্রকল্পের রোলসে নাকি স্থানীয় মেম্বারদের সভাপতি করার নিয়ম রয়েছে। তাই ওই প্রকল্পে আমাকে সভাপতি করা হয়েছে সত্য। তবে কাজটি আমি করিনি। কাজটি ইউনিয়ন পরিষদেরও না। এটা উপজেলা পরিষদ ইউনিয়ন আ.লীগ নেতা রফিক ভাইকে দিয়ে করিয়েছেন। ব্যক্তিগত সড়ক সেটাও ঠিক আছে। তবে কাজ করেছে। ওটার ফলকে ৯নং ওয়ার্ড লিখলেও কাজটি হয়েছে মূলত চরলক্ষ্যা ২নং ওয়ার্ডে। মন্ত্রী সাহেবের ফলক যে তোলে নিয়েছে সেটাও আমি জানি না। বিষয়টি খুব দুঃখজনক।’
ওদিকে, দক্ষিণ শাহমীপুর এলাকার সংরক্ষিত মহিলা ইউপি সদস্য ছানোয়ারা বেগম বলেন, ‘আসলে সড়কের বিষয়ে মন্তব্য করে আমি ঝামেলায় পড়তে চাইনা। এটা কোন প্রকল্প থেকে কাজ হয়েছে আমি বলতে পারব না। আসলেই আমি জানিনা।’ স্থানীয়রা বলেছেন, তাদের পরিবারের সদস্য ছাড়া অন্য কেউ এসব রাস্তায় চলাচল করেন না। মূলত, অন্যান্য জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাদ দিয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে এসব বাড়ির ভেতরে পাকা রাস্তা করায় ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এলাকাবাসী। স্থানীয়রা প্রথমে জানতেন এসব সড়ক ব্যক্তিগত অর্থে পাকা করা হচ্ছে। পরে জানতে পারেন এসব সরকারি প্রকল্প।
অনিয়ম আর অভিযোগের বিষয়ে জানার জন্য এই রিপোর্ট লেখাকালীন সময়ে পরপর ৩বার ফোন করা হয় এবং ফোন রিসিভ না হলে মুঠো ফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয় উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরীকে। তাঁর থেকে সাড়া না পাওয়া বিস্তারিত তথ্য জানা যায়নি।
এই বিষয়ে জানার জন্য উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান দিদারুল ইসলাম চৌধুরীকে ফোন করা হলে তিনি বলেন এই নাম্বারটি কী আপনার ? আমি এখন এয়ার পোর্টে মন্ত্রী মহোদয়েের সামনে আছি । আপনাকে পরে জানাব।
উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান বানাজা বেগম বলেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী (জাবেদ) এমপি’র নাম অঙ্কিত ফলকটিও উধাও হবার খবরটি আমি জানি না। এসব বিষয়ে আপনি ঊপজেলা চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলেন।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহিনা সুলতানা বলেন, ‘সরকারি টাকা কখনো ব্যক্তিগত ভাবে ব্যবহার হয় না। যদি আরো কিছু স্পিসিপিক জানতে যান আপনি উপজেলায় আসতে পারেন। কেননা আমার তো সব রাস্তার নাম মুখস্ত নাই। তাই বলতে পারছি না। আর রাজস্বের ব্যাপারের বিষয়টি মনেহয় আপনি উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে জানলে ভালো হয়। কারণ পরিষদ সংক্রান্ত বিষয়ে বক্তব্য নিতে হবে উনার। আর প্রশাসনিক কোন কথা থাকলে আমি জানাতে পারব।’ জেলা স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক বদিউল আলম জানান, ‘‌সরকারি টাকায় কখনো কারো ব্যক্তিগত সড়ক করা যাবে না। আর অনিয়মের বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখব।’

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply