হাদিসের আলোকে তিনটি কবিরা গুনাহ প্রসঙ্গ আলোচনা
তানভিরুল ইসলাম
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ(রাঃ)বর্ণনা করেন,আমি রাসুলাল্লাহ(সাঃ)কে জিজ্ঞেসা করলাম,হে আল্লাহর রাসুল!আল্লাহর নিকট সবচেয়ে বড় গুনাহ কোনটি? তিনি বললেন, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে বড় গুনাহ হচ্ছে কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করা।অথচ তিনিই তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।আমি বললাম নিশ্চয় ওই ধরনের গুনাহ সবচেয়ে বড়।
আমি বললাম এরপর বড় গুনাহ কোনটি? তিনি(সাঃ)বললেন,তোমার নিজ সন্তানকে হত্যা করা এ ভয়ে যে, সে তোমার সাথে ভক্ষণ করবে।এরপর আমি আবার জানতে চাইলাম যে,তারপর বড় গুনাহ কোনটি?তিনি উত্তরে বললেন, তুমি তোমার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া।[বোখারী শরীফ ২য় খন্ড,হাদিস নং৬৪৩]
হাদিসের ব্যাখ্যা: উপরোক্ত হাদিসটির মধ্যে এমন তিনটি বিয়ের অবতারণা ঘটেছে যার প্রত্যেকটিই বর্তমান সমাজে অধিক হারে পরিলক্ষিত হয়। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ(রাঃ)’র প্রশ্নের উত্তরে রাসুল(সাঃ) এমন তিনটি বিষয়ের কথা বলেছেন,যার প্রত্যেকটিই কবিরা গুনাহের অন্তর্ভূক্ত।উক্ত হাদিসে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ(রাঃ)কে রাসুল(সাঃ)প্রথম যে গুনাহের কথাটি বললেন তাহলো-আল্লাহর সাথে কাউকে সমকক্ষ সাব্যস্ত করা।
রাসুল(সাঃ)বলেন- ‘‘সবচেয়ে বড় গুনাহ হলো তোমার পক্ষ থেকে অন্য কাউকে আল্লাহর সাথে সমকক্ষ বানানো কেননা তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন”।সত্যিকার অর্থে রাসুল(সাঃ)’র উক্ত কথাটি ব্যাখ্যা করলে ও গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে,এ জগতে আমরা প্রতিনিয়ত আল্লাহর সাথে সমকক্ষ দাঁড় করে থাকি কি ইবাদতে,কি বিভিন্ন কাজ কর্মে।প্রথমে আসা যাক কিভাবে আমরা ইবাদতে আল্লাহর সাথে শিরক করি?
এই জগতে যাদেরকে আমরা ধর্মগুরু বা শরীয়তের ধারক বাহক হিসেবে জানি তারা হলেন আলেম ওলামা,মোহাদ্দিস,মোফাস্সির,মুফতি সাহেবগণ।তাঁরা কোরআন হাদিসলব্ধ জ্ঞান দ্বারা বলে থাকেন যে,কপাল একমাত্র আল্লাহ তায়ালার জন্য,তিনি ছাড়া অন্য কারো জন্য বা কোন কিছুর জন্য তা নত করা যাবে না।যদি করা হয় তা কূফুরি হবে, কথাটি অত্যন্ত সত্য কিন্তু তাদেরকে যদি প্রশ্ন করা হয় যে, নামাজে সিজদা কাকে করেন ?এবং কিভাবে করেন? তখন তারা উত্তর দেন আমরা আল্লাহকেই সিজদা করি,আমরা মনে করি তিনি আমাদের সিজদার জায়গায় আছেন এবং আমাদেরকে দেখছেন।মরে করি বিশ্বাসের উপর যত সব ইবাদত আমরা করে থাকি। বাস্তবে আল্লাহ সম্পর্কে আমাদের কোন ধারনা ও অভিজ্ঞতা নেই ।বাস্তবে যা আমরা দেখি ও যাতে আমাদের কপাল ঠেকাই তা কোনো না কোনো জড়বস্তু ছাড়া আর কিছু নয়। যার সাথে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক নাই।যদি ইবাদতের ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্বাস এমন হয় তাহলে আমরা ওই সকল জড়বস্তুকে আল্লাহর সমকক্ষ বানালাম,যা শিরকেরই নামান্তর।
অন্যদিকে আমাদের যাবতীয় কর্মকান্ডে কিভাবে আমরা আল্লাহর সাথে শিরক করি তা আলোচনা করলে দেখা যায় যে,আল্লাহ হলেন “আলা কুল্লি শাইয়্যিন ক্বাদির” তথা সব কিছুর উপর একমাত্র ক্ষমতাবান তিনিই।যাঁর আদেশ ছাড়া একটি বালিকণা পর্যন্ত নড়াছড়া করতে পারে না। যা কোরআন হাদিস দ্বারা প্রমাণিত ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য।অর্থাৎ প্রতিটি কাজ মূলত আল্লাহ দ্বারা সম্পাদিত হয়।কিন্তু কিভাবে তা আমরা জানিও না বুঝিও না,আরো দুঃখজনক ব্যাপার হলো-বুঝা ও জানার জন্য আমরা চেষ্টাও করি না।অথচ প্রতিনিয়ত কোরআন হাদিসের বিপরীত কথা আমরা বলে থাকি এভাবে যে,কাজটি আমি করেছি, ওটি সে করেছে, এটি তুমি করেছ ইত্যাদি।আল্লাহর শানের উপর সমকক্ষতার অভিযোগের নামান্তর।প্রকৃত ইমানদারই পারে শিরকমুক্ত ইবাদত করতে ও তাঁর ইবাদতে আল্লাহকে উপস্থিত করতে।যার প্রতিটি কর্ম আল্লাহ দ্বারা সম্পাদিত হয়। যা তাঁরা খুব ভালোভাবে অবগত। অন্যদিকে যার ইবাদতে আল্লাহর বাস্তব উপস্থিতি নেই,যার কর্ম আল্লাহ দ্বারা সম্পাদিত হয় না বরং নিজেই নিজের কাজ সম্পাদন করে তারা কোনো অবস্থায় শিরক থেকে নিজেকে বাঁছাতে পারে না।
রাসুল(সাঃ) উক্ত হাদিসে দ্বিতীয় যে কবিরা গুনাটির কথা বললেন তা হলো-“তুমি তোমার সন্তানকে এই বলে হত্যা করিও না যে,সে তোমার সাথে খাবার গ্রহণ করলে তোমার সংসারে অভাব অনটন আসবে।অথচ আল্লাহ তায়ালা সবারই রিযিক দাতা। এই বিষয়টি না বুঝার কারণে আমরা নানাবিধ দ্বন্ধ পড়ে যাই।যার প্রেক্ষিতে প্রশ্ন আসে জন্মনিয়ন্ত্রণ জায়েয কিনা? ধর্মীয় দৃষ্টিতে পরপর সন্তান নেওয়ার ফলে মা ও শিশুর জীবনের যে কোন ধরণের ঝুকি থাকলে ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যত রকম নিরাপদ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি আছে সব রকমের পদ্ধতি ব্যবহার করা জায়েয।
হাদিসে পাকে রাসুলে আকরাম (সাঃ) তৃতীয় যে কবিরা গুনাহটির কথা বলেছেন তাহলো-“প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া।যা রাসুল(সাঃ)হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ(রাঃ)’র প্রশ্নের জবাবে এভাবে বলেছেন যে,তোমার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করাও কবিরা গুনাহ। একথাটি বলার পেছনে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে।যেমন-১)রাসুল(সাঃ) জানতেন যে ,তাঁর উম্মতের মধ্যে এমন চরিত্রের ব্যক্তিও থাকবে,যারা প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে যেনা ব্যভিচারে জড়িয়ে যাবে।তাই তাদেরকে সতর্ক করার জন্য একথা বলেছেন।২)আমাদের মানব সমাজে বসাবাস করতে গিয়ে একের সাথে অন্যের এত বেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়ে যায় যে,একে অন্যের ঘরে অনায়াসে আসা যাওয়া করার সুযোগ পায়।ফলে বন্ধু বা প্রতিবেশীর অনুপস্থিতিতে ঐ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তার স্ত্রীর সাথে ঝোরপূর্বক যেনার কাজে লিপ্ত হয়। আর তা থেকে বাঁছার জন্য একথা বলেছেন।৩)পরাকীয়তা-এটি আমাদের সমাজে এক বিষাক্ত মহামারীরূপে ছড়িয়ে পড়েছে। যার পিছনে শুধু পুরুষেরা দায়ী নয়।বরং নারীরাও দায়ী। এধরনের সমস্যা নারী-পুরুষ উভয়ের সম্মতিতে সৃষ্টি হয়।কারণ পরাকীয়তা শব্দটি এমন শব্দ যার অর্থ হলো অন্যের স্ত্রীর সাথে অবৈধ সম্পর্ক তৈরি করে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া।এ সমস্যার জন্য আরেকটি বিষয় বেশি সহায়ক হিসেবে কাজ করে, তাহলো-‘ডোন্টমাইন্ড’তথা অবাধ মেলা মেশা সৃষ্টিকারী পরিবেশ।ইসলাম কিছুতে অসংযত ও মাত্রাতিরিক্ততা কোন অবস্থাতেই সমর্থন করে না।৪)পরিবার ও সমাজ থেকে শান্তি নষ্ট করে। এটি আমরা সবাই জানি ও মানি যে,একজন পুরুষ যখন নিজের ঘরে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও অন্যেও স্ত্রীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়,তখন উভয় পরিবারে অশান্তি নেমে আসে,মান সম্মান ক্ষুন্ন হয়ে যায়,সমাজে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে যায়।
পরিশেষে উক্ত হাদিসের মূল কথা আমরা এভাবে বলতে পারি যে,কোনো অবস্থায় আল্লাহর সাথে শিরিক করা যাবে না।সর্বদা শিরিকমুক্ত ইবাদত করতে হবে।নিজ সন্তান-সন্ততিকে হত্যা করা যাবে না।নিজ বিবাহিত স্ত্রী ছাড়া অন্য কোন নারীর সাথে কোন অবস্থায় যৌন সম্পর্ক তথা ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া যাবে না।