২৬ এপ্রিল ২০২৪ / ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / রাত ১২:০৬/ শুক্রবার
এপ্রিল ২৬, ২০২৪ ১২:০৬ পূর্বাহ্ণ

৭ মার্চ ভাষণের অপপ্রয়োগ

     

সিরাজী এম আর মোস্তাক

“সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবেনা। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবেনা।” ১৯৭১ এর ৭মার্চে স্বাধীনতার স্থপতি বাঙ্গালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উচ্চারিত এ বাক্যটি এখন অপপ্রয়োগ হয়েছে। এখন সাত কোটি বীর বাঙ্গালির স্বীকৃতি নেই। মাত্র ২লাখ তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তা পেয়েছে। বাংলাদেশে জামুকার (জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল) তালিকায় সর্বসাকুল্যে ২লাখ ৩৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। এটি বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সুস্পষ্ট অপপ্রয়োগ। সেদিনের ভাষণ সাত কোটি মানুষের দেহে-মনে রেখাপাত করেছিল। সবাই যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল। ৩০লাখ প্রাণ ও ২লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতা এনেছিল। সে যুদ্ধে মাত্র ২লাখ মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হলো কিভাবে? কোথায় গেল বঙ্গবন্ধুর ভাষণে সাড়া দানকারী সাত কোটি বীর বাঙ্গালি, ৩০লাখ হারানো প্রাণ ও ২লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনের স্বীকৃতি?

বঙ্গবন্ধু সেদিন আরো বলেন, “ভাইয়েরা আমার! তোমরা আমার ওপর বিশ^াস আছে? আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাইনা, আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের ওপর হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো- প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রæর মোকাবেলা করতে হবে।” এভাবেই বঙ্গবন্ধু দেশের আপামর বীর বাঙ্গালিকে মুক্তিযুদ্ধে লড়াইয়ে উদ্ধুদ্ধ করেন। জনাব ওবায়দুল কাদের ‘এ বিজয়ের মুকুট কোথায়’ গ্রন্থে ১০৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন, “সাতই মার্চের স্বাধীনতার ‘গ্রীন সিগনাল’ সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীকে সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করলো। রক্ত নদী সাঁতরিয়ে নয় মাস পরেই আমরা স্বাধীনতার সোনালী দ্বীপে পৌছুলাম মহান বঙ্গবন্ধুর অবিসংবাদিত সম্মোহক নেতৃত্বে।” জনাব কামাল হোসেন ‘তাজউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং তারপর’ গ্রন্থে ২৪৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন, “২৩ শে মার্চ (১৯৭১) আওয়ামী লীগের গণবাহিনীর কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত ভাষণেও ভয়াবহ পরিণতি আঁচ করা যায়। তিনি বলেন, সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী ঐক্যবদ্ধভাবে যে আন্দোলন শুরু করেছে, দেশমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তা থামবে না। একজন বাঙালীও জীবিত থাকা পর্যন্ত এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। বাঙ্গালীরা শান্তিপূর্ণভাবে সে অধিকার আদায়ের জন্য চরম ত্যাগ স্বীকারেও তারা প্রস্তুত।”

জনাব মুহম্মদ নুরুল কাদির “দুশ ছিষট্টি দিনে স্বাধীনতা” গ্রন্থে ৩০৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন, “ঐ সময়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ এক ভাষণে বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রত্যেকেই মুক্তিযোদ্ধা এবং মাতৃভুমির প্রতি ইঞ্চি পবিত্রভুমি উদ্ধারে তারা প্রতিশ্রæতিবদ্ধ।”

জনাব রাশেদ খান মেনন “রাজনীতির কথকতা” গ্রন্থে ১৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন, “দেশের মানুষের কার্যত সকল অংশই মুক্তিযুদ্ধে শরিক হয়েছিল। ক্যান্টনমেন্টের বিদ্রোহী সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ থেকে একজন সাধারণ কৃষক পর্যন্ত কেউই বাদ থাকেনি এই মুক্তিযুদ্ধে। যারা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারেনি তারাও এগিয়ে এসেছে সহযোগিতার হাত নিয়ে। অর্থ দিয়ে খাবারের যোগান দিয়ে, আশ্রয় দিয়ে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন জুগিয়েছে। আর যারা তা করতে পারেনি তারা অবরূদ্ধ দেশের মধ্যে বসে উদ্ধিগ্ন প্রহর গুনেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যে আনন্দে উদ্বেল হয়েছে। অসাফল্যে মুষড়ে পড়েছে। আসলে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের এই সমর্থন না থাকলে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে সম্ভবই ছিল না কোনো প্রকার প্রতিরোধ গঢ়ে তোলার। বাংলাদেশে কোনো দুর্গম- পাহাড়- জঙ্গল ছিলনা, যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা লুকিয়ে থাকতে পারে। পানির মধ্যে মাছের মতো এই জনগণের মাঝেই মুক্তিযোদ্ধারা মিশে থেকেছে। আর এই মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়ার অপরাধে তাদের গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পাকবাহিনী মেয়েদের ধরে নিয়ে গেছে। এই মানুষদের দিয়ে কবর খুঁড়িয়ে তার পাশে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে ঐ কবরে ফেলে দেয়া হয়েছে।

কিন্তু স্বাধীনতা অব্যবহিত পরেই দেখা গেল সেই ঐক্যবদ্ধ মানুষকে বিভক্ত করে দেয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। যারা প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে ভারতে গেছে তারাও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত হলেও, দেশের অভ্যন্তরে এই মানুষগুলোর ত্যাগ- তিতিক্ষার, অবরূদ্ধ দেশে এক ভয়ঙ্কর পরিবেশের মধ্যে তাদের সংগ্রামের কোনো স্বীকৃতি মেলেনি, যে দেশ তারা সবাই মিলে স্বাধীন করলো সেই দেশটাই যেন চলে গেল দখলে।”

অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ‘মুক্তিযুদ্ধঃ উপেক্ষিত গেরিলা’ গ্রন্থে ৬৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন, “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিলো জনযুদ্ধ। জনগণের যুদ্ধ। দেশপ্রেমিক প্রতিটি বাঙ্গালী এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলো। এটা শুধুমাত্র এককভাবে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে অন্য একটি সামরিক বাহিনীর যুদ্ধ ছিলনা। এই যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে এবং রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। এই যুদ্ধ ছিলো রাজনৈতিক যুদ্ধ। সামরিক বেসামরিক সকলেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।”

মেজর জেনারেল (অবঃ) এম এ মতিন বীর প্রতীক ‘আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা’ গ্রন্থে ৭১-৭২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন, “এদেশের আপামর জনসাধারণের অংশগ্রহণে সমৃদ্ধ আমাদের এ মুক্তিযুদ্ধ- কেউ প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধ করেছেন লড়াইয়ের ময়দানে, কেউবা যুদ্ধের সহায়ক শক্তি হিসেবে গৌরবজনক ভুমিকা পালন করেছেন, কেউ যুদ্ধ করেছেন যুদ্ধক্ষেত্রে, কেউবা লড়েছেন মাঠে, ঘাটে, কৃষিক্ষেত্রে, মিল ফ্যাক্টরীতে; কেউ নৈতিক শক্তি যুগিয়েছেন ক্লাশরুম থেকে, কেউবা সাংস্কুতিক অঙ্গনে। যে কোন সঙ্কটময় মুহুর্তে সমগ্র জাতি একত্রিত হতে পারে এবং ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত প্রয়াস ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে সঙ্কট-উত্তরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ তথা যে কোন ত্যাগ স্বীকারে জাতি কৃত সংকল্প- একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধ তারই সাক্ষ্য বহন করে।”

অধ্যাপক মুনতাসির মামুন ‘মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১’ গ্রন্থে ১০১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন, “স্বাধীনতা কারো দান নয়, অশেষ আত্মত্যাগের বিনিময়ে তা অর্জিত এবং গুটি কয়েক মুক্তিযোদ্ধা, দেশত্যাগীর নয়, মুক্তিযুদ্ধ ছিল গোটা বাংলাদেশের আপামর বাঙ্গালীর।”

লেখক হারুন হাবীব ‘মুক্তিযুদ্ধ বিজয় ও ব্যর্থতা’ গ্রন্থে ২৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন, “খুঁজলে খুব কম পরিবার পাওয়া যাবে যা থেকে স্বাধীনতার যুদ্ধে প্রতিনিধিত্ব হয়নি, পরোক্ষে বা প্রত্যক্ষে। সংখ্যায় তারতম্য যাই হোক, দেশের সবকটি পরিবারই অংশগ্রহণ করেছিল জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে। কারণ, সে যুদ্ধ ছিল জাতি হিসেবে বাঙ্গালীর অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, পাকিস্তানী শোষক শ্রেণীর চক্রান্ত থেকে নিজেদের ভাষা, কৃষ্টি, অর্থনীতি আর সভ্যতাকে প্রতিরক্ষার লড়াই।”

জনাব আতিউর রহমান ‘মুক্তিযুদ্ধের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন’ গ্রন্থে ১৫৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন, “সকল অর্থেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। খেটে-খাওয়া সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, ছাত্র- জনতা সবাই একাত্তরে যুদ্ধে নেমেছিলেন মৌলিক কিছু আকাঙখা বুকে নিয়ে।”

উল্লেখিত সকল উদ্ধৃতিতে মহান মুক্তিযুদ্ধে ১৯৭১ এর সাড়ে সাত কোটি বীর বাঙ্গালির অবদান ও স্বীকৃতি মেলে। কিন্তু এর সুস্পষ্ট অপপ্রয়োগ ঘটেছে, ভারতের লালবই ও অন্যান্য তালিকা থেকে মাত্র ২লাখ মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত করায়। এতে ৩০লাখ শহীদ ও ২লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনের স্বীকৃতিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এতে স্বাভাবিক প্রশ্ন জেগেছে, যে যুদ্ধে ৩০লাখ বীর শহীদ প্রাণ হারালো, তাতে মাত্র ২লাখ মুক্তিযোদ্ধা কিভাবে তালিকাভুক্ত হলো? পৃথিবীতে কোনো যুদ্ধ আছে কি, যাতে শহীদের চেয়ে যোদ্ধা সংখ্যা কম? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তা কিভাবে হলো? অর্থাৎ ৩০লাখ বীর শহীদ ও ২লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোন আত্মত্যাগ অস্বীকার করা হলো। এটিই ৭ই মার্চে ভাষণের সুস্পষ্ট অপপ্রয়োগ ও একইসাথে ৭ই মার্চে ভাষণ, বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধানীতি এবং মুক্তিযুদ্ধ চেতনার বিরোধী। বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক ভিত্তি রচনা ও বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতেই ৬৭৬ যোদ্ধা ও শহীদকে খেতাব দিয়েছেন। ৩০লাখ শহীদের পক্ষে ৭জনকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব এবং ১৯৭১ এর সাড়ে সাত কোটি বীর বাঙ্গালির পক্ষে ৬৬৯ জনকে বীরউত্তম (৬৮), বীরবিক্রম (১৭৫) ও বীরপ্রতীক (৪২৬) খেতাব দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সময়ে এ ৬৭৬ যোদ্ধা ও শহীদ ব্যতিত আর কোনো তালিকা ছিলনা। দেশের সবাই মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্য স্বীকৃত ছিল। তখন মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা বিভাজন ছিলনা। বঙ্গবন্ধু খেতাবপ্রাপ্তদেরকেও ভাতা বা কোটাসুবিধা দেননি। এমন কেউ কি আছেন, যিনি বঙ্গবন্ধু থেকে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বা সুবিধা গ্রহণ করেছেন?

১৯৭১ এর ৭ই মার্চের ভাষণ মূল্যায়ন না করে মাত্র ২লাখ মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত করায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উল্লেখিত সাড়ে সাত কোটি বীর বাঙ্গালি স্বীকৃতি বঞ্চিত হয়েছে এবং ৩০লাখ বীর শহীদ ও ২লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনের অবমাননা হয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে এবারের ৭ই মার্চে বন্ধ হোক এ অপপ্রয়োগ।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply