২০ এপ্রিল ২০২৪ / ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / সন্ধ্যা ৬:৩৪/ শনিবার
এপ্রিল ২০, ২০২৪ ৬:৩৪ অপরাহ্ণ

অন্য রায়পুর অন্য গহিরা

     

আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজ

আনোয়ারার ৩নং রায়পুর  ইউনিয়নের বিশাল একটি গ্রাম গহিরা। ইয়াবার কারণে সম্প্রতি খুব আলোচিত এই নাম। চট্টগ্রামের দৈনিকগুলোতে এমন কোনো দিন নেই, যেখানে গহিরা উঠে আসছে না কোনো না কোনো ভাবে। সমুদ্রতীরবর্তী হওয়ায়, ফিসিং এবং ব্ল্যাক এই গ্রামের অন্যতম প্রধান ব্যবসা। গ্রামের জনসংখ্যার বিশাল একটা অংশ ফিসিং এবং ব্ল্যাকের সাথে জড়িত। ফিসিং নিয়ে কোনো ঝামেলা না থাকলেও, ব্ল্যাকের কারণে এই গহিরা খুব নির্মমভাবে সমালোচিত।

সঙ্গত কারণে শহরে কাউকে যদি বলি আমার বাড়ি গহিরা অস্বাভাবিকভাবে তার দৃষ্টি নব্বই ডিগ্রি এঙ্গেলে বাঁকা হয়ে যায়। এই ব্ল্যাক কিংবা কালোবাজারীকে গহিরার কলঙ্ক বললে ভুল হবে না। গহিরার আরেকটি বিষয় অন্য সবার মতো আমাকেও ভীষণ কষ্ট দেয়, এখানকার রাস্তাঘাট। হাতে হাতে এতো টাকা, এতো শিক্ষা কিন্তু এখানকার রাস্তাঘাট দেখলে মনে হবে এখানে তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ চলছে। এলাকায় চেয়ারম্যান মেম্বার কী জন্য নির্বাচিত হয় নির্বাচিতরাই ভালো জানেন। সেদিকে আর যাচ্ছি না।

ব্ল্যাক কিংবা ইয়াবা অথবা রাস্তাঘাটের যথাযথ সংস্কার নিয়ে সমাজের মোড়ল কিংবা দেশের প্রশাসন মাথা ঘামাবে। আমার ছোট মাথা আপনাদেরকে আপাদত রায়পুর-গহিরার অন্য একটা দিকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। সময় থাকলে চলেন সেদিকে, ভালো কিছু পাবেন। রায়পুর-গহিরায় গেলে আপনি মূলত বিস্মিত হবেন যে, এই এলাকার শিক্ষা দীক্ষা দেখে। অনেককেই আমি বড় গলায় বলতে শুনেছি, রায়পুর-গহিরায় ঘরে ঘরে অনার্স, মাস্টার্স উচ্চ শিক্ষিত আছে।

চুন্নাপাড়া মুনিরুল ইসলাম সিনায়র মাদ্রাসা, উপকূলীয়  স্কুল, রায়পুর ইউনিয়ন বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয়, এজহারুল উলুম মাদ্রাসা,  রায়পুর গাউছিয়া মাদ্রাসার মতো স্বনাম ধন্য সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি আছে বোর্ড বৃত্তিধারী অনেক প্রাইমারি স্কুল এবং কিন্ডার গার্টেন। আছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নূরানী মাদ্রাসা ও হেফজখানাও।

ডাঃ হাসমত আলী, জব্বার মাস্টার, নুরুল আনোয়ার চৌধুরী, জালাল আহমদ চৌধুরী, আবদুল মান্নান চৌধুরী, মাওলানা আলী আহদদ বৌয়ালবি, মাওনালা আহমদ হাসান, অধ্যক্ষ মাওলানা আবু তাহেরসহ অনেক ক্ষণজন্মা মহামানব যুগ যুগ ধরে উজ্জ্বল করে রেখেছেন রায়পুর-গহিরার নাম।

শিক্ষা-সংস্কৃতির দিক দিয়ে গহিরা কোনভাবেই পিছিয়ে নেই। বরঞ্চ সিটির আওতাধীন বিভিন্ন এলাকা থেকেও অনেকভাবে এগিয়ে। প্রতিযোগিতামূলক পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলায়ও গহিরার মানুষের আবেগ উল্লেখ করার মতো। তখনকার সময়ের মরহুম জালাল উদ্দিন আহমদ চৌধুরী স্মৃ

তি ক্রিকেট টুর্ণামেন্ট, বিডিআর জাহাঙ্গীর স্মৃতি ফুটবল টুর্ণামেন্ট, বার্সেলোনা আয়োজিত মাস্টার আব্দুল্লাহ স্মৃতি ফুটবল টুর্ণামেন্ট এবং হাল আমলের গাজী প্রিমিয়ার লীগ দক্ষিণ চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

এসবের বাইরে আর যে বিষয়টি আপনাকে ব্যাপকভাবে টানবে তা হচ্ছে গহিরার সৌন্দর্য। বিস্তৃত সমুদ্রচর। আছড়ে পড়া ঢেউরে শাঁ শাঁ গর্জন, আপনাকে নিয়ে যাবে অথৈ রোমান্সের কাল্পনিক কোন জগতে। জীবনানন্দের বনলতা সেন মুখস্ত থাকলে ডেকে উঠতে পারেন, “অতি দূর সমুদ্রের পর হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা, সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে…” স্রোতের নির্মম ভাঙনেও কিছুটা ম্লান হয়নি রায়পুর-গহিরার এই সৌন্দর্য।

বিস্তৃত বালুচরে হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে যেতে পারেন চিপাতলী ঘাট, খুইল্লে মিয়ার ঘাট, উঠান মাঝির ঘাট পেরিয়ে দূরে কোথাও। লুকিয়ে যেতে পারবেন বাছামিয়া মাঝির ঘাটের ঝাউ বাগানে। মৌসূমী ভৌমিককে জানা থাকলে গাইতে পারেন, “আমি শুনেছি সেদিন তুমি সাগরের ঢেউয়ে চেপে নীলজল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছো আমি শুনেছি সেদিন তুমি লোনাবালি তীর ধরে বহুদূর বহুদূর হেঁটে এসেছো…”

বার আউলিয়ার ওদিকে বঙ্গোপসাগর আর সাঙ্গুর মিলন মোহনা আপনাকে নির্বাক করে দিতে বাধ্য। বিশাল পেরাবন, ছায়াঢাকা পথ একটু একটু ভয় জাগিয়ে দিতে পারে মনে। নজু মিয়ার খাল সৌন্দর্য পিয়াসী যে কাউকে আকৃষ্ট করতে অনিন্দ্য । শীতকালে এখানে জেগে ওঠে বিশাল চর, সুদূর সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসে অতিথি গাংচিল। জোয়ারের ঢেউয়ে ঢেউয়ে ডানামেলা গাংচিলের উড়াউড়ি আপনাকে নিয়ে যেতে পারে অনির্ণেয় অনুভবের দেশে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্তি এলেই আছে গাছের ছায়া, শীতল বাতাস। উদাস করে দিবে পুরোটাই। যথাযথ উদ্যোগ নিলে এখানে গড়ে তোলা যেতো দেশের অন্যতম বৃহৎ সমুদ্র সৈকত। গড়া যেতো সমুদ্র বন্দর। কিন্তু কে নিবে এই উদ্যোগ? করা যেতো ভ্রমণ পিয়াসু পর্যটকদের জন্য আকর্ষনীয়। সরকারের সুনজর এখানে গড়ে তুলতে পারে অসাধারণ কিছু। উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র মুক্তি দিতে পারে গহিরার মানুষদেরকে ইয়াবার অভিশাপ থেকে। বেড়িবাঁধের জন্য যেমন জনতার জাগরণ উঠেছে তেমনি সার্বিক দিক দিয়ে রায়পুর-গহিরাকে আধুনিকায়নের জন্য গর্জে উঠতে হবে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে। কাজে লেগে যেতে হবে একটি সৃমদ্ধ রায়পুর ইউনিয় গঠনের কাজে। তবে অল্প দিনে হয়তো রায়পুর-গহিরা হতে পারে দুনিয়া-পরিচিত সমুদ্র সৈকত। সমৃদ্ধ একটি নগরী।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply