২৯ মার্চ ২০২৪ / ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ / দুপুর ১:৩১/ শুক্রবার
মার্চ ২৯, ২০২৪ ১:৩১ অপরাহ্ণ

ক্যাসিনোর বিস্তারে সামাজিক অবক্ষয় ও ভয়াবহতা

     

ডাঃ মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন

মানুষ সামাজিক জীব। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সামাজিক জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। এই সামাজিক জীবন যাপনে মানুষ নানা রকম সুবিধা-অসুবিধা ভোগ করে থাকে আর এই সুবিধা-অসুবিধার ক্ষেত্রেও এই সমাজেরই এক শ্রেণির মানুষের হাত থাকে। ভাল মানুষগুলো সমাজকে ভাল কিছু উপহার দেয়ার চেষ্টা করে। বিপরীতে মন্দ লোকগুলো সমাজে মন্দ বিস্তারের চেষ্টা করে। গত কিছু দিন ধরে প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেক্ট্রিনিক মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গোটা বাংলাদেশ তোলপাড় একটা বিষয় নিয়ে। যে বিষয় টা আমাদের জন্য আনন্দদায়ক নয়। আমাদের জন্য সু-খবরও নয়। বিশেষ করে ঢাকাসহ সারাদেশের মানুষের জন্য চরম বিব্রতকর খবর। পৃথিবীতে এই ঢাকা শহরের একটা গৌরবজনক নাম রয়েছে।  বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার সমন্বয়ে ঢাকার চেয়ে হাজারো উন্নত শহর রয়েছে পৃথিবীতে। তবে হাজারো বদনামের মধ্যে ঢাকার একটি সু-খবর আছে। পৃথিবীর মানচিত্রে একমাত্র বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা মসজিদের শহর নামে পরিচিত। আর এই শহরেই মাথাচড়া দিয়েছে ক্যাসিনো জগত। যা নিয়ে আজ তোলপাড় সারাদেশ এমনকি সারা বিশ্ববাসীও তাকিয়ে দেখছে আমাদেরকে। কি ঘটতেছে এই দেশে। মূলত: ক্যাসিনো শব্দটি ইংরেজি যার বাংলা অর্থ হয়: নাচ বা জুয়াঘর। মুক্ত বিশ্বকোষ-উইকিপিডিয়ায় বলা হয়েছে: “ক্যাসিনো হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের জুয়া খেলার একটি নির্দিষ্ট স্থান যাকে বাংলায় জুয়ার আড্ডা বা আসর বলা যায়। কিন্তু সেটা হয় সুবিশাল পরিসরে। সাধারণত ক্যাসিনো এমনভাবে বানানো হয় যে এর সাথে কিংবা পাশাপাশি হোটেল, রেস্টুরেন্ট, শপিংমল, আনন্দভ্রমণ জাহাজ এবং অন্যান্য পর্যটন আকর্ষণ থাকে৷ কিছু কিছু ক্যাসিনোয় সরাসরি বিনোদন প্রদান যেমন স্ট্যান্ড আপ কমেডি, কনসার্ট, খেলাধুলা ইত্যাদির ব্যবস্থা থাকে।” সম্প্রতি বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় জুয়া খেলার আড়ত হিসেবে বেশ কয়েকটি ক্যাসিনো খুঁজে পাওয়া গেছে। গত কয়েক বছর ধরে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় ক্যাসিনোগুলো পরিচালিত হয়েছে। ইতোমধ্যে জনগণের মনে ঘটনাটি ব্যাপক শোরগোলের সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে দারিদ্র্য, বৈষম্য, বেকারত্ম এতো প্রকট হওয়া সত্ত্বেও কিভাবে এসব ক্যাসিনোর মতো জুয়ার আড়ত চালু রয়েছে! এই প্রশ্ন এখন সবার মনে। এই ক্যাসিনো আধুনিক যুগের এলিটদের বিলাসিতার একটি মাধ্যম। ক্যাসিনোর মাধ্যমে এক শ্রেণির মানুষ বিশেষ করে আয়োজক এবং ব্যবস্থাপকরা গাণিতিক হারে লাভবান হচ্ছে। পক্ষান্তরে অধিকাংশ গ্রাহক সব হারিয়ে পথে নেমে যাচ্ছে, এতে করে সমাজের মানুষের মাঝে সামাজিক বৈষম্যতা সৃষ্টি হচ্ছে এবং এক পর্যায়ে পুঁজি হারা লোকগুলো নানান রকম অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে সমাজের শান্তিময় পরিবেশকে বিনষ্ট করছে। গবেষণায় উঠে এসেছে যে, জুয়া খেলার ফলাফল হলো মাদকাসক্ত, ভারসাম্যহীনতা, উদ্বাস্তুমুখীতা ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। এটি সমাজে অসংখ্য সমস্যার জন্ম দেয়। আসক্ত ব্যক্তির মধ্যে পরনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায়, যা সমাজে গুরুতর অবস্থার সৃষ্টি করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, জুয়া খেলায় আসক্ত পরিবারে অন্যান্য পরিবারের চেয়ে হতাশা, দুর্ব্যবহার, অশান্তি, স্বাস্থ্যহীনতা, হিংসা-বিদ্বেষের প্রবণতা অনেক বেশি। একজন জুয়াড়ির সামাজিক খাপ খাওয়ার ক্ষমতা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। এক পর্যায়ে মানসিকভাবে সমাজ থেকে দূরে অবস্থান করতে বাধ্য হয়।

জুয়াখেলার সঙ্গে আত্মহত্যার সম্পর্ক রয়েছে, এ বিষয়ে প্রায় কোনো সন্দেহ নেই বলে গবেষকরা মনে করেন। একটি গবেষণামূলক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, জুয়াড়িদের কারণে সৃষ্ট সমস্যা মাদকাসক্তের চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, জুয়াখেলা মাদকাসক্তের সূচনা করে। জুয়াড়িদের স্ত্রীদের ভাষ্য মতে, তারা হতাশা, মৌখিক ও দৈহিক দূর্ব্যবহার ও আত্মহত্যার পদক্ষেপ গ্রহণের মুখোমুখি হন। তাছাড়াও জুয়াখেলায় আসক্ত ব্যক্তিরা স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় অনেক বেশি হতাশা, দূর্বল স্বাস্থ্য, শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত সমস্যা, অনিদ্রা, বিদ্বেষ, রাগ, মাথা ব্যাথা, পেটব্যাথায় ভুগেন, যা ব্যক্তির মধ্যে কর্মহীনতার মানসিকতাকে তীব্র করে তোলে। ঢাকার মতো বহুমুখী সমস্যা কবলিত শহরে ক্যাসিনোগুলো বিদ্যমান সমস্যাগুলোকে আরো তীব্র ও প্রকট করে তুলছে। বেকারত্ব ও হতাশাকে পুঞ্জিভূত করে স্বার্থান্ধ গোষ্ঠীগুলো কেবল অর্থের পাহাড় তৈরি করছে। এর প্রভাব পড়ছে পুরো রাষ্ট্রে। বিচারহীনতা, বৈষম্য, বেকারত্ম, হতাশা, অপরাধ, আত্মহত্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমস্যাগুলো রাষ্ট্রে দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিচ্ছে।

জুয়া খেলার কারণে পুরো সমাজে এক ধরণের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ক্লাবের আড়াল নিয়ে স্থাপিত ক্যাসিনোতে মদ-জুয়া ও নারীদের অবৈধ ব্যবসা চালানোর বিরুদ্ধে আইন শৃংখলা বাহিনীর চলমান অভিযানে এখনো একদিকে যেমন অর্থ, মদ ও অস্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি জড়িতদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি বেরিয়ে আসছে অপরাধ জগত সম্পর্কিত নতুন নতুন বিস্ময়কর অনেক তথ্যও। এরকম সর্বশেষ এক তথ্যে জানা গেছে, চিহ্নিত ক্লাবগুলোতে শুধু নয়, অন্য অনেক স্থানে এমনকি রাজধানীর অভিজাত এলাকার বিভিন্ন ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টেও মদ-জুয়ার আসর বসতো। চালানো হতো ক্যাসিনোর ব্যবসা। সেগুলো এখনো সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়নি। শুধু ক্লাবই নয়, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ফ্ল্যাটবাড়িতেও অবৈধ ক্যাসিনো চলছে। এসব ক্যাসিনো চালাচ্ছেন ক্ষমতাসীনদলের বিভিন্ন পর্যায়ের কথিত নেতারা। যা আমাদের জন্য খুবই হতাশাজনক খবর, কেননা সরকার দলীয় লোক এতে জড়িত বলেই কিছু ক্ষেত্রে সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ঢাকায় এমন ২১টি ক্যাসিনোর বিষয়ে তথ্য পেয়েছে র‌্যাব।

ভয়ানক তথ্য হলো এসব ফ্ল্যাট ও ক্লাবে ক্যাসিনো পরিচালনার কারিগরি দিকগুলো দেখতেন শতাধিক নেপালি নাগরিক। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলেছে, এসব বিদেশি ভ্রমণ ভিসায় এসে দিনের পর দিন জুয়া পরিচালনার কাজ করেছেন। ১৮ সেপ্টেম্বর চারটি ক্লাবের ক্যাসিনোতে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালানোর পর এসব নেপালি গা ঢাকা দিয়েছেন। এঁদের পালাতে সহায়তা করেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের লোক। তাও ভয়াবহ খবর। কেননা ওই সূত্রের দাবী ঢাকার বিভিন্ন ক্যাসিনোতে শতাধিক নেপালি কাজ করতেন। তাঁরা প্রতিদিন মোট লাভের ২০ শতাংশ পেতেন। এ ছাড়া একেকজনের আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা বেতনও ধার্য আছে। তাঁরা টাকা অবৈধভাবে পাচার করে নিয়ে যান। সম্প্রতি সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এই অবৈধ হোতাদের সমূলে উৎপাঠন ও বিনাশ করার জন্য আইনশৃংঙ্খলা বাহিনী অভিযান পরিচালনা করেছে। আর এইসব অভিযানে ধরা পড়েছে বেশ কয়েকজন ক্যাসিনো হোতাসহ সকল অপকর্মের মূল নায়কগণ। যারা দলীয় পরিচয় দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট, বিদেশে পাচার করেছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে এবং এইসবের সাথে যারা সম্পৃক্ত তাদেরকেও বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়া ও অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তাতেই মূলত দেশবাসীর স্বস্থি। আমরা এই অভিযানকে স্বাগত জানাই। আমরা চাই ক্যাসিনোর মতো অপকর্মগুলো বন্ধ হউক।

এই ক্যাসিনো বা অবৈধ অপকর্ম থেকে রক্ষা করতে পারে একমাত্র ধর্মীয় চর্চা ও অনুভুতি। সামাজিক অবক্ষয় থেকে রক্ষা পেতে ধর্ম চর্চা করা যেমন জরুরী, তেমনি ধর্মীয় অনুশীলন গুলো পালন করাও জরুরী। মানুষের মাঝে যখন সৃষ্টিকর্তার ভয় অন্তরে যাগ্রত হবে তখন সে সর্বপ্রকার অন্যায় এবং অপরাধ থেকে নিজেকে বিরত রাখবে। আর অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। তাই অবসর সময়কে কোন না কোন কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে হবে। কেন না অবসর সময়ে শয়তান মানুষকে বিপথগামী করা চেষ্টা করে। মূলত রাজধানীর অভিজাত এলাকার ফ্ল্যাট ও এ্যাপার্টমেন্ট গুলোতে ক্যাসিনোসহ জুয়া ও মদের আসর বসানোর খবর আমাদের জয় ভয়াবহ। বিভিন্ন ক্লাবে শুধু নয়, মদ ও জুয়া ছড়িয়ে পড়েছে রাজধানী সহ পুরো দেশে। সেই সাথে রয়েছে নারীদের নিয়ে ব্যবসাও। যা যুবসমাজের নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটিয়ে দেশকে ধ্বংসের ধার প্রান্তে নিয়ে যাওয়ার পায়তাঁরা। সরকারকে অনতিবিলম্বে এই বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। তৎপর এবং কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সকল অপরাধের দৃশ্যমান শাস্তি প্রদানের নজির রাখতে হবে। নয়তোবা আগামী প্রজন্মের জন্য ভয়ানক পরিস্থিতির ঘনঘটা রেখে যেতে হবে আমাদের।

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply