২৬ এপ্রিল ২০২৪ / ১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ভোর ৫:১৬/ শুক্রবার
এপ্রিল ২৬, ২০২৪ ৫:১৬ পূর্বাহ্ণ

বাংলা ভাষাপ্রেমী পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল বিচারপতি শ্যামল কুমার সেনের সাথে কিছুক্ষণ সোহেল মো. ফখরুদ-দীন

     

 

ভারত আমাদের বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র। বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সেই প্রাচীনকাল থেকেই। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত সরকারের অবদান অপরিসীম। ভারত সেই দিন বাঙালি জাতিকে সবকিছু দিয়ে আমাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে ছিলেন। আমাদের এ দেশের হাজার হাজার নর-নারী শরণার্থীদের থাকার জায়গা দিয়েছিলেন তাঁদের দেশে। এ ঋণ শোধ হবার নয়। বাংলাদেশের মানুষ পশ্চিমবঙ্গ ভারতের সাথে যাতায়াত বেশ আনন্দের। কারণ এপার বাংলা ওপার বাংলা মায়ের ভাষা বাংলা। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের ভাষা বাংলা এক হওয়াতে বন্ধনটা শক্ত ও সহজের। সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা-ক্রীড়া ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথেও মিল রয়েছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বীরপুরুষরা এক সাথে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেÑতার কাহিনী ইতিহাসের পাতায় পাতায় সাক্ষী। এখনও ইতিহাসময়ী শিক্ষা সাহিত্য গবেষণার কাজে কলকাতার দ্বারস্থ হতে হয় আমাদেরকে। কারণ কলকাতা প্রাচীন নগরী ও সাংস্কৃতিক রাজধানী খ্যাত। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে আমার বসবাস। বিপ্লব তীর্থ চট্টগ্রাম। পবিত্র নগরী বার আউলিয়ার চট্টগ্রাম। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম এই নগরী চট্টগ্রাম। ভারতের কবি সাহিত্যিকদের প্রিয় দর্শনীয় স্থান। ভারত থেকে শত শত কবি সাহিত্যিক এ চট্টগ্রামে আসেন। আসেন সাহিত্য সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামে। পরিচয় সূত্রে সার্ক কালচারাল ফোরাম ভারত শাখার সভাপতি কবি ইতিহাসবিদ শ্রী হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর আমন্ত্রণে আমার ভারত গমন। ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্দ্রমতি হলে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে। প্রোগ্রামের পরের দিন ২১ ডিসেম্বর ভারতের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ও পশ্চিমবঙ্গের মাননীয় রাজ্যপাল বিচারপতি শ্যামল কুমার সেন এর সাথে সৌজন্য সাক্ষাতের সুযোগ হয় আমার। ভারতীয় রাষ্ট্রপতির পুরস্কারপ্রাপ্ত জাতীয় শিক্ষক ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শাখার সভাপতি ড. সুশীল ভট্টাচার্য ডি.লিট মহাশয়ের মাধ্যমে এ সুযোগ তৈরি হয়। ড. সুশীল ভট্টাচার্য আমাকেসহ বাংলাদেশের অন্যান্য সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদের নিয়ে কলকাতার শ্যামবাজারস্থ রাজ্যপালের বাসভবনে যান। সাদামাটা একটি তিনতলা ভবন। নিচে নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ বসার ব্যবস্থা। দ্বিতীয় তলায় অফিস, তৃতীয় তলায় রাজ্যপালের শোয়ার ঘর। আমরা সকাল এগারটায় পৌঁছে পুলিশ দ্বারা অবহিত হয়ে দ্বিতীয় তলার অফিসে অবস্থান করি। মিনিট পনের পরেই রাজ্যপাল হাজির। আমাদের স্বাগত জানান। এরপর মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করান। বিচারপতি শ্যামল কুমার সেনের সাথে একে একে পরিচয়ের পর তিনি জানতে চান চট্টগ্রামের বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীর কথা। তিনি চট্টগ্রামের সৎসংঘের আমন্ত্রণের একবার ইতিপূর্বে চট্টগ্রামে এসেছিলেন। চট্টগ্রামে বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী তাঁকে নগর ভ্রমণের ব্যবস্থা করেন। সেই সময়ে বিপ্লবী বিনোদ বিহারী দ্বারা তাঁকে যে আতিথেয়তা দিয়েছিলেন বিচারপতি শ্যামল কুমার সেন তা ভুলবার নয় উল্লেখ করে চট্টগ্রামের সাহিত্য সংস্কৃতি, ইতিহাস ঐতিহ্য, ধর্মচর্চা সর্বোপরি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ভূমিকার কথা স্মরণ করেন। তিনি কোন এক সময়ে পৃথিবীর বৃহৎ সমদ্র সৈকত কক্সবাজার ভ্রমণের আগ্রহ প্রকাশ করেন। সে মতে চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্রের পক্ষ থেকে তাঁকে আমন্ত্রণ জানালে তিনি আমন্ত্রণ সাদরে গ্রহণ করেন। ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্রের চট্টগ্রাম ও বাংলা উৎসব ইতিহাস সম্মিলনী কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত হবে। এই সম্মেলনে তিনি শারীরিক সুস্থ থাকলে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বলে কথা দেন। ভারত সফর কালে অন্তত পাঁচবার পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল বিচারপতি শ্যামল কুমার সেনের সাথে তাঁর বাসায় সৌজন্য সাক্ষাতের সুযোগ হয়। ভারতীয় জাতীয় সাহিত্য প্রকাশন ট্রাস্ট এর কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতৃ ভিটাতে বঙ্গ অসম উৎকল আন্তর্জাতিক সম্মেলনে শ্রী শ্যামল সেনগুপ্ত প্রধান অতিথি ছিলেন। আমি অধম একই মঞ্চে আয়োজকদের আমন্ত্রণে বিশেষ অতিথি রূপে যোগদান করেছি। মূলত প্রথম থেকেই তাঁর সাথে একটি সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বাংলার প্রতি ও বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তিনি মমত্ববোধ ধারণ করেন। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের কথা, ভাষার জন্য রক্ত দান ও মাতৃভাষা বাংলার প্রতি তিনি উদার ও মর্যাদা প্রদানকারী। বাংলা ভাষাপ্রেমী মানুষ হিসেবে তিনি অসাধারণ। আমার দুইটি বই তাঁর বাসভবনে অনাড়ম্বরভাবে পৃথক পৃথক দুটি কর্মসূচিতে মোড়ক উন্মোচন হয়। একটি বই “বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন”, অন্য বইগুলো বাংলাদেশের শিশু থেকে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জন্য লিখিত সাধারণ জ্ঞানের পাঁচটি সিরিজ বই “সোনামণিদের সাধারণ জ্ঞান”। ১১ মে ২০১৫ সালে রাজ্যপালের বাসভবনে “বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন” গ্রন্থটির মোড়ক উন্মোচন করেন বিচারপতি শ্যামল কুমার সেন। ভারতীয় উপ-মহাদেশের প্রখ্যাত কালজয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যকুমার সেন সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গ ভারতের প্রাক্তন মাননীয় রাজ্যপাল ও প্রধান বিচারপতি শ্যামল কুমার সেন বলেছেন, “ইতিহাস সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলায়-মাস্টারদা সূর্য কুমার সেন এর মতো অনেক মহৎ বিপ্লবীর জন্মের কারনে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম পূর্ববঙ্গের বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য কুমার সেন। ভারতীয় ইতিহাসে মাষ্টারদা সূর্যসেন প্রথম এদেশের মানুষকে স্বাধীনতার স্বাদ এনে দেন। চট্টগ্রামে মাস্টারদা সূর্যসেন ব্রিটিশ শাসনের জাল ছিঁড়ে প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন এবং স্বাধীন ঘোষণা করেন। ঐ সময় চট্টগ্রাম চারদিন স্বাধীন ছিলেন। চট্টগ্রামের জালালবাদ পাহাড় তার ঐতিহাসিক সাক্ষী। মাস্টারদা সূর্যসেন গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাকামী মানুষের আলোর ঠিকানা নির্মাণ করেছেন। গণতন্ত্রের পথযাত্রায় সঠিক প্রেরণাদাতা বিপ্লবী হিসেবে তিনি আজীবন আমাদেরকে প্রেরণা জোগাবে। সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী মানুষ ছাড়াও পৃথিবীতে গণতন্ত্রকামী মানুষ এই বিপ্লবীকে সম্মান করেন। তিনি আলোকিত মানুষের প্রাত:স্মরণীয় মনীষী। তাঁর জীবন ও কর্ম বর্তমান প্রজন্মের সকলের কাছে পৌঁছায়ে দেওয়া আমাদের নৈতিক ও পবিত্র দায়িত্ব। এই দায়িত্বটা লেখক, গবেষক সোহেল মো. ফখরুদ-দীন বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন নামে স্বারক গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে আরো সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন।” এই সময় অন্যান্যর মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট সুফী গবেষক হায়দার আলী চৌধুরী, মরমী গবেষক ও প্রাবন্ধিক ডা. বরুণ কুমার আচার্য্য বলাই, ভারতের রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত জাতীয় শিক্ষক ও বঙ্গীয় সাহিত্য সমিতির কলকাতা শাখার সভাপতি ড. সুশীল ভট্টাচার্য্য, কলকাতার বিপ্লবী কবি সমরেন্দ্র দাশগুপ্ত ও চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্রের সভাপতি সোহেল মো. ফখরুদ-দীন। ২১ ডিসেম্বর ২০১৬ সালে রাজ্যপাল শ্যামল কুমার সেন আমার লিখিত শিশুদের জন্য সাধারণ জ্ঞানের পাঁচটি সিরিজ গ্রন্থ সোনামণিদের সাধারণ জ্ঞান এর মোড়ক উন্মোচন করেন এবং পাঁচটি শিশুতোষ ইতিহাস গ্রন্থ রাজ্যপালের নাতনির হাতে তুলে দিয়ে তিনি আমাদের উদ্দেশ্যে বলেন, “শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ কর্ণধার, রাষ্ট্রনায়ক, প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষক, বিচারপতি, মন্ত্রী, আইন প্রণয়নকারী ও শিল্পী-কবি-সাহিত্যিক। তারাই হবে আমাদের যোগ্য উত্তরাধিকার। তাদেরকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। যুগোপযোগী শিক্ষার মাধ্যমে আলোকিত নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। শিশু বয়সে তাদের মানবিক গুণাবলীর শিক্ষা দিতে হবে। তাদেরকে বুঝিয়ে দিতে হবে, তারাই হবে একদিন এই রাষ্ট্রের নায়ক। একদিন তারাই চালাবে এই দেশ। উৎসাহের মাধ্যমে কঠিনকে সহজভাবে পড়াতে হবে। শিশুদের মনের বাসনায় তারা বড় হয়ে বিশ্বকে জয় করবে এই শক্তি যোগাতে হবে।” সে বারের সংক্ষিপ্ত মোড়ক উন্মোচনকালেও উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় জাতীয় শিক্ষক ও নিখিল বঙ্গ ভারত সাহিত্য পরিষদ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শাখার সভাপতি ড. সুশীল ভট্টাচার্য, বিচারপতি শ্যামল কুমার সেনের সহধর্মিণী মিসেস শ্যামল কুমার সেন, ডা. এম এ তাহের জামান, বিশিষ্ট নজরুল গবেষক অধ্যক্ষ ড. কামাল উদ্দিন, ভারতীয় প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী রুনা চৌধুরী রায়, কবি মুহাম্মদ আসিফ ইকবাল, সুদর্শনা সেন প্রমুখ। আমার পরম সৌভাগ্য যে বাংলা ভাষা দরদী পশ্চিমবঙ্গের শক্তিমান রাজনীতিক ও বিচারপতি শ্যামল কুমার সেনের মাধ্যমে দুইবার বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করার সুযোগ। ভারত যতবার গমন করেছি ততবারই ফোনে এবং সরাসরি তাঁর সাথে যোগাযোগ হয়েছে। প্রত্যেক বারেই তাঁর বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বাংলার প্রতি ও বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর সম্মান ও মর্যাদাশীল কথাবার্তা দেখে আমি সত্যিই মুগ্ধ। বিচারপতি শ্যামল কুমার সেন চট্টগ্রামের আরেক কৃতী সন্তান ব্রহ্মচারী মুরাল ভাইকে আন্তরিক সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখেন। মুরাল ভাই কলকাতার দক্ষিণেশ্বরে বিশাল এক আশ্রম ও অনাথ শিশুদের পিতৃতুল্য দায়িত্ব পালন করে জগৎ বিখ্যাত হয়েছেন। ধর্ম প্রচারক হিসেবে যেমন মুরাল ভাই শ্রেষ্ঠ, তেমনি অনাথ শিশু ও প্রবীণদের প্রতি রক্ষণাবেক্ষণে অতুলনীয় ভূমিকা পালন করে আসছেন। বিচারপতি শ্যামল কুমার সেন সেই ব্রহ্মচারী মুরাল ভাইকেও চট্টগ্রামের মানুষ হিসেবে সম্মান ও মর্যাদায় বারেবারে আমাদের কাছে তুলে ধরেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ২১তম রাজ্যপাল বিচারপতি শ্যামল কুমার সেন। এখনো সভা-সেমিনার-সিম্পোজিয়াম-সাহিত্য সভায় নিয়মিত যাতায়াত। সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি জানা পাণ্ডিত্য লোক। সভা সেমিনারে তাঁর বক্তব্য মানুষকে মুখরিত করে তোলে। কম কথা বলা ও মৃদু হাসির এই মানুষটি আমি যতবার তাঁর সম্মুখে গিয়েছি ততবার আমি মুগ্ধ হয়ে ফিরেছি। জীবনদাতা বিধাতার কাছে বিচারপতি শ্যামল কুমার সেনের নিরোগ প্রার্থনা করি আমি। সমাজে তাঁর মতো মানুষ বেঁচে থাকা মানে একটি দেশ, একটি ভাষা ও সুন্দর সমাজ নির্মাণে এগিয়ে যাওয়া। আমি তাঁর সমৃদ্ধিপূর্ণ জীবনের নিরোগ ও সুস্থতা কামনা করছি।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply