২৯ মার্চ ২০২৪ / ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ / সকাল ৮:২৭/ শুক্রবার
মার্চ ২৯, ২০২৪ ৮:২৭ পূর্বাহ্ণ

বেনাপোলের পৌর কাউন্সিলর তুহিন নিখোঁজ রহস্য ৭ বছরেও উন্মোচিত হয়নি

     

এম ওসমান, বেনাপোল
আজ ৭ মার্চ বেনাপোল পৌরসভার প্যানেল মেয়র ও ছাত্রলীগ নেতা তুহিন নিখোঁজের ৭ বছর। ৭ বছরেও তুহিন নিখোঁজ রহস্য উন্মোচিত হয়নি। তুহিন বেঁচে আছেন না চিরদিনের জন্য না ফেরার দেশে চলে গেছেন, তা এখনও কেউ জানে না। মামলার তদন্ত কর্মকর্তাও এ ব্যাপারে কিছুই বলতে পারছেন না। তুহিনের পরিবার এখনো চেয়ে আছে, কখন তিনি বাড়ি ফিরবেন। তুহিনের স্ত্রী আর পুত্র সন্তান এখনো পথ চেয়ে বসে আছে স্বামী আর বাবার অপেক্ষায়।
তুহিন নিখোঁজের পরের ঘটনা আরো লোমহর্ষক। বিভিন্ন মোবাইল ফোন দিয়ে একটি চক্র ‘তুহিন তাদের কাছে আছে’ এই ফাঁদ পেতে তার স্ত্রীর কাছ থেকে কয়েক লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়। তুহিনকে তো ফিরে পায়নি, উপরন্তু তার কাছে থাকা ও ধার-দেনা করে আরো কয়েক লক্ষ টাকা হারিয়ে এখন বাকরুদ্ধ স্ত্রী সালমা বেগম। নিখোঁজের দুই বছর পর ছেলের খোঁজ না পাওয়ায় সন্তান হারানোর বেদনা নিয়ে তুহিনের বাবা ২০১৫ সালের ২৭ এপ্রিল রাতে মারা যান। তুহিনের মাও দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী।
তারিকুল আলম তুহিন (৩৮) ছিলেন বেনাপোল পৌরসভার প্যানেল মেয়র ও শার্শা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। ২০১৩ সালের ৭ মার্চ বেলা ১১টার দিকে ঢাকার শেরে বাংলানগরস্থ ন্যাম ভবনের যশোর-১ শার্শা আসনের এমপি শেখ আফিল উদ্দিনের বাসা (এমপি হোস্টেল) থেকে নীচে নামার পর পরই নিখোঁজ হন তুহিন নিখোঁজের ৭ বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। গুম হওয়া অনেক নেতাদের মতো তুহিনও স্মৃতির পাতা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। তুহিন বেনাপোল পৌরসভার ভবারবেড় এলাকা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি মৃত ডাক্তার ইউসুফ আলমের ছেলে।
ছাত্রলীগ নেতা ও প্যানেল পৌরসভার মেয়র তারিকুল আলম তুহিন নিখোঁজ বা গুমের রহস্য উদ্ঘাটনে দীর্ঘদিন পর ফের নড়েচড়ে বসেছিল ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশ। আর এ নড়েচড়ে বসার মধ্য দিয়ে মুখোশ উন্মোচিত হতে পারে বলে অনেকে আশা করলেও সে আশা পূরণ হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যশোর-১ আসনের এমপি শেখ আফিল উদ্দিনের সঙ্গে বেনাপোল পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম লিটনের দ্বন্দ্ব শুরু হয় ২০১২ সালের মাঝামাঝি থেকে। এমপির পক্ষে আগে যেখানে মেয়র লিটন নেতৃত্ব দিতেন, দ্বন্দ্ব শুরু হলে তুহিন এমপির পক্ষে নেতৃত্ব দেওয়া শুরু করেন। ২০১৩ সালের ৩ মার্চ মেয়র আশরাফুল আলম লিটন ও প্যানেল মেয়র তারিকুল আলম তুহিন গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে মেয়র ও তুহিনের বাড়িতে বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এদিন রাতে র‌্যাব তুহিনের বাড়িতে হানা দেয়। পরদিন ৪ মার্চ সকালেই তুহিন ঢাকায় চলে যান। সেখানেই অবস্থান করতে থাকেন তুহিন। ৭ মার্চ বেলা ১১টার দিকে মোবাইলে একটি ফোন পেয়ে নীচে নেমে আসেন তুহিন। এর পর থেকে আজো নিখোঁজ রয়েছে তুহিন।
তুহিন নিখোঁজের ব্যাপারে বেনাপোলসহ শার্শা উপজেলায় হরতাল, অবরোধ, মানববন্ধনসহ মিছিল মিটিং হয়েছে একাধিক। সাংবাদিক সম্মেলনও করেন আওয়ামী লীগ, তার পরিবার ও পৌরসভার কাউন্সিলররা।
তুহিনের নিখোঁজ বা গুমের ঘটনার পাঁচ দিন পর ১২ মার্চ তার চাচাতো ভাই সুমন ঢাকার শেরে বাংলানগর থানায় প্রথমে একটি জিডি করেন। কিন্তু ঘটনার তদন্ত খুব একটা গতি পায়নি। ঘটনার ৭ মাস পর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পড়ে ঢাকা গোয়েন্দা পুলিশের ওপর। এরপরই বেনাপোলের ছাত্রলীগ নেতা জুয়েলকে যশোর থেকে গোয়েন্দা পুলিশ আটক করে নিয়ে যায় ঢাকায়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পরই ঘটনায় নাটকীয় মোড় নেয়। বেনাপোল পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম লিটনের পিসিপিআর যাচাই করা হয়। তাকে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করেন গোয়েন্দারা। এরপর ঝিকরগাছা, শার্শা ও বেনাপোল থানায় পিসিপিআর যাচাইয়ের জন্য ৩-৪ জনের নামে নোটিস আসে। কিন্তু এরপর তদন্ত আর এগোয়নি। ৭ বছর কেটে গেলেও এখনো পর্যন্ত তুহিনের কোন সন্ধান দিতে পারেনি আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা। তুহিন নিখোঁজের সময় স্ত্রী সালমা অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। স্বামী নিখোঁজের ২০ দিন পর তিনি পুত্রসন্তানের মা হন। অপেক্ষায় ছিলেন তুহিন বাড়িতে ফিরলে ছেলের নাম রাখবেন। কিন্তু স্বামী দীর্ঘদিন না ফেরায় ছেলের নাম রাখা হয় তুমুল আলম।
তুহিনের স্ত্রী সালমা আলম বলেন, ‘৭ বছরেও আমার স্বামীর সন্ধান কেউ দিতে পারেনি। জীবিত হোক আর মৃত হোক, আমি তুহিনকে চাই। আমি যেভাবে স্বামী হারিয়ে কাঁদছি তেমনি যারা এ ঘটনার সাথে জড়িত তাদের স্ত্রীদেরও একই অবস্থায় পড়তে হবে। আমার স্বামী নিখোঁজ হবার পর তাকে উদ্ধারের ব্যাপারে পুলিশ প্রশাসনের উল্লেখ করার মতো কোনো ভূমিকা নেই। গোয়েন্দা পুলিশ তুহিন নিখোঁজের তদন্ত করলেও কতটুকু সফল হয়েছে তাও জানতে পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। আমার স্বামীকে সুস্থ শরীরে ফিরে পেতে চাই।’
উল্লেখ্য, ৭ বছর আগে নিখোঁজ বেনাপোল পৌরসভার কাউন্সিলার ও ছাত্রলীগের সভাপতি তারিকুল আলম তুহিনের কংকালের খোঁজে দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টা অভিযান চালিয়েছে সিআইডি। তবে এ ঘটনায় কোনো কংকাল উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
আদালতের নির্দেশে ২০১৯ সালের ১২ই মার্চ মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বেনাপোল বাজার কমিটির কার্যালয়ে ঢাকা থেকে আসা সিআইডির একটি প্রতিনিধি দল ও একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং পোর্ট থানার পুলিশের সহযোগিতায় একটানা এ অভিযান চালানো হয়।
ঢাকা সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উত্তম কুমার বিশ্বাসের নের্তৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল এটি তদারকি করেন। এসময় যশোর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কাওছার হাবিব, বেনাপোল পোর্টথানার পরিদর্শক (তদন্ত) আলমগীর হোসেন ও এসআই কামাল হোসেন সেখানে উপস্থিত ছিলেন ।
এ সময় প্রশাসনের সাথে স্থানীয় রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংবাদিক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply