২৯ মার্চ ২০২৪ / ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ / সকাল ১১:৩৪/ শুক্রবার
মার্চ ২৯, ২০২৪ ১১:৩৪ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গবন্ধুর দাফন করিয়েছিলেন যিনি

     

এস কে রেজা পারভেজ 

বাংলাদেশের মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন তিনি, দিয়েছেন স্বাধীনতা। নিজের মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নেয়ার অধিকার দিতে সহ্য করেছেন শত অত্যাচার-নির্যাতন। যুগের পর যুগ শোষিত হয়ে আসা মানুষকে দিয়েছেন মুক্তির স্বাদ। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বাংলাদেশের স্থপতি তিনি। দেশের মানুষের জন্য আজীবন সংগ্রাম করা এই মানুষটি যেভাবে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন সেই কালিমালিপ্ত ইতিহাস দেশের মানুষকে বয়ে বেড়াতে হবে কালে কালে। অথচ মৃত্যুর পর স্বাধীন বাংলার এই স্বপ্নদ্রষ্ট্রার দাফনের আগে গোসল হওয়া নিয়েই ছিলো চরম সংশয়। কারণ যেসব অমানুষ জাতির জনককে হত্যা করে কলঙ্কিত করেছে ইতিহাসকে, তাদের পরিকল্পনায় ছিলো যত দ্রুত সম্ভব বঙ্গবন্ধুর মরদেহ দাফন করা যায়। তাদের ভয় ছিল মানুষের ক্রোধ স্ফুলিঙ্গ হয়ে উঠতে পারে যে কোনো সময়ে।

তাই কুলাঙ্গারদের পরিকল্পনা ছিলো, লাশ গোসল ছাড়াই কবরে নিয়ে যাওয়ার। সে অনুযায়ী কবরও খুড়ে ফেলা হয়েছিলো। কিন্তু একজন কাজী সিরাজুল ইসলাম তা হতে দেননি। বাংলাদেশ পুলিশে তৎকালে কনস্টেবল হিসেবে কর্মরত এই সাহসী মানুষ বঙ্গবন্ধুর লাশের সামনে দাঁড়িয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাকে বলেছিলেন, ‘মরদেহের গোসল করাতে হবে।’ আর তিনিই তা করাতে চান।

এরপর কাজী সিরাজুল অসীম সাহস নিয়ে পরম মমতায় জাতির জনককে গোসল করালেন। নিজেই নামলেন কবরে। সেখানেও যতœ নিয়ে মরদেহ রাখলেন অন্তিম শয়ানে। দু:খজনক, লোমহর্ষক ও আবেগে স্তব্ধ করা সেই সময়কার কথা রাইজিংবিডিকে জানিয়েছেন, স্বয়ং সেই সৌভাগ্যবান কাজী সিরাজুল ইসলাম। শুনুন তার মুখেই…

’৭৫ সালে আমি তখন বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত। গোপালগঞ্জে পোস্টিং। গোপালগঞ্জ সাব ডিভিশন পুলিশ অফিসার (এসডিপিও) আবদুল মান্নানের দেহরক্ষী হিসেবে কর্মরত ছিলাম (কনস্টেবল নম্বর ২০৭৩)।

কিছুদিন ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ফরিদপুর যাবো, নতুন পোশাক আনতে। ডিউটি না থাকায় ১৪ আগস্টের দিন আমি কাপড় আনতে ফরিদপুর যাই। তখন আমাদের কাপড়, রেশন, বেতন সবই ফরিদপুর থেকে দেওয়া হতো। পোশাক নিয়ে চলে আসবো এর আগে ভাবলাম গোপাল সরদারের চায়ের দোকানে একটু যাই।

গোপাল আমাদের গ্রামের ছেলে। ফরিদপুরে তার একটি চায়ের দোকান আছে। সেখানে গিয়ে বন্ধু লুলু শিকদারের (একই গ্রামের বাসিন্দা) সঙ্গে দেখা। ওর সাথে দেখা হওয়ায় কোনোভাবেই আমাকে আসতে দিলো না। আমাকে বললো, ‘আজ যেতে পারবা না।’ মালেক ভাইয়ের (আবদুল মালেক, একই গ্রামের বন্ধু) বাসায় ভাবি নাই, বাসা ফাঁকা আমরা সারারাত তাস খেলবো। মনিও (মনি মিয়া, গ্রামের আরেক বন্ধু) আছে।

আমি এতো বললাম স্যারকে বলে আসি নাই, আমার যেতে হবে। কিছুতেই শুনলো না। ওই রাতে চার বন্ধু হোটেলে খেয়ে মালেক ভাইয়ের বাসায় গিয়ে তাস খেলতে শুরু করলাম। রেডিও শুনছি আর তাস খেলছি। রাত গভীর হলে আমরা একখাটের ওপরই যে যেভাবে পেরেছি কাত-চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু কারো রেডিও আর বন্ধ করতে মনে ছিলো না।

হঠাৎ রাত আড়াইটা-পৌনে তিনটা হবে। আমার তখনও ভালো করে ঘুম আসেনি। হঠাৎ রেডিওতে বুলেটিন দিচ্ছে ‘স্বৈরাচার শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।’ দুইবার শোনার পর আমি মালেক ভাইকে ডাকলাম, ‘ও মালেক ভাই ওঠেন, দেখেন তো কে কারে হত্যা করছে? আমি কি ঠিক শুনছি? কি আবোল তাবোল বলছে।’

আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গিয়েছিলাম খবরটা শুনে। সবাইকে জাগালাম। এক মিনিট দেড় মিনিট পর পর একই বুলেটিন দিচ্ছে। তখন বুঝলাম তিনি (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) আর নেই। এর মধ্যে আমার হাত পা কাঁপা শুরু করছে। আমাদের চারজনের কারো বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে এমন ঘটনা ঘটেছে। যিনি আমাদের আলাদা একটি জাতিসত্তা উপহার দিলেন তাকেই হত্যা করা হলো…কিভাবে সম্ভব?

হঠাৎই আমার মনে হলো আমি তো ফরিদপুরে। এখন স্যার (এসডিপিও) যদি আমাকে খোঁজেন তাহলে কি হবে? এই অবস্থায় আমার চাকরি নিয়েও ভয় পেয়ে গেলাম। কারণ বঙ্গবন্ধু যদি মারা যান, তাহলে তো আমার স্যারের কল পড়বে। আমি বললাম, ভাই আমার আর এক মিনিটও বসে থাকার সময় নাই। এখনই গোপালগঞ্জের দিকে রওনা দিতে হবে। কিন্তু এই রাতে কিভাবে যাবো তা নিয়ে বন্ধুরা চিন্তায় পড়ে গেলেন।

রাত তখন তিনটার মতো বাজে। ওই অবস্থায় পুলিশ পোশাক পরে রওনা দিলাম। তখনকার সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার অবস্থা তো খুবই খারাপ ছিলো। অনেক কষ্ট করে কখনো ট্রাক, কখনো হেটে, কখনো লঞ্চে করে গোপালগঞ্জ এসে পৌছালাম। সেখানে পৌঁছে সোজা বাসায় চলে আসি।
সকাল সাড়ে ৭টার দিকে পুলিশ এসে বাসায় হাজির। তারা বললো, ‘সিরাজ ভাই তাড়াতাড়ি আসেন, এসডিপিও স্যার আপনারে ডেকে পাঠিয়েছেন।’ দ্রæত স্যারের কাছে গেলাম। পরে সেখানকার ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল কাদের সাহেব, এসডিপিও স্যার এবং আমি একটি স্পিড বোটে চড়ে চলে আসলাম টুঙ্গিপাড়ায়। বঙ্গবন্ধুর মরদেহ তখনও আসেনি। আমরা টুঙ্গিপাড়া থানায় অপেক্ষা করছিলাম। এরই মধ্যে জানতে পারলাম কবর খোড়ার কাজ হচ্ছে।

আনুমানিক বেলা ১০টা-১১টার দিকে বঙ্গবন্ধুর মরদেহ হেলিকপ্টারে করে নিয়ে আসা হলো। মরদেহের সঙ্গে একজন মেজর আর একজন কনস্টেবল দেখতে পেলাম। হাসপাতাল ও পুলিশের লোক মরদেহ বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নিয়ে আসলো। মরদেহের কফিনের চারপাশ থেকে কঠিন করে পেরেক দিয়ে আটকানো ছিলো। শাপল এনে পেরেক উঠিয়ে কফিন খোলা হলো। দেখলাম মরদেহ চা পাতি আর বরফ দিয়ে ঢাকা। বঙ্গবন্ধুর মরদেহ সাদা একটি কাপড়ে মোড়ানো। কাপড়টি কাফনের কাপড় নয়, আগলা একটি কাপড়।

তখন আমি ওই মেজর সাহেবের কাছে জানতে চাইলাম, ‘স্যার লাশের তো গোসল হয়নি মনে হচ্ছে।’ মেজর সাহেব কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বললো, ‘কে কার গোসল করাবে।’ আমি বললাম, ‘স্যার কবর যখন খেঁাঁড়া হয়েছে, মুসলমান হিসেবে তাকে গোছল দিতে হবে, কাফন দিতে হবে, তারপর দাফন করতে হবে।’ তখন উনি আমার ওপর একটু রেগে গিয়ে বললেন, ‘আপনার বাড়ি কোথায়।’  সব খবর পড়তে এখানে ক্লীক করুন

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply