১৭ এপ্রিল ২০২৪ / ৪ঠা বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ভোর ৫:৫৫/ বুধবার
এপ্রিল ১৭, ২০২৪ ৫:৫৫ পূর্বাহ্ণ

আজকের শিশুরাই আগামীর স্বপ্নময় ভবিষ্যতের দিশারী

     

লায়ন ডাঃ বরুণ কুমার আচার্য বলাই

শিশুরা ফুলের মত স্নিগ্ধ, পবিত্র ও নিঃপাপ। শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যৎ কর্ণধার। ভবিষ্যৎ শান্তি, সংস্কৃতি ও সভ্যতা নির্ভর করে শিশুদের উপর। সুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশ গড়বে এ শিশুরাই। পৃথিবীর হাসি-গান- আনন্দের নিরন্তর উৎস হলো তারা। আজকের শিশুরাই আগামীর স্বপ্নময় ভবিষ্যতের দিশারী। এদের মধ্য থেকেই কেউ হবে বিজ্ঞানী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, রাষ্ট্রনায়ক প্রভৃতি। তাই আমাদের শিশুদের প্রতি প্রতিটি অভিভাবককে যতœশীল হতে হবে। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী সকল মানুষকে শিশু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে। আজ যে শিশু আগামী দিনে সে পিতা, দেশের নাগরিক ও নেতৃত্ব প্রদানকারী একজন পরিপূর্ণ মানুষ। নশ্বর এই পৃথিবীতে একজন চলে যায় আরেকজনের আগমনের মাধ্যমে সে স্থান পূর্ণ করে। এক্ষেত্রে একজন শিশু যোগ্য হয়ে গড়ে উঠলেই কেবল পারে সমাজকে বিকশিত করতে, আলোকিত করতে। শিশু গড়বে দেশ, যদি পায় পরিবেশ। বস্তুত প্রশ্ন জাগে এই শিশুদের জন্য সত্যিকারের একটা বাসযোগ্য বাংলাদেশ কি আমরা গড়তে পেরেছি? শিশুরা কতটা নিরাপদে আছে আমাদের দেশে! তাদের বেঁচে থাকার অধিকার, পূর্ণমাত্রায় বিকাশের অধিকার, শাসন-শোষণ নির্যাতন-কুপ্রভাব, পাচার, পতিতাবৃত্তি থেকে নিরাপদ থাকার অধিকার এবং পারিবারিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনে পুরোপুরি অংশগ্রহণের অধিকার ইত্যকার বিষয়ে আজও আমরা সামগ্রিক সাফল্য অর্জন করতে পারিনি। সাধারণত উপযুক্ত শিক্ষা প্রদান, স্বাস্থ্য পরিচর্যা এবং আইনগত নাগরিক ও সামাজিক সেবা প্রদানের মাধ্যমে শিশুদের অধিকার গুলো সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। যা কেবলমাত্র রাষ্ট্রীয় সুশাসন, প্রচলিত আইন ও নীতির যথার্থ প্রয়োগের মাধ্যমেই বাস্তবায়ন সম্ভব। সেক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তার, শিশুর দরিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যে নানাবিধ অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম থেকে শিশুদের নিবৃত্ত করা, নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা, শিশুর জীবন রক্ষা ও সুস্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা বিধান করা, অতঃপর শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ও উন্নয়নে রাষ্ট্র কর্তৃক সার্বিক প্রচেষ্টা গ্রহণ মূলত এর আওতাভুক্ত। শিশু অধিকার বিষয়ে বলা হয়েছে, শিশুর শারীরিক ও মানসিক অপরিপক্কতার কারণে জন্মের আগে ও পরে তাকে উপযুক্ত আইনি সুরক্ষাসহ বিশেষ নিরাপত্তা ও পরিচর্যা দিতে হবে। অর্থাৎ শিশুর নিরাপত্তা ও সুষম বিকাশের জন্য প্রত্যেক জাতির ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের যথাযথ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। অথচ আমাদের দেশে আমরা শিশুদের ক্ষেত্রে সেই মানবিক মূল্যবোধ, মর্যাদা, ন্যায়বিচার ও শান্তির ভিত্তি সার্বিক অর্থে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। রাজধানী ও সারাদেশে এমন অগণিত শিশু রয়েছে যাদের পথেই জন্ম, পথেই বসবাস। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, রাজধানীসহ সারাদেশে যে প্রায় ৩৪ লাখ পথশিশু রয়েছে তাদের শতকরা ৮০ ভাগেরই জন্ম ফুটপাতে। বাংলাদেশের দূর-দূরান্ত থেকে স্বজনহারা এসব পথশিশুরা এসে শহর-বন্দরে জড়ো হয়। দারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাতে, অবহেলা, অযতেœ এসব শিশুরা মাদকাসক্ত হয়ে নানা প্রকার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের দেখা মেলে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল, স্বল্পন্নোত বা অনুন্নত দেশগুলোতে এদের দেখা বেশি মেলে। আমাদের দেশেও চারদিকে তাকালেই এ ধরনের শিশুর দেখা মেলে। রাস্তা বা ফুটপাত যাদের ঠিকানা। বড়লোকের আহ্লাদে বড় হয়ে ওঠা শিশুদের পাশাপাশি এরাও বড় হয়। অভাব যাদের জীবনে নিত্যসঙ্গী। খোলা আকাশ যাদের মাথার ওপর ছাদ হয়ে থাকে। জন্মের পরপরই তারা পৃথিবীর এক অন্যরকম চিত্র দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠে। ধনী-গরিবের ব্যবধান তারা জন্মের পরেই দেখতে পায়। দুঃখের বিষয়, এসব ভাগ্যহীন, পরিচয়হীন শিশুদের আমরা কখনো টোকাই, কখনো পথকলি, ছিন্নমূল বা পথশিশু বলে ডাকি। পথই যাদের আপন, পথই যাদের চূড়ান্ত ঠিকানা। কিন্তু যাদের জন্ম হয় পথে অথবা জন্মের পর ঠাঁই হয় পথে আর জীবন পার হয় পথে এবং শেষও হয় সেই পথেই। এরা পথশিশু। যাদের জন্য সমাজের, রাষ্ট্রের, সুশীল সমাজের সবারই দায় রয়েছে। এসব পথশিশুরা বঞ্চিত হয় রাষ্ট্র প্রদত্ত মৌলিক অধিকার থেকে। এরা অনেকেই শিক্ষা লাভ করার সুযোগ পায় না, পুষ্টিকর খাদ্য পায় না, পোশাক বা মাথার নিচে ছাউনি পায় না। যদিও রাষ্ট্র থেকে এদের জন্য বিভিন্ন সময় নানারকম পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তবে তা পর্যাপ্ত নয়। কারণ, প্রতিনিয়তই এই ধরনের পথশিশুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সে অনুযায়ী আমাদের দেশের একটি বড় অংশই শিশু। এসব অধিকার বঞ্চিত শিশুকে আত্মশক্তিতে বলিয়ান করে তুলতে চাই উপযুক্ত শিক্ষা ও পরিবেশ। সঠিক পরিবেশ আর অযতœ-অবহেলায় যেন তারা শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, সে বিষয়ে যুগোপযুগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে যেসব ভাসমান শিশুদের অবস্থান তাদের জন্য সমন্বিতভাবে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বছর বছর পথশিশুদের নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, টকশোতে সমবেদনা ঝরে, এদের নিয়ে নানা পরিকল্পানা পদক্ষেপের কথা শোনা যায়। কিন্তু এর বাস্তবায়নের হার খুবই অপ্রতুল। ফলস্বরূপ ছিন্নমূল শিশুরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে। অথচ, আর দশটা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা শিশুর মতোই এদের রয়েছে পুষ্টিকর খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার অধিকার। কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য শিশুর জন্য একটি নিরাপদ বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলার যে অঙ্গীকার করেছিলেন, তা আজও সম্ভব হয়নি। পথশিশুর শিক্ষায় অনেক বেসরকারি সংস্থাও কাজ করছে। তবে তা অপর্যাপ্ত। বিভিন্ন কারণে ঢাকা মহানগরী ছাড়াও অন্য বিভাগীয় শহরগুলোতে ভাসমান শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। তবে রাজধানীতে এই সংখ্যা বেশি। কারণ বেঁচে থাকার সুযোগ এখানেই বেশি। এসব পথশিশুদের সমাজের সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রের পাশাপাশি নাগরিক হিসেবে আমদেরও দায়িত্ব রয়েছে। সবাইকে সেই দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসতে হবে। পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশ জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে তা প্রতিপালনের জন্য ১৯৯০ সালে সেই সনদে স্বাক্ষর করে। সে অনুযায়ী শিশু অধিকার বাস্তবায়নের সূচকে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। শিশুদের দারিদ্র্য বিমোচন, পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করাসহ হতদরিদ্র ও ছিন্নমূল শিশুদের পুনর্বাসন, পর্যায়ক্রমে শিশুশ্রম নিরসন, শিশুদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার বন্ধ করা ও তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে শিক্ষা ও বিনোদনের উপযুক্ত সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাস্তবভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা ও কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন। মানবাধিকার নিশ্চিতকরণ ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় প্রতিটি শিশুর অধিকারকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক শিশুর অধিকার সংরক্ষণের মাধ্যমে একটি কর্মক্ষম ভবিষ্যত প্রজন্ম গড়ে তোলার ক্ষেত্র প্রস্তুতের দায়িত্ব রাষ্ট্র ও সমাজের রয়েছে। সেটা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর মনে রাখতে হবে, যোগ্য শিশু বিনির্মাণে রাষ্ট্র ও সমাজের পৃষ্ঠপোষকতা অনস্বীকার্য।

লেখক: প্রাবন্ধিক, মরমী গবেষক ও গ্রন্থপ্রনেতা।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply