২৫ এপ্রিল ২০২৪ / ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / দুপুর ১:৩৫/ বৃহস্পতিবার
এপ্রিল ২৫, ২০২৪ ১:৩৫ অপরাহ্ণ

ধর্মীয় সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির এক অনন্য নিদর্শন গুরুদুয়ারা নানকশাহী

     

একেশ্বরবাদ ও স্রষ্টার সার্বভৌমত্বের বাণী প্রচার করার লক্ষে ইসলাম এবং হিন্দু ধর্মের সমন্বয়ে এক নতুন ধর্মের প্রবর্তন করেছিলেন গুরুনানক দেব । ধর্মে ধর্মে ভেদাভেদ নয়, বরং সম্প্রীতির আহ্বান রয়েছে তার প্রবর্তিত এই শিখ ধর্মাচারে।ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, নারী-পুরুষ নির্বিশেষ সবার সমান অধিকার আছে বলে বিশ্বাস করেন শিখধর্মাবলম্বীগণ । শিখধর্মাবলম্বীগণ ধর্মযাত্রা, উপবাস, কুসংস্কার এবং অন্যান্য রীতি-নীতিতে বিশ্বাস করে না। গুরু নানাক এই সৌম্যের বাণী প্রচার করতেই সুদূর পাঞ্জাব থেকে এসেছিলেন বাংলা প্রদেশে ।
১৬০৪ সালে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে ঢাকার এই স্থানে কিছু সময়ের জন্য অবস্থান করেন নানকশাহী। এর প্রায় একশ’ বছর পর সেখানে গড়ে ওঠে শিখদের এই গুরুদুয়ারা। এটি বাংলাদেশে থাকা গুরুদুয়ারাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়।
শিখ ধর্মের অনুসারীরা ছাড়াও প্রতিদিন এখানে আসেন বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষ। বিশেষ করে শুক্রবার হয় শিখদের সবচেয়ে বড় জমায়েত। বড় জামায়াতকে কেন্দ্র করে প্রতি শুক্রবার শিখ ধর্মের অনুসারীদের ভিড় জমে গুরুদুয়ারা নানকশাহীতে । সবার মাথায় শোভা পায় ‘খাণ্ডা’ আঁকা গেরুয়া রুমাল।
সবাই মিলে অংশ নেন লঙ্গরে, যেখানে সব মত আর পথ এসে মিলে খাবারের পাত্রে। এভাবেই সম্প্রীতির এক অনন্য নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ভবনের বিপরীত পাশে এই গুরুদুয়ারা নানকশাহী।
গুরুদুয়ারা ব্যবস্থাপনা কমিটি থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, শিখদের ষষ্ঠ গুরু হর গোবিন্দের সময়কালে এক ধর্ম প্রচারকের তত্ত্বাবধায়নে শুরু হয় এ গুরুদুয়ারার নির্মাণ কাজ । দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকার পর ১৮৩৩ সালের দিকে গুরুদুয়ারার সংস্কার করা হয়। ভারত বিভক্তির পর ১৮৪৭ সাল থেকে এটি আবার পরিত্যক্ত হয়ে পরে । একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় এর দুই সেবাদার শরণ সিং ও মুহম্মদ-উল-মালিক পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে শহীদ হন। স্বাধীনতার পর উপসনালয়টি পুনরায় সংস্কার করা হয়।
বর্তমানে গুরুদুয়ারায় আছে মোট ৯টি কক্ষ । এর চারদিকে ছয়টি প্রবেশপথ। তাঁরকাটাযুক্ত উঁচু প্রাচিরবেষ্টিত গুরুদুয়ারার বর্তমান প্রবেশপথটি রয়েছে দক্ষিণদিকে রোকেয়া হলের বিপরীত পাশে । সবুজ লন পেরিয়ে মূল উপাসনালয়। ভবনের ওপরে খাঁজকাটা নীল রঙ দিয়ে শিখ ধর্মের চিহ্ন ‘খাণ্ডা’ আঁকা। গম্বুজের শীর্ষে রয়েছে শিখদের উপাসনালয়ের চিহ্ন ‘ছাত্রার’ । মূল ভবনের পাশে ডানদিকে দোতলা দরবার হল। পশ্চিমে দ্বিতল ভবনটি শিখ রিসার্চ সেন্টার, অফিস কক্ষ ও বিদেশি দর্শনার্থীদের জন্য অতিথি কক্ষ। ২০১১ সালে এটি নির্মান করা হয়। এটির উদ্বোধন করেন তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের স্ত্রী গুরু শরণ কাউর।
দক্ষিণ এশিয়ার পাঞ্জাব অঞ্চলে পনেরো শতকে শিখধর্ম উৎপত্তি লাভ করলেও তা বর্তমানে বিশ্বের প্রধান ধর্মসমূহের মধ্যে অন্যতম একটি ধর্ম। স্বতন্ত্র ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি শিখধর্মে ইসলাম ও হিন্দুধর্মীয় বিশ্বাসের মৌলিক দিকগুলোর সন্নিবেশন ঘটেছে। শিখদের পবিত্র বই ‘গুরু গ্রন্থ সাহেব’-এ শিখ ধর্মের মূল দর্শন অনুধাবন হয়ে থাকে। শিখদের উপাসনালয়কে বলা হয় ‘গুরুদুয়ারা’ ।
শিখ ধর্মাবলম্বীগণ দুটি ধারায় বিভক্ত। নানকপন্থী এবং খালসা। বৃহত্তর অর্থে নানকপন্থীগণই সরাসরি গুরু নানক-এর অনুসারী বা শিখ।
গুরুনানকের অনুসারীদের ‘উদাসী’ বলা হয়। তারা পাগড়ি পরেন না। আর শিখদের দশম গুরু গোবিন্দ সিংহের অনুসারীরা ‘আকালি’। তারা মূলত পাগড়ি পরেন।
প্রতিদিন এখানে মূল পাঞ্জাবি ভাষায় রচিত ‘গ্রন্থসাহেব’ থেকে দশ গুরুর বাণী পাঠ করা হয়। কক্ষের মাঝখানে কাঠের তৈরি বেদির ওপর রয়েছে তুলট কাগজে হাতে লেখা পবিত্র ‘গ্রন্থসাহেব’।
গুরুদুয়ারা ব্যবস্থাপনা কমিটির তত্ত্ব মতে , ‘এখানে শিখদের নবম গুরু তেগ বাহাদুরজি এসেছিলেন। এ জন্য এটি এ দেশের শিখদের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। শুক্রবর এখানে প্রায় বিভিন্ন ধর্মের চার থেকে পাঁচশত’ মানুষের আগমন হয়। তাদের জন্য রয়েছে লঙ্গরখানায় নিরামিষ ভোজন। শিখদের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরাও চরম তৃপ্তি নিয়ে প্রসাদ গ্রহণ করেন।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply