২৫ এপ্রিল ২০২৪ / ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / বিকাল ৫:২০/ বৃহস্পতিবার
এপ্রিল ২৫, ২০২৪ ৫:২০ অপরাহ্ণ

পাঠ্য বইয়ের আগ্রহ কেড়ে নিচ্ছে ফেসবুক

     

 

মাহমুদুল হক আনসারী

ক্লাসের জন্য পাঠ্য বই পাঠ ও শিক্ষা গ্রহণ অতীব জরুরী। ক্লাসের পাঠ শিখতে হলে পাঠ্য বইয়ের বিকল্প নেই। প্রাথমিক স্তর থেকে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ পর্যন্ত নির্ধারিত পাঠ্য বইয়ের উপর পড়ালেখা করতে হয়। জীবনে যিনি যত  বড় মাপের জ্ঞানী মানুষ হয়েছেন, তিনি তত বেশি পাঠ্য বই পড়াশুনা করেছেন। পাঠ্য বই ছাত্র শিক্ষক উভয়কে রপ্ত করতে হয়। শিক্ষক পাঠ্য বই থেকে ছাত্রদের পাঠ ও অনুশীলন শিক্ষা দিবেন। ছাত্রগণ শিক্ষকের পাঠ্য বইয়ের আলোকে আলোচনা এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনুধাবন নোটিং করবেন। এ নিয়মে একজন ছাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র পর্যন্ত এভাবে জ্ঞান আদান প্রদানের সিস্টেম আমরা দেখে এসেছি। আজকে যারা পৃথিবীর বড় বড় দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, গবেষক, লেখক ও বুদ্ধিজীবী এবং রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন তাঁরা এভাবেই লেখাপড়া করেছেন। রাষ্ট্রপ্রধান থেকে মন্ত্রীপরিষদ, দেশ বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ গুণী মানুষগুলো এভাবেই লেখাপড়া করে আলোকিত মানুষ হয়েছেন। পাঠ্যবই অধ্যায়ন আর পাঠ পর্যালোচনা ছাড়া কোনো ছাত্র সঠিকভাবে জ্ঞানের সাগরে পদার্পণ করতে পেরেছে বলে জানা নেই। সেক্ষেত্রে আজকের এ আধুনিক যুগে শিক্ষার স্তর গুলোতে কী হচ্ছে আর কী দেখছি সেখানেই অভিভাবক মন্ডলী না ভেবে পারছেনা। আধুনিক সব সুযোগ সুবিধার মধ্যে আজকের ছাত্ররা লেখাপড়া করছে। এখন থেকে দুই যুগ পূর্বে এমন আধুনিক সুযোগ সুবিধা ছিলনা। এখন ছাত্ররা পাঠ্যবই থেকে ইন্টারনেট, অনলাইন, কম্পিউটারসহ বিভিন্ন আধুনিক ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ার মাধ্যমে দেশ বিদেশের আধুনিক শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে। সাথে সাথে তথ্য আদানপ্রদান করতে  পারছে। শুদ্ধ আর ভুল নির্ণয় করতে সমস্যা হচ্ছেনা। আধুনিকতার এ যুগে পাঠ্যপুস্তকের সাথে যোগাযোগ ও অধ্যায়ন না করে গাইডবুক এবং ফেইসবুকের আসক্ত হয়ে পড়ছে ছাত্ররা। বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেখা যায় প্রাইমারী থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত অনেক শিক্ষক ও গাইডবুক হাতে নিয়ে ক্লাস করাচ্ছে। ছাত্রদের গাইডবইয়ের সিরিয়াল ধরে প্রশ্নোত্তর তৈরি করে দিচ্ছে। তাহলে সৃজনশীল শিক্ষা আর ছাত্রদের মেধা কীভাবে বিকাশ হবে। স্কুল ,বাসাবাড়ি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে গৃহশিক্ষক ও গাইড বইয়ের অনুসরণে ছাত্রদের পাঠদান করছে। দেখা যায়, ছাত্র-ছাত্রীরা এখন কমবেশি মোবাইল আসক্ত হয়ে পড়ছে। যাদের হাতে মোবাইল রয়েছে সে সারাক্ষণ মোবাইলের বিভিন্ন ফাংশান নিয়ে ব্যস্ত। মোবইল আর ফেসবুকের ব্যস্ততায় ছাত্র জীবনের মূল্যবান সময় অগোচরেই জীবন থেকে কেড়ে নিচ্ছে। ছাত্র যেভাবে মোবাইল ফেসবুকে ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যস্ত সময় পার করছে, একইভাবে শিক্ষকগণও কী ক্লাস আর কী ক্লাসের বাইরে ব্যস্ততম সময় পার করছে, আধুনিক যন্ত্র মোবাইল আর ফেইসবুকে। ছাত্রতো সে ছাত্রই তার মনমানসিকতা ছাত্র হিসেবেই থাকবে। কিন্তু একজন শিক্ষক যখন ক্লাসে বসে মোবাইলে ব্যস্ত সময় পার করে তখন ছাত্রদের কী আর করার থাকে। ক্লাসের সময় গল্প আর গুজবে পার করে গাইড বইয়ের পাতা উল্টিয়ে ছাত্রদের প্রশ্ন আর উত্তর সিলেবাস ঠিক করে দেয়া হয়। পরীক্ষার জন্য কী কী প্রশ্ন আসতে পারে সেসব প্রশ্ন গাইড বই থেকে ছাত্রদের ঠিক করে দেয়। তাহলে এসব শিক্ষা আর শিক্ষক জাতিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেটায় এখন অভিভাবকগণ গুরুত্বের সাথে ভাবছে। শিক্ষক অবশ্যই সম্মান ও  শ্রদ্ধার পাত্র। বলতে গেলে তাদের উদ্দেশ্যে অনেক কিছু বলা যায়। আজ থেকে একযুগ পূর্বেও যে সমস্ত অনৈতিক অভিযোগ শিক্ষকদের বেলায় বলা কঠিন ছিল, আজকে সে ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। নিত্যদিন পত্রিকার পাতা খুললেই কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক কর্তৃক অনৈতিক কর্মকান্ডের সংবাদ পাওয়া যাবে। শিক্ষক হলেই যে তিনি আদর্শ নৈতিকতা সম্পন্ন হবেন সেটা অন্ততপক্ষে আজকের যুগে বলা কঠিন। একসময় শিক্ষক সমাজ ছিলো আলোকিত মানুষ। সমাজ তাদেরকে অনুসরণ অনুকরণ করতো। তারাই সমাজের ভালো মন্দ দেখিয়ে দিতেন। আজকের সমাজে সে চিত্র পাল্টে গেছে। এখন আর ওই ধরনের শিক্ষক ও আলোকিত মানুষ শিক্ষঙ্গনে দেখা যায়না। এখন শিক্ষা বলতে গেলে বেচা বিক্রি হচ্ছে। শিশু থেকে উচ্চডিগ্রি নিতে রাস্তায় রাস্তায় বিদ্যালয় কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার বিনিময়ে কী পরিমাণ অর্থ আদায় করবে তার কোনো সঠিক নিয়ম নীতি নেই। থাকলেও তা মানা হয়না। ইচ্ছেমতো ভাবে বেতনভাতা ভর্তি ফি অন্যান্য কত ধরনের ফাঁদ সেখানে বসানো হয়েছে। যেনো তেনো ভাবে অভিভাবকের পকেট কাটিয়ে বিশাল এক বাণিজ্য বসিয়েছে শিক্ষার নামে এসব প্রতিষ্ঠান। সরকারের নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে কতিপয় প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন অথবা রেজিষ্ট্রেশন থাকলেও হাজার হাজার শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনো ধরনের নিয়মনীতি ও  অনুমোদন দেখা যায়না। যার যেখানে ইচ্ছে সেখানেই গড়ে তুলছে কোমলমতি শিশুদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ধর্মীয় ও আধুনিক আকর্ষণীয় নাম ব্যবহার করে এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। জাতীয় আন্তর্জাতিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের নামকে এসব প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করছে। লেখাপড়ার তুলনায় চাকচিক্য বেশভূশ সে এক বাহারী ধরনের কর্মযজ্ঞ। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রশাসনের সঠিক নিয়ন্ত্রণ দেখছিনা। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আড়ালে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অহরহ অনৈতিক দুর্ঘটনা ঘটছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসব প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়ত শিশু নির্যাতন ও  হত্যার সংবাদ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জানা যায়। সে ধরনের একটি ঘটনা গত ১০ এপ্রিল ২০১৯ চট্টগ্রামের বায়েজীদ এলাকার অনন্যা আবাসিক এলাকায় মাদ্রাসা ওমর ফারুকে সংঘটিত হয়েছে। সেখানে হাবীবুর রহমান নামে একজন ১২ বছরের শিশুকে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে। এধরনের ঘটনা সারাদেশে অসংখ্যভাবে ঘটছে। কিছু ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে সংবাদ হয়ে আসে, আর কিছু নীরবে চাপা পড়ে যায়। সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যে সকল শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠছে এসব প্রতিষ্ঠান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন। একই সাথে ক্লাসের পাঠ্যবই পাঠ অনুশীলন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। কোনো অবস্থায় গাইড বই নির্ভর ক্লাস ও শিক্ষা কার্যক্রম চলতে দেয়া যায়না। শিক্ষক তার সঠিক দায়িত্ব ছাত্রদের উদ্দেশ্যে প্রদান করবেন। শিক্ষক যদি গাইড বই নির্ভর হয় তাহলে ছাত্ররা সেক্ষেত্রে কোথায় তাদের শিক্ষার্জন নিয়ে যাবে সেখানেই অভিভাবকদের চিন্তার শেষ নেই। যেকোনো মূল্যে শিক্ষক এবং ছাত্রদের গাইড বই নির্ভরতা প্রতিরোধ করতে হবে। ফেইসবুক মোবাইল আসক্তি যেকোনো মূল্যে অভিভাবক মন্ডলীকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত  ছাত্রদের কোনোভাবেই মোবাইল ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বিদ্যালয়ে মোবাইলের ব্যবহার ছাত্রশিক্ষক সকলের কঠোর হস্তে বন্ধ রাখতে হবে। যে সকল শিক্ষক বিদ্যালয় ক্লাসে অনিয়ন্ত্রিত মোবাইল ব্যবহার করবে তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে আইনানুক ব্যবস্থা নিতে হবে। রাষ্ট্রের সমস্ত সুযোগ সুবিধা সরকারী ও বেসরকারী এমপিও ভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীগণ ব্যবহার করছে। কিন্তু সে তুলনায় শিক্ষা ও ছাত্রদের নৈতিক মূল্যবোধ তৈরীতে অবদান আশা ব্যঞ্জক নয়। শিক্ষকের চাহিদা পূরণে সমাজ যেভাবে দায়িত্ববান শিক্ষকসমাজ সেভাবে ছাত্র ও  অভিভাবকদের আশা পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। শিক্ষকের আচার চালচলন ছাত্রদের আলোকিত মানুষ হিসেবে তৈরী করছেনা। শিক্ষক কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের বাইরে প্রাইভেট কোচিং সেন্টার বসিয়ে অনৈতিকভাবে ছাত্রদের কোচিং পড়তে বাধ্য করছে। স্কুলে ঠিকভাবে সিলেবাস না পড়িয়ে তার কোচিংয়ে পরীক্ষায় পাশের জন্য তৈরী করে দিচ্ছে। এ ধরনের অসংখ্য অভিযোগ  ও কর্মকান্ড শিক্ষক সমাজের বিরুদ্ধে রয়েছে সরেজমিনে তা দেখা যায়। এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। ক্লাসে তিনি বুঝাতে পারেননা কিন্তু তার কোচিং সেন্টারে ঠিকই অর্থের বিনিময়ে ছাত্রদের পরীক্ষার প্রস্তুত করা হয়। এভাবে আজকের শিক্ষক সমাজ বিদ্যালয় সবকিছু এক মহা অনৈতিক সাগরে নিমজ্জিত। সময় থাকতে জাতীর আগামী দিনের ভবিষ্যৎকে সুন্দর ও শৃংখলায় রাখতে অবশ্যই শিক্ষা শিক্ষক ছাত্রদের অনৈতিকতার লাগাম টেনে ধরতে হবে। গাইড বই ফেইসবুক মোবাইলের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ছাত্রদের নাগালের বাইরে রাখতে হবে। অভিভাবকগণকেও এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। বই ও ক্লাসের প্রতি আসক্তি এবং সঠিকভাবে লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হয়ে আলোকিত সমাজ গঠনে তৈরী করতে তাদের প্রতি কড়া নজরদারীর দায়িত্ব পালন করতে হবে।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply