২০ এপ্রিল ২০২৪ / ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / সকাল ৬:০৭/ শনিবার
এপ্রিল ২০, ২০২৪ ৬:০৭ পূর্বাহ্ণ

৮০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি চট্টল নন্দিত কবি বিপিন বিহারী নন্দী

     

সোহেল মো. ফখরুদ-দীন

চক্রশালা প্রাচীন চট্টগ্রামের বিখ্যাত প্রাচীনতম শহর। চক্রশালার আশপাশ এলাকাগুলোয় প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের অগ্রগতিতে এ এলাকার কবি সাহিত্যিকদের ভূমিকা ছিল। উজিরপুরের জঙ্গলখাইন তাদের অন্যতম একটি এলাকা। বাংলা সাহিত্যের অগ্রগতির একটা মাইলস্টোন হল পরাগলী মহাভারত ও ছুটি খানের নির্দেশে মহাভারতের “অশ্বমেধযজ্ঞের” বাংলা অনুবাদ। পঞ্চদশ শতকে কবীন্দ্র পরমেশ্বর ও জঙ্গলখাইনের শ্রীকর নন্দীর অনুদিত মহাভারতের বাংলা অনুবাদ সমগ্র বাংলা সাহিত্যে প্রভাব বিস্তার করেছিল। চক্রশালা নিবাসী এ কবীন্দ্র পরমেশ্বর সতেরশ শ্লোকে পূর্ণ প্রাচীন চট্টগ্রামের ভাষায় উক্ত পরাগলী মহাভারত রচনা করেন।
চক্রশালার মনীষীরা সপ্তদশ শতকে আরাকানের রাজসভায় এ কবিদের দ্বারা একচ্ছত্রভাবে প্রভাবিত হত। তখন রাজসভার প্রধান অমাত্য চক্রশালা নিবাসী কোরেশী মাগন ঠাকুর (মাগন ঠাকুর নিজে একজন উচ্চ মাপের কবি ছিলেন)। চক্রশালার প্রাচীনত্ব নিয়ে বিখ্যাত চট্টগ্রাম গবেষক ও ইতিহাসবিদ চৌধুরী শ্রী পূর্ণচন্দ্র দেব বর্ম্মা তত্ত্বনিধি ১৯২০ সালে তাঁর গবেষণায় পটিয়ার চক্রশালা চীন পরিব্রাজক ফাহিয়ান উল্লেখিত বুদ্ধদেবের উপবেশন স্থানে হাইদগাঁও (হস্তিগ্রাম) মৌজাস্থিতকে দেড় হাজার বছরের প্রাচীন “ফো” বা মঠ-ইহা ফোরাচিঙ্গি বা বুদ্ধ সঙ্ঘ নামে প্রসিদ্ধ স্থান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আদি প্রাচীন এ সমৃদ্ধ শহরের কিছুই আজ নেই। শুধু ইতিহাসের পাতায় পাতায় সোনালী অধ্যায়গুলো লেখা; আমরা ভুলতে বসেছি সেই অধ্যায়ের সাথে জড়িত কর্মবীরদের কাহিনী। আজ সেই রকম ভুলে যাওয়া এক কর্মবীরের ৮০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কবি সাহিত্যিক বিপিন বিহারী নন্দীকে প্রজন্মের কাছে নতুন করে তুলে ধরতে চেষ্টা মাত্র আমার। আমাদের প্রাচীন সাহিত্যের ইতিহাসে যাঁরা চট্টলার সন্তান হয়েও সমগ্র ভারতবর্ষের সাহিত্যকে আলোকিত করেছিলেন তাঁদের মধ্যে চট্টগ্রামের কৃর্তিমান পুরুষ কবি বিপিন বিহারী নন্দী অন্যতম। তিনি একাধারে সাহিত্য, সংস্কৃতি, কবিতা ও দেশ উন্নয়নমূলক কাজে অভূতপূর্ব ভূমিকা রেখেছিলেন। ক্ষণজন্মা এ পুরুষের পিতাও ছিলেন ভারতের বিখ্যাত জমিদার ও প্রাচীন কায়স্থ বঙ্গীয় প্রাচীন কবি অখিল চন্দ্র নন্দী। কবি বিপিন বিহারী নন্দী প্রাচীন পটিয়ার উজিরপুর ইউনিয়নের জঙ্গলখাইন গ্রামের দেশবিখ্যাত জমিদার ও প্রাচীন কায়স্থ পরিবার, বঙ্গীয় প্রাচীন সংস্কৃতি কবি সন্ধ্যাকর নন্দীর বংশে ১৮৭০ খৃস্টাব্দে ২৫ জানুয়ারি, ১২৭৬ বঙ্গাব্দ ১৩ মাঘ কৃষ্ণা নবমী তিথি বিশাখা নক্ষত্রে জন্মগ্রহণ করেন। কবি বিপিন বিহারী নন্দীর মাতার নাম রাজকুমারী দেবী। কবির স্ত্রী বারতী দেবী। ইতিহাস গবেষকদের গবেষণা মতে অযোধ্যার তামস নদীর তীরে কবির পূর্ব পুরুষগণের আদি নিবাস। বৃন্দ্য নন্দী নামে তাঁদের পূর্বপুরুষ প্রাচীন কোন সময়ে চট্টগ্রামের জঙ্গলখাইনে চাঁনখালী নামক নদীর তীরে নতুন বসতি স্থাপন করেন। বৃন্দ্য নন্দীর দুই ছেলে ছিলেন অখিল ও রসিক নন্দী। চট্টগ্রাম দক্ষিণ অঞ্চলের কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ হতে রামু পর্যন্ত দুজনেরই জমিদারী ছিল। জমিদারী প্রথা বাতিল হলেও আজও নন্দী পরিবারের ঐতিহাসিকভাবে জমিদারের ডাকহাক রয়েছে। ভারত কলিকাতার বিখ্যাত পার্লামেন্ট গবেষক ও লেখক শ্রী হরেশ চন্দ্র ব্যানার্জীর সাথে আমার পরিচয় হয় ভাষা আন্দোলন জাদুঘরের পরিচালক প্রফেসর এম আর মাহবুবের মাধ্যমে। শ্রী ব্যানার্জীর সাথে ফোনে মাঝে মাঝে কথা হয়। ২০০৮ জানুয়ারিতে শ্রী ব্যানার্জী আমাকে অনুরোধ করেন আমার দেশের বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক বিপিন নন্দীর বাড়ি ও সমাধির ছবি এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের ছবি পাঠাতে। আমি এক কথায় পাঠাবো বলেই রাজি হলাম। এরপর থেকে আমি পুরনো পত্রিকা পরিচিত কবি ও গবেষকদের মাধ্যমে বিপিন বিহারীর বাড়ির ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কর্তৃক প্রকাশিত মাসিক পটিয়ার (বর্তমান সাপ্তাহিক পটিয়া) মার্চ সংখ্যায় কবির পরিচিতির সন্ধান পায়। সেই সূত্র ধরে ৯ জুলাই ২০০৮ সকালে পটিয়ার কৃতী সন্তান সাংবাদিক ওমর ফারুককে নিয়ে আমি জঙ্গলখাইনের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের বাসা থেকে বের হই। দুপুর ১২টায় লবণ নগরী খ্যাত ইন্দ্রপুল-এ নেমে ব্রীজের দক্ষিণ পাশে চানখালী খালের পাড় হয়ে মাটির রাস্তায় (কাদাযুক্ত) পায়ে হেঁটে প্রায় দুই মাইল দক্ষিণে নন্দীর বাড়িতে পৌঁছি। এমনিতে বর্ষাকাল তার উপর বৃষ্টি। জুতা হাতে নিয়ে যখন কবির বাড়ির পুকুর পাড়ে পৌঁছলাম তখন আমার মনে পড়ল আমাদের দেশের প্রধান ও বিখ্যাত কবি শামসুর রাহমানের লেখা কবিতা, তিনি মৃত্যুর দিন নিয়ে লিখেছেন: “যেদিন মরবো আমি, সেদিন কি বার হবে, বলা মুশকিল। শুক্রবার? বুধবার? শনিবার? নাকি রবিবার? যে বারই হোক সেদিন বর্ষায় যেন না ভেজে শহর, যেন ঘিনঘিনে কাদা না জমে গলির মোড়ে। সেদিন ভাসলে পথঘাট, পুণ্যবান শবানুগামী বড়ো বিরক্ত হবেন।”
নন্দীর বাড়িতে ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়ে কবির সময়ে নির্মিত বিশাল এক প্রাচীন মন্দির। তার পাশে কবির পারিবারিক শ্মশান। এতে দুইটি সমাধি রয়েছে। একটি কবির পিতার অন্যকি কবি বিপিন বিহারী নন্দীর। দুইটি সমাধিতেই কবির লেখা কবিতা শোভা পাচ্ছে, শ্বেত পাথরে।
আর একটু ভিতরে ঢুকলেই জমিদার বাড়ির বড় উঠান। এর সাথে একটি প্রাচীন বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। ভিতরে ঢুকলেই কাঠের তৈরি বিশাল বাড়ি। বসবাসরত লোকজন জানান ১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড়ে নষ্ট হওয়ার পর এ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িতে কিছু লোকজনের বসবাস দেখা যায়। তবে জমিদারী নেই কিন্তু রীতিনীতি আজও লক্ষণীয়। মেহমানদারীর নিয়মেই বুঝতে নষ্ট হয় না, তাঁরা কত বড় জমিদার।
বাড়িতে বসবাসরত লোকজন তেমন কিছু জানেন না কবি সম্পর্কে। তাঁরা বলেন, নন্দী বাবু বড় বাপের লোক ছিল। তিনি অনেক জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তি। শিক্ষা বিস্তারে তার অবদান রয়েছে। বিপিন বিহারী নিজ এলাকাতে একটি প্রাইমারী বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এলাকার লোকেরা জানান বিদ্যালয়টি বর্তমানে অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে একটি কুচক্রী মহল। এলাকাবাসী আরো জানান কবি বিপিন বিহারী নন্দী পটিয়া ইন্দ্রোপুল থেকে, ট্যাংগাপুল পর্যন্ত সড়ক নিজ জমিদারীর অর্থ দিয়ে তৈরি করেন।
পটিয়ার সাবেক মহকুমা-চন্দ্রনাইশসহ এসব এলাকাতেই অনেক নামী ও গুণী সাহিত্যিক জন্ম নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম কবি বিপিন বিহারী নন্দী। শিক্ষা জীবনে কেশব ভারতী প্রাইমারী স্কুল, পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম কলেজ-এ লেখা পড়া করেন। ১৮৯৪ সালে তিনি বি.এ.বি.এল ডিগ্রি ভারত থেকে লাভ করেন। তিনি পটিয়ায় ১৯১০ সালে পটিয়া আদালত প্রতিষ্ঠা হলে এতে ওকালতি করেন। ওকালতি করে এলাকার অনেক মানুষের আইনী সহায়তা প্রদানের জন্য এলাকাতে তাঁর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছিল। তিনি কবিতা ছাড়াও সাহিত্য সংস্কৃতি ও অনুবাদক হিসেবে সমগ্র ভারতে সুনাম পেয়েছেন। তাঁর সময়ে চট্টগ্রাম ও কলকাতায় সাহিত্যিকদের একটি সেতু তৈরি হয়েছিল। প্রাচীন চক্রশালায় সাহিত্য সম্মেলন হয়েছিল। ঐ সম্মেলনে কবি বিপিন বিহারী নন্দী সভাপতি ছিলেন। সম্মেলনে কলিকাতা ও বাংলাদেশের বিখ্যাত ৭০ জন কবি সাহিত্যিক অংশ নিয়েছিলেন।
কবি বিপিন বিহারী নন্দীর উল্লেখযোগ্য সাহিত্য চর্চার মধ্যে অর্য্য (বিভিন্ন কবিতার সমষ্টি), চন্দ্র ধর (চাঁদ সওদাগরের উপর কাব্য), নারী (রাজপুত্রের জীবন কাব্য), প্রতিষ্ঠা (নাট্য কাব্য) নামের সাহিত্য রচনা করে পুস্তক আকারে প্রকাশ করেন। প্রকাশিত পুস্তাকাদি সমগ্র ভারতে প্রসিদ্ধ লাভ করেছিলেন। তাঁর সাহিত্য সাধনার অসামান্য অবদানকে তখনকার সময়ে শ্রদ্ধাভরে সম্মান করা হয়েছিল। সাহিত্যে সাধনা ও সমাজ কর্মীর মূল্যায়ন সূচক চট্টগ্রাম আদালত থেকে ব্যবহারজীবী বৃত্তি লাভ, নিখিল ভারত সাহিত্য সভা কর্তৃক কাব্য বিনোদ, বিদ্যা ভূষণ সাহিত্য সরস্বতী, ননদীয়া সমাজ কর্তৃক কবি শেখর ও উদয় পুরের মহারানী কর্তৃক রাজ্য দানখা কৃত্তিবাস পুরস্কার লাভ ও উপাধী পেয়েছেন। সমাজ উন্নয়ন, দেশপ্রেমিক ও মানবতার কবি ও সাহিত্যিক বিপিন বিহারী নন্দী ১৯৩৭ সালের ২১ জুলাই নিজ গ্রাম জঙ্গলখাইনে দেহ ত্যাগ করেন। কবির ৮০তম প্রয়াণ দিবসে কবির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

 

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply