২৯ মার্চ ২০২৪ / ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ / রাত ১২:০৫/ শুক্রবার
মার্চ ২৯, ২০২৪ ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ

ফোনকলে নজরদারিতে উদ্বেগ বাড়ছে বাংলাদেশে

     

ইসরায়েলের সফটওয়্যার স্পাইওয়ার পেগাসাসের মাধ্যমে ফোনকলে গোপন নজরদারির ঘটনা একে একে সামনে আসায় উদ্বেগ বাড়ছে বাংলাদেশে।

পেগাসাস সফটওয়্যার ব্যবহারের তালিকায় বাংলাদেশের নামটি এখনও উঠে না আসলেও মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের নজরদারির একাধিক ঘটনায় আতঙ্ক বাড়ছে।নানা সময়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ফোনালাপ ফাঁস বা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অভিযোগও তো কম আসেনি।

ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের মতো গুরুতর অভিযোগ নিয়ে সম্প্রতি বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী ও তথ্য সুরক্ষা বিষয়ক কর্মকর্তাদের সঙ্গে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রাশনা ইমাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘আমাদের লিগ্যাল প্রফেশনে ক্লায়েন্ট কনফিডেন্সিয়ালিটি বলে একটা ব্যাপার আছে। একজন মক্কেলের সঙ্গে তার অ্যাডভোকেটের যে যোগাযোগ হয়, সেটা প্রোটেকশন পায়। সে কমিউনিকেশন আমরা কনফিডেনসিয়াল রাখতে বাধ্য।’

আইনজীবীরা গোপনীয়তা বজায় রাখলেও মোবাইল ফোন সার্ভিলেন্সের মাধ্যমে সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে মনে করেন আইনজীবী রাশনা ইমাম।

তিনি বলেন, ‘আইনজীবীদের মধ্যে যারা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছেন, তাদের জন্য তো বিষয়টি লাইফ থ্রেটনিং সিচুয়েশন হয়ে দাঁড়াবে, যদি তাদের কমিউনিকেশনের গোপনীয়তা বজায় না রাখা যায়। একজন পেশাজীবী হিসেবে এটা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক।’

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেছে, রাজনীতিবিদ এবং সাংবাদিকসহ অনেকের মোবাইল ফোন কথোপকথনের রেকর্ড সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে।কারা এই কাজ করছে সেটি নিয়ে অনেকের মধ্যেই উদ্বেগ এবং চিন্তা বাড়ছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, মোবাইল ফোনে আড়ি পাতা কিংবা ইন্টারনেটে নজরদারির বিষয়টি প্রয়োজন হয় রাষ্ট্র ও মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এবং অপরাধী-চক্রের গোপন পরিকল্পনা আগে থেকে জেনে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবার জন্যই নজরদারির প্রয়োজন। তবে বিষয়টি হতে হবে আইনগত কাঠামোর ভেতর দিয়ে।

ইন্টারনেট এবং বিভিন্ন ডিভাইসে নজরদারির জন্য বাংলাদেশেও বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ২০০৮ সালে বাংলাদেশে প্রথম প্রতিষ্ঠা করা হয় ন্যাশনাল মনিটরিং সেন্টার, যেটি ২০১৩ সালে নাম বদলে করা হয় ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে এই সংস্থা কাজ করে। নজরদারি জোরদার করার জন্য বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের জন্য।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পিস এন্ড সিকিউরিটিজ-এর চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এ. এন. এম মুনিরুজ্জমান বলেন, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা যেমন গুরুত্ব আছে, তেমনি ব্যক্তির নিরাপত্তাও গুরুত্ব আছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য কিছু তথ্য সংগ্রহ করার প্রয়োজন হতে পারে। সেটা হতে হবে আইনগত ভিত্তির উপরে।বিশেষ করে সন্ত্রাসী এবং উগ্রপন্থী কার্যক্রম ঠেকানোর জন্য এ ধরনের ব্যবস্থার প্রয়োজন হতে পারে।’

তিনি বলেন, “রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য অনেক সময় কিছু তথ্যের প্রয়োজন হতে পারে বা আড়ি পাতার প্রয়োজন হতে পারে। তবে সেটা হতে হবে সম্পূর্ণ আইনি ভিত্তির উপরে। বিভিন্ন রাষ্ট্রে যখন এ ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়, তার জন্য একটি শক্ত আইনি ব্যবস্থা আছে।”

ফোনালাপে আড়ি পাতার বিষয়ে মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার নামে যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং নজরদারির কাজ করা হলেও সেগুলো শুধুই রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা, যারা এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে নজরদারি করছে, তাদের জবাবদিহিতার অস্পষ্টতা আছে। তারা ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এসব প্রযুক্তি কাজে লাগাচ্ছে কিনা তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মীনাক্ষী গাঙ্গুলি এ বিষয়ে বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘তারা সব সময় এটাই বলে যে তাদের সিকিউরিটি দরকার। কিন্তু যখন খোঁজ নেওয়া হয় তখন দেখা যায়, পার্সোনাল গেইন এবং পলিটিকাল গেইন – এ জন্যে করা হয়। এখানে তো কোনো ট্রান্সপারেন্সি নেই। কোন এজেন্সি এটা ইউজ করছে? কোন অফিসার ইউজ করছে? কে এই অর্ডারটা সাইন করছে? যদি কোন মিসইউজ হয়, যদি কোন ব্ল্যাকমেইল হয় -তখন অ্যাকাউন্টেবিলিটি কী করে আসবে?’

নজরদারির কারণে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ক্ষুণ্ণ হলে সার্বিকভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াও ব্যহত হয় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ।

‘ব্যক্তির যে স্বাধীনতা, তার প্রিভেসি বিপর্যস্ত হচ্ছে। অনেকে মোবাইল টেকনোলজি সম্পর্কে ভীত হয়ে গেছে। যেখানে সেখানে তারা মোবাইল ব্যবহার করতে ইচ্ছুক নয়। একসময় আপনি মতামত নেবার জন্য লোকও পাবেন না।’

কিছু শর্তসাপেক্ষে বাংলাদেশে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার রক্ষার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে সংবিধানে।কিন্তু সংবিধানে যাই থাকুক না কেন, বাস্তবে যে সেটি কতটা হয় তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

পেগাসাস নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে বিবিসি বাংলা কথা বলেছে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে।

তিনি বলেন, ‘সকল রাষ্ট্রের, সকল সরকারের এই ধরনের আড়িপাতার জন্য আইনে একটা বিধান রাখা হয়। জরুরি অবস্থায় বা প্রয়োজনে এই বিধান প্রয়োগ করতে হয়। এই আইন কাজে লাগিয়ে তখন তারা আড়ি পাতে। আমাদের দেশেও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে এ ধরনের বিধান আছে। এছাড়া ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টেও এই বিধান আছে। কিন্তু এই দুটো আইনের ক্ষেত্রেই সরকারি অনুমতি নেবার প্রয়োজন আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে যেটা বলা আছে, সরকার বলতে এখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীকে বোঝাবে। আইসিটি অ্যাক্টে কমিশন আছে, রেসপন্স টিম আছে এবং আইসিটি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে এটা করতে হবে। এটা কোন ব্যক্তি করতে পারবে না। এটা করতে পারবে সরকারি সংস্থা।’ খবর বিবিসি বাংলা, সমকাল ও পূর্ববাংলা অনলাইন থেকে

 

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply