২৬ এপ্রিল ২০২৪ / ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / রাত ২:০৫/ শুক্রবার
এপ্রিল ২৬, ২০২৪ ২:০৫ পূর্বাহ্ণ

রাজনীতিবিদ এম ইদ্রিচ বি.কম’র ১৯তম মৃত্যু বার্ষিকী আজ

     

চট্টগ্রামের কৃতিসন্তান রাজনীতিবিদ এম ইদ্রিচ বি.কম’র ১৯মৃত্যু বার্ষিকী আজ ।জাতির পিতার ঘনিষ্ঠ সহচর দার্শনিক নেতা নামে খ্যাত এই  নেতা বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামে যাঁরা অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন তাঁদেরই মধ্যে অন্যতম এম ইদ্রিচ বি.কম.। তিনি সাধারণের মধ্যে থেকে জীবন-যাপন করেও অসাধারণ হয়ে উঠেছিলেন শ্রম-কর্ম-মেধা-মননের বিশালত্বে। মানুষকে দেখেছেন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে। সংগ্রামে আন্দোলনে ছিলেন প্রথম সারিতে। সংগঠক থেকে নেতৃত্বের আসনে নিজেকে এগিয়ে নিয়েছেন, অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। কোথাও থেমে থাকেননি। আপোষহীন লড়াকু মনোভাব নিয়ে বাঙালি জাতির বিকাশের পথ-পরিক্রমায় অন্যতম সংগঠক, পরিকল্পনাবিদ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। লোভ-লালসা, মোহ, অন্যায় অবিচারের কাছে পরাজিত হননি কখনো। সবকিছু দু’পায়ে দলে শোষণ, বঞ্চনার বিপরীতে শোষিত বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের মুক্তির লড়াইয়ের পতাকাটি হাতে নিয়েছিলেন তুলে, সেই সাহসি মানুষটি চট্টলার সিংহপুরুষ প্রয়াত জহুর আহমদ চৌধুরী ও এম এ আজিজ এর হাত ধরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হিসেবে ছাত্ররাজনীতির মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন সেই পঞ্চাশের দশকে। ১৯৫২ সালে যখন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে উত্তাল দেশ, তখন অনলবর্ষী বক্তা হিসেবে এম. ইদ্রিচের আবির্ভাব ঘটে ছাত্ররাজনীতিতে। আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তখন তিনি চট্টগ্রাম সরকারি বাণিজ্য কলেজের ছাত্র হিসেবে ছাত্রলীগের নেতৃত্বের হাল ধরেন, বাণিজ্য কলেজের প্রথম অনুষ্ঠিত ছাত্র সংসদ নির্বাচনে (১৯৫৪-৫৫) এম.ইদ্রিচ বি.কম. বিপুল ভোটে জি.এস (জেনারেল সেক্রেটারি) নির্বাচিত হন। তখন তাঁর পরিচিতি আরো ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে এবং আওয়ামী লীগ তথা জাতীয় রাজনীতির মহীরূহ জহুর আহমদ চৌধুরীর আরও সজাগ দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। বাণিজ্য কলেজের প্রথম জি. এস. নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে নিজের কাছে টেনে নিয়েছিলেন, অগণন অগ্নিস্রাবের সম্ভাবনাপূর্ণ এই অগ্নিস্ফূলিঙ্গকে। এরই মধ্যে এম. ইদ্রিচ কমার্স কলেজ থেকে বি.কম. ডিগ্রিও অর্জন করে নেন।
সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী নিজ দলীয়কর্মী ও সহকর্মী এ তরুণের বি.কম. ডিগ্রি অর্জনের আনন্দে নামের সাথে বি.কম. শব্দটি সংযুক্ত করে ইদ্রিচ বি.কম. সম্বোধন করাটা শুরু করে দেন। সেই থেকে তিনি ইদ্রিচ বি.কম. হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন এবং জহুর আহমদ চৌধুরী সুবিশাল কর্মপরিধির সিংহভাগের ভার ইদ্রিচ বি.কম. এর যোগ্যহাতে অর্পণ করেছিলেন এবং তাঁকে নিজের পরামর্শ দাতাও করে নিয়েছিলেন। এ সুবাদে তিনি ব্যাপক অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ে সক্ষম হন। এমন কী রাজনৈতিক টানে তখনকার একমাত্র বহুজাতিক ব্যাংকে উচ্চপদে চাকরী হলেও কিছুদিনের মধ্যে তিনি সেই লোভনীয় চাকরি ছাড়তেও দ্বিধাবোধ করেননি। এরপর থেকে জহুর আহমদ চৌধুরী’র অঙ্গে অঙ্গে জড়িয়ে পড়েন ইদ্রিচ বি.কম.। ’৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে ইদ্রিচ বি.কম. অসাধারণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৬৩ সালে তিনি লাভ করেন নগর আওয়ামী লীগের সদস্য পদ। ’৬৬ সালের গণআন্দোলন এবং ’৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর রয়েছে অপরিসীম ত্যাগ।
১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু ইদ্রিচ বি.কম.কে নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে বাছাই করে নেন। আর্থিক অসচ্ছলতা থাকা সত্বেও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চট্টগ্রাম ১২ আসন (আনোয়ারা-পশ্চিম পটিয়া) থেকে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করেন এবং বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। তারপরে তিনি নেমে পড়েন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনে। উন্নয়নের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে নিজ নির্বাচনী এলাকা আনোয়ারায় বিপুল সংখ্যক প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, সরকারীকরণ এবং এসব বিদ্যালয়ে শতাধিক শিক্ষক নিয়োগ করে শিক্ষা সম্প্রসারণে অনন্য ভূমিকা পালন করেন। এ ছাড়া এলাকাকে স্বনির্ভর করার লক্ষে সাপমারা, ভরাশংখ, ইছামতি খাল খনন করে মোহছেন আউলিয়া খাল নামকরণ এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে হাইড্রোলিক প্রজেক্টটি চালু করার প্রকল্প হাতে নেন। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ২৫ হাজার একর জমিতে বোরো চাষের ব্যবস্থা করেন। উল্লেখ্য যে, খনন কাজ সম্পন্ন হলে ঐ প্রকল্পটি উদ্বোধন করার কথা ছিল স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর। খনন কাজ চলাকালে একবার হেলিকপ্টার যোগে বঙ্গবন্ধু প্রজেক্টটি দেখেও গিয়েছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত সংকট কিছুটা কাটিয়ে উঠে ’৭৫-এ দেশ যখন স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছে এবং ইদ্রিচ বি.কম. ও বঙ্গবন্ধুর নেকনজরে পড়ে জাতীয় নেতৃত্বের অগ্রসারিতে এসে পৌঁছলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হলেন স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের হাতে। ইতিহাসের এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের ফলে ইদ্রিচ বি.কম. এর স্বপ্ন-স্বপ্নই থেকে গেল। সেই হাইড্রোলিক প্রজেক্ট এর বাস্তবায়ন আর হল না। তারপর থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্র ক্ষমতা জবর দখলকারী সামরিক জান্তার হাতে বহুমুখী নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হন তিনি। এমন কী অর্থাভাবে মানবেতর জীবন যাপনেও বাধ্য হন। নিজের প্রশ্নাতীত সততা ও নৈতিক আদর্শ থেকে তিলমাত্রও বিচ্যুত না হওয়ার মজ্জাগত কারণেই আর্থিক দারিদ্র বা অসচ্ছলতা তাঁর চিরসঙ্গী – এটাই ছিল অন্যতম কারণ। জাতির জনক ও তাঁর অনুসারী-অনুগামী তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল, কামরুজ্জামান, মনসুর আলী প্রমুখ সর্বাগ্রগণ্য দলীয় তথা জাতীয় নেতাদের নিহত হওয়ার পর দেশে যে-চরম অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় – সে অবস্থায় প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক জান্তা ও তাদের তল্পিবাহক সরকারের কঠোর দমন নীতির শিকার আওয়ামী নেতা কর্মীরা প্রায় সকলেই সরকারী নির্যাতন-নিপীড়ন, জেল-জুলুম থেকে পিঠ বাঁচানোর জন্যে কিছু সময় গা ঢাকা দিতে বাধ্য হন। ইদ্রিচ বি.কম. এর ব্যাপারেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। নিজ দলের এই চরম দুঃসময়েও তিনি দলীয় আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত তো হনই নি, বরং যাদের অক্লান্ত প্রয়াসে এই নিদারুণ দুর্দিনের মধ্যেও দলীয় অস্তিত্ব ও আদর্শের নিভু নিভু দীপশিখাটিকেও যাঁরা বুকে নিয়ে আগলে জ্বালিয়ে রেখেছিলেন ইদ্রিচ বি.কম. তাঁদেরই অন্যতম।
জাতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের এই পুনরুত্থান বা পুনরুজ্জীবন লাভের ধারাবাহিকতায় স্বৈরশাসক এরশাদের উপজেলা বিকেন্দ্রীকরণ আয়োজিত উপজেলা নির্বাচনে আনোয়ারা উপজেলা থেকে চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়ে তিনি আবারো নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করেন। বলতে গেলে একেবারে শূন্য হাতেই তিনি সেই উপজেলা নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে আবারো প্রমাণ করলেন সততা নিষ্ঠা ও আদর্শের কাছে কোন শক্তিই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। ১৯৯০-এ দেশের সাধারণ নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী দল ক্ষমতাসীন হবার পর বছর দু’য়েকের মাথায় চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ওই দুর্দিনে সংগঠন পরিচালনায় ত্যাগী, আদর্শবান, অবিচল নেতার সংকট দেখা দেয়, সেই মুহূর্তে ইদ্রিচ বি.কম. এর মতে ত্যাগী নেতার অভাব অনুভূত হয়। ফলে ১৯৯৬ সালে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে প্রথমে তিনি প্রথম সহ-সভাপতি ও ১৯৯৯ সালে দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নির্বাচিত হন। দলের হাল ধরেন কঠোরভাবে। ত্যাগী নেতাকর্মীদের খুঁজে বের করে সংগঠন গড়ে তোলার লক্ষ্যে দক্ষিণ জেলার পথে প্রান্তে ছুটে যান, গড়ে তোলেন মজবুত সংগঠন। কিন্তু এরই মধ্যে তিনি বাম হাঁটুতে আর্থ্রইটিস রোগের কারণে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় তিনি আর্থিক দৈন্যতায়ও জর্জরিত। বিদেশে তো দূরের কথা দেশেও উপযুক্ত চিকিৎসা করানোর মতো অর্থ তাঁর ছিল না। সবাই হয়তো ভাবতে পারেন একজন সাবেক সাংসদ ও উপজেলা চেয়ারম্যানের কী এরকম করুণ দশা হতে পারে? কিন্তু অন্য দশ জনের মতো ছিলেন না বলেই অর্থাৎ আদর্শ এবং সততায় অটল ছিলেন বলেই তাঁকে চরম অর্থকষ্টে পতিত হতে হয়েছে। রোগমুক্তির জন্য অবশেষে বাধ্য হয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে সাহায্যের আবেদন করেছিলেন। মৃত্যুর প্রায় দশ দিন আগে নেত্রীর সাথে তাঁর এ ব্যাপারে সাক্ষাতও হয়েছিল। নেত্রী তাঁকে চিকিৎসা সাহায্যের কথাও দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সাহায্য পাওয়ার আগেই তিনি জগতের মায়া ছেড়ে চলে গেলেন ২২ জুলাই ২০০২ সালে, মাত্র ৬৮ বছর বয়সে। সবচে’ আশ্চর্যের বিষয় হলো মৃত্যুর পর তার ব্যাংক একাউন্টে পাওয়া গেল মাত্র ছয় শত টাকা। এই ছিল রাজনৈতিক ইদ্রিচ বি.কম.এর শেষ অর্থ সম্বল। সেই ছাত্রজীবন থেকে অক্লান্ত পরিশ্রমী সৎ রাজনীতিবিদ ইদ্রিচ বি.কম. শ্রম ও সময়সাধ্য বিশাল বোঝা টানতে গিয়েই সংসার জীবনে পা দেয়াও তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি, তিনি ছিলেন চিরকুমার। কিন্তু সাংগঠনিক বিপুল ও ব্যাপক কর্মকাণ্ডে আজও কিংবদন্তী হয়ে আছেন তিনি। বিশেষ করে আনোয়ারার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি ঘরে ঘরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মী সৃষ্টি করে তিনি যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তাতে তিনি মরেও অমর হয়ে থাকবেন।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply