২৪ এপ্রিল ২০২৪ / ১১ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ভোর ৫:০২/ বুধবার
এপ্রিল ২৪, ২০২৪ ৫:০২ পূর্বাহ্ণ

বায়ুদূষণ : কালো ধোঁয়ার শহর চট্টগ্রাম

     

আজহার মাহমুদ

আমরা সবাই জানি বায়ুদূষণে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ শহরের তিন নম্বরে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। ঢাকায় যে পরিমাণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি হচ্ছে সে পরিমাণ গাড়ি, কলকারখানা, বিল্ডিংসহ সব কিছু বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার কারণে দিন দিন দূষণের মাত্রাও বৃদ্ধি হচ্ছে। শুধু বায়ুদূষণই নয়, সব ধরনের দূষণ ঢাকায় হচ্ছে। তবে এ সমস্যাটা এখন চট্টগ্রামেও দেখা দিচ্ছে। শ্যামল প্রকৃতির এক জেলা চট্টগ্রাম। এখানেও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে জনসংখ্যা। সেই সঙ্গে দিন দিন দূষণের মাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে। যেভাবে শব্দদূষণ সেভাবে বায়ুদূষণ। দেশে নিয়ম হয়েছিল সব গাড়ি এবং কলকারখানায় যেন কালো ধোঁয়া বন্ধ করে দেয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। চট্টগ্রাম শহরে প্রায় সব গাড়িতেই দেখা মেলে কালো ধোঁয়া। আর গাড়ি থেকে এত পরিমাণ ধোঁয়া বের হয়, যা কয়েক মিনিটের জন্য রাস্তাকেও অন্ধকার করে তোলে। আর সে সময় যারা নিঃশ্বাস নিচ্ছেন তাদের হচ্ছে মারাত্মক সব রোগ।

গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সব থেকে বেশি পড়ে শিশুদের ওপর, তাদের বয়স ১০ থেকে ১২ বছরের নিচে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে বছরে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছেন শুধু বায়ুদূষণের কারণে এবং প্রায় ১০ লাখ মানুষ, বিশেষ করে শিশু এবং গর্ভবতী মায়েরা আছেন অনেক ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। এর প্রধান কারণ হিসেবে বাতাসে সিসার উপাদান বেশি থাকাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যে কারণে শিশুরা সহজেই হৃদরোগ এবং শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগে ভুগে থাকে। বর্তমানে আমাদের দেশে শহরগুলোর রাস্তাঘাটে শিশুরা মুখে মাস্ক পরে চলাফেরা করছে, এই দৃশ্য এখন একটি সাধারণ বিষয়। রাস্তায় যেমন ধুলাবালি তেমন গাড়ি এবং কলকারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া। এ থেকে বাঁচার জন্য মুখে মাস্ক পরা। কিন্তু এতেও পুরোপুরি নিরাপদ নয় শিশুরা। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মতে মাস্ক পরলেও নিঃশ্বাসের সঙ্গে কিছু জীবাণু শরীরের ভেতর প্রবেশ করবেই। যা পরর্বতী সময়ে ভয়ংকর হয়ে ওঠে।

বায়ুুদূষণ নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংস্থা ‘স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার’ তাদের প্রতিবেদনেও বিষয়টি ওঠে এসেছে। সেখানে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বাসিন্দাদের ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ কোনো না কোনোভাবে বায়ুুদূষণের মধ্যে বাস করছেন। বায়ুুদূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর মারা যাচ্ছেন ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ আর ভারত ও চীনে মারা গেছেন ১২ লাখ মানুষ। সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ২০১৭ সালের হিসাবে প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন বায়ুুদূষণের কারণে মারা যাচ্ছেন।

বায়ুুদূষণের শিকার হয়ে যে ১০টি দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি মারা যাচ্ছেন, সেসব দেশের মধ্যে রয়েছে চীন, ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া আর যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম। যার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম।

সংস্থাটি আরো বলছে, সড়ক দুর্ঘটনা বা ধূমপানের কারণে মৃত্যুর হারের তুলনায় ২০১৭ সালে বায়ুুদূষণের ফলে বেশি মানুষ মারা গেছেন। এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। বায়ুুদূষণের শিকার হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রতিটি শিশুর ৩০ মাস করে আয়ুু কমে যাচ্ছে। বিশ্বের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো সবচেয়ে বেশি বায়ুুদূষণের শিকার।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বায়ুুতে ক্ষতিকর বস্তুকণার পরিমাণ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া সিমার ১০ গুণের বেশি। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন দূষিত বাতাসের মধ্যে থাকলে যেসব রোগ হতে পারে, তার মধ্যে আছে হৃদরোগ, কাশি, নিউমোনিয়াসহ ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি রোগ, ফুসফুসের সংক্রমণ, ফুসফুসের ক্যানসার, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা ও শ্বাসকষ্টজনিত নানা রোগ, স্ট্রোক, চোখে ছানিপড়া, শিশু ও গর্ভবতী নারীদের সমস্যা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি প্রজন্ম যদি দীর্ঘসময় বায়ুুদূষণের মধ্যে কাটিয়ে দেয়, তার মারাত্মক প্রভাব পড়ে পরবর্তী প্রজন্মের ওপর। তাই এখনই বায়ুদূষণ থেকে রক্ষা করতে হবে জাতিকে। বায়ুদূষণ মুক্ত দেশ গড়তে পারলে বাংলাদেশ অনেক উপকৃত হবে। দেশের মানুষের গড় আয়ুু বাড়বে, জলবায়ুু পরিবর্তন মোকাবিলা সহায়তা হবে, রোগ সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে, প্রতিবন্ধী সমস্যা কমে আসবে, অর্থনৈতিক সুবিধা বাড়বে।

বায়ুুদূষণের অন্যতম কারণ হচ্ছে যানজট। যানজটে মাধ্যমে শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ দুটোই বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু দূষণরোধে কর্তৃপক্ষের জোরালো পদক্ষেপের অভাবে বায়ুুদূষণের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। অপরিকল্পিতভাবে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠা, যেখানে সেখানে ইটভাটা স্থাপন, শহরের মধ্যে নানা কারখানা স্থাপন তো বায়ুুদূষণের এক একটি কারণ। সেই সঙ্গে শহরের প্রচুর ধুলা এবং নির্মাণ কাজের বায়ুুদূষণ হচ্ছে। ট্রাফিক জ্যামের কারণে গাড়িগুলো রাস্তায় অতিরিক্ত সময় ধরে চলছে, সেগুলো অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ করছে, এসবও বায়ুুদূষণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। বায়ুুদূষণের কারণে পরিবেশ অতিরিক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে, সেই গরম ঠান্ডা করার জন্য মানুষ অতিরিক্ত এসি ব্যবহার করছে, আবার তাতে বায়ুুদূষণ আরো বাড়ছে।

এ দূষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা। রাস্তায় পানি দিয়ে ধুলা নিয়ন্ত্রণ বা ময়লাগুলো পুড়িয়ে ফেলা, পরিকল্পিতভাবে কারখানাগুলোর ধোঁয়া কমিয়ে আনা এবং কারখানাগুলো শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়া, ট্রাফিক জ্যামের সমাধান, উন্নত জ্বালানি ব্যবহার করা, এয়ার কন্ডিশনার কম ব্যবহার করা। এসব বিষয় নিয়ে সবাই যার যার অবস্থান থেকে সচেতন হলে আমি মনে করি বায়ুদূষণ অনেকটা কমে আসবে। এছাড়াও প্রচুর বনায়ন করা, কারণ গাছ বায়ুুদূষণ প্রতিরোধে জোরালো ভূমিকা রাখে। বাড়িঘর ও আবাসিক এলাকাগুলো পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা, যেখানে উদ্যান ও পুকুর থাকবে। নির্মাণ কাজগুলো নিয়ন্ত্রিতভাবে করা, যাতে সেটি দূষণের কারণ না হয়। এসব কাজ আমাদের নিজেদের। আমরা চাইলেই এসব বিষয় মাথায় রেখে কাজ করতে পারি। কিন্তু আমরা করি না। কারণ আমরা আমাদেরকেই ভালোবাসি না। অন্তত নিজেকে ভালোবাসলেও নিজের পরিবেশ ভালো রাখতে চাইব। আমি আমার স্থান থেকে আমার ঘর, এলাকা দূষণমুক্ত রাখার চেষ্টা করলেই হবে। দেখা যাবে এভাবে একদিন দেশটাও হবে দূষণমুক্ত।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply