১৯ এপ্রিল ২০২৪ / ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / সকাল ৬:৩৩/ শুক্রবার
এপ্রিল ১৯, ২০২৪ ৬:৩৩ পূর্বাহ্ণ

রাঙামাটিতে তালুকদার-দেওয়ান ত্রিমুখী লড়াই !

     

 

চৌধুরী হারুনুর রশীদ,রাঙামাটি
৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৯-পার্বত্য রাঙামাটি আসনে তালুকদার দেওয়ান ত্রিমুখী লড়াই জমে উঠেছে। আসনটিতে এবার প্রায় সোয়া ৪ লাখ ভোটারের মধ্যে অর্ধেকের বেশী পাহাড়ি ভোটার নিয়ে গচ্ছিত তার বিশাল ভোটব্যাংক নিয়ে নির্বাচনের প্রতীক্ষায় ঊষাতন ও তার দলবল সমর্থকরা। তাকে সমর্থন দিয়েছে ইউপিডিএফও। এবার একাট্টা হয়ে নির্বাচন করছে আঞ্চলিক দুটি দল জনসংহতি সমিতি ও ইউপিএফ। নির্বাচন ঘিরে জোটবদ্ধ হয়ে প্রচারণার মাঠে তারা। ভোট চাইতে মাঠে ব্যস্ত অন্য প্রার্থীরাও। অন্যদিকে কে কাকে ভোট দেবেন, তা নিয়ে মনস্থির করারা চিন্তায় ভোটাররা। মেলাচ্ছেন হিসাব-নিকাশ। এ মুহূর্ত পর্যন্ত এসে জাঁকজমক প্রচারের মধ্যেই জয়ের স্বপ্নে বিভোর নৌকা আর ধানের শীষ। কিন্তু ভোটারের হিসাব-নিকাশে দেখা যায়, প্রকৃত জয়ের সম্ভাবনার কিনারে এগিয়েছে ‘সিংহ’। সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে উঠে আসে এসব নির্বাচনী হালচাল। সব হিসাব-নিকাষে পাহাড়ে আবারো জয়ের সম্ভাবনা মিলছে, জনসংহতি সমিতির সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমান এমপি ঊষাতন তালুকদারের।

প্রতিদ্বন্ধিতায় রয়েছেন, আওয়ামী লীগের দীপংকর তালুকদার (নৌকা), বিএনপির মণিস্বপন দেওয়ান (ধানের শীষ) এবং জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান এমপি ঊষাতন তালুকদার (সিংহ)। গত দশম জাতীয় নির্বাচনে হাতী প্রতীক নিয়ে লড়ে ৯৫ হাজার ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগের দীপংকর তালুকদারকে হারিয়ে আসনটিতে জয়ী হয়েছিলেন উষাতন তালুকদার। দীপংকর পেয়েছিলেন প্রায় ৭৭ হাজার ভোট। এবার নির্বাচনে অন্য তিন প্রার্থী হলেন, জাতীয় পার্টির অ্যাডভোকেট পারভেজ তালুকদার (লাঙ্গল), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির জুঁই চাকমা (কোদাল) এবং ইসলামি শাসন আন্দোলনের মো. জসিম (হাতপাখা)। জয়লাভে মরিয়া যার যার অবস্থান থেকে প্রার্থী সবাই। আসনটি ধরে রাখতে বর্তমান এমপি ঊষাতন তালুকদার এবং পুনরুদ্ধারে মরিয়া আওয়ামী লীগের দীপংকর ও বিএনপির মণিস্বপন।

হিসাব-নিকাশ মিলিয়ে দেখা যায়, বিভাজনে বরাবরই বাঙালিদের চেয়ে অর্ধেকের বেশী পাহাড়ি ভোটার- যা এবারও তার ব্যতিক্রম নেই। আর এসব পাহাড়ি ভোটারের সবাই প্রায় গচ্ছিত জনসংহতি সমিতিসহ অঞ্চলিক দলগুলোর ভোটব্যাংকে। যে কারণে জনসংহতির সমর্থনে ১৯৯১ ও ৯৬ সালে পরপর দু’বার নির্বাচিত হয়েছিলেন, আওয়ামী লীগের দীপংকর তালুকদার এবং ২০০১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমর্থন নিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন, বিএনপির মণিস্বপন দেওয়ান। পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে এককভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী দিয়ে অংশ নেয়, জনসংহতি সমিতি, ইউপিডিএফ ও জেএসএস (এমএন লারমা) গ্রুপ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে দল তিনটি এককভাবে পৃথক প্রার্থী দেয়ায় তিনভাগে বিভক্ত হন পাহাড়ি ভোটাররা। ফলে জয়ী হন আওয়ামী লীগের দীপংকর। কিন্তু এর আগে সর্বশেষ ২০১৪ সালে বিএনপি অংশ না নিলেও দীপংকরকে হারিয়ে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেন, জনসংহতি সমিতির সমর্থিত প্রার্থী ঊষাতন তালুকদার। যদিও সেই নির্বাচনে ইউপিডিএফ ও সংস্কারবাদী জেএসএস (এমএন লারমা) গ্রুপ আলাদা প্রার্থী দিয়ে প্রতিদ্বন্ধিতা করে। তবে ওই নির্বাচনে শেষ মুহূর্তে সংস্কারবাদী জেএসএস (এমএন লারমা) গ্রুপ সমর্থিত প্রার্থী সুধাসিন্ধু খীসাকে সমর্থন দিয়েছিল ইউপিডিএফ। তাদের মনোনীত স্বতন্ত্র প্রার্থী সুধাসিন্ধু খীসা ভোট পেয়েছিলেন ২৪ হাজার ৩৫১।

এদিকে এবার আলাদা প্রতিদ্বন্ধিতায় নেই ইউপিডিএফ। আসনটি ধরে রাখতে জনসংহতি সমিতির সঙ্গে একাট্টা তারা। এ লক্ষ্যে একজোট হয়ে প্রচারণায় মাঠে অবস্থান নিয়েছে জনসংহতি ও ইউপিডিএফ। তারা যৌথভাবে একক প্রার্থীর পক্ষে এরই মধ্যে প্রচারণা প্রায় গুছিয়ে আনতেও সক্ষম হয়েছেন বলে বিশ্লেষণে ওঠে এসেছে। অপরদিকে এবার নির্বাচনে নেই সংস্কারবাদী জেএসএস। যদিও তাদের মুষ্টিমেয় নেতাকর্মীর গ্রুপটি আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। এবার নির্বাচনে প্রায় সোয়া ৪ লাখ ভোটারের মধ্যে অর্ধেকের বেশী পাহাড়ি ভোটার প্রায় জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফ সমর্থিত প্রার্থী ঊষাতন তালুকদারের ভোটব্যাংকে। আর এসব হিসাব-নিকাশ মিলিয়ে দেখা যায়, আবারও ঊষাতন তালুকদারের জয়ের সম্ভাবনার বিষয়টি অনেকটা প্রায় নিশ্চিত হতে চলেছে। কারণ বাঙালি ভোটাররা দুই সিংহভাগে বিভক্ত নৌকা এবং ধানের শীষে। এ ছাড়া তাদের কিছু অংশ ভোট পাবে লাঙ্গল ও হাতপাখা। এখানকার পাহড়িদের জাতীয় রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্তা একেবারে কম। যদিও উভয় দলের প্রার্থীসহ আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে যুক্ত কিছু অংশ পাহাড়ি।
এদিকে শোনা যাচ্ছে, জনসংহতি সমিতি সমর্থন দেয়ায় এবার নির্বাচনেও বিএনপির মনোনয়নে প্রার্থী হয়েছেন মণিস্বপন দেওয়ান। তার সমর্থিত লেকজনসহ স্বয়ং মণিস্বপন এমন কথবার্তার প্রচার করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। যে কারণে প্রকাশ্য জনসমাবেশে এসব কথাবার্তার দাঁতভাঙা জবাব দিয়ে যাচ্ছেন,জনসংহতি সমিতির প্রার্থী ঊষাতন তালুকদার ও তার সমর্থিতরা। এ বিষয়ে প্রকাশ্য সমাবেশে ঊষাতন তালুকদার বলেন, মণিস্বপনের এ ধরনের বক্তব্য প্রচার একেবারে মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যমূলক। জনসংহতি সমিতি কাউকে সমর্থন দেয়নি। আমরা এবার একাট্টা ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করছি।এ ধরনের বিভ্রান্তিমূলক প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে জাত বিক্রির পাঁয়তারা করলেও মণিস্বপনের কোনো ফায়দা আসবে না। মণিস্বপন প্রতারক ও ঠগবাজ। তিনি দুধের মাছি। ২০০১ সালে আমাদের সমর্থনে তিনি জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের কোনো কথা রাখেননি। উল্টো নির্বাচনের পরপরই পার্বত্য চুক্তি লঙ্ঘন করেছিলেন। এবারও জয় নিয়ে আমরা নিশ্চিত। এ জয় কেউ ঠেকাতে পারবে না।

জেএসএস সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী ঊষাতন বলেন, গতবার জয়ী হয়ে পাঁচ বছরে পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়নসহ জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনের চেষ্টা করেছি। অধিকার আদায়ে আন্দোলন আরও বেগবান ও সফল করতে দরকার জুম্ম জনগণের নিজস্ব প্রতিনিধি সংসদে পাঠানো। সেই লক্ষে আমার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতায় আসা। গত পাঁচ বছরে প্রত্যন্ত এলাকায় বিদ্যুতায়নসহ, আর্থ-সামাজিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি। কিন্তু আমার উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে নিজের নাম-ফলক লাগিয়ে উদ্বোধন করছেন, আওয়ামী লীগের দীপংকর তালুকদার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন ও পাহাড়ের উন্নয়নে আন্তরিক। কিন্তু এসবে বাধাগ্রস্ত দীপংকরসহ এখানকার স্থানীয় আওয়ামী লীগ। ঊষাতন তালুকদার এখন বিরামহীন প্রচারণায় মাঠে। তিনি রোববার জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায় নির্বাচনী সফরে ছিলেন।

মাঠে প্রচারণার সরগরম আওয়ামী লীগের দীপংকর তালুকদারের। আসনটি পুনরুদ্ধারে জয় নিশ্চিতে মরিয়া তিনিও। দীপংকর তালুকদার রোববার জেলার কাউখালী উপজেলার ঘাগড়াসহ আশেপাশের এলাকায় প্রচারণা চালান। দীপংকর বলেন, ২০১৪ সালে অবৈধ অস্ত্রের মুখে ভোট ডাকাতি করে তার জয় ছিনিয়ে নিয়েছে জেএসএস। এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। সেই সুযোগ আর নেই তাদের। তাই পরাজয় জেনে মাথা নষ্ট হচ্ছে জেএসএস ও তাদের প্রার্থীর। আওয়ামী লীগের এবারের নিশ্চিত জয় কেউ ঠেকাতে পারবে না।

রোববার প্রচারণার মাঠে জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার সদর ও ফারুয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচনী সফরে ছিলেন, বিএনপির মণিস্বপন দেওয়ান। তিনি বলেন, ধানের শীষের জোয়ার দেখে ক্ষমতাসীনসহ অন্যদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। নির্বাচনকে প্রহসনে রুপ দেয়ার চেষ্টায় তারা। ফলে নির্বাচনী আমেজের পরিবর্তে জনমনে আতঙ্ক তৈরি করেছে। ক্ষমতাসীনদের হামলা, মামলা, ধরপাকড়ে আতঙ্কের মধ্যে নির্বাচন করতে হচ্ছে বিএনপি প্রার্থী ও তাদের নেতাকর্মী-সমর্থকদের। এদিকে সবকিছু মিলিয়ে ৩০ ডিসেম্বরের প্রতীক্ষার নির্বাচনের দিকে দৃষ্টি পার্বত্য জেলা রাঙামাটিবাসী সবার।
জেলার মোট ১০ উপজেলা নিয়ে গঠিত ২৯৯-পার্বত্য রাঙামাটি সংসদীয় আসনটি। আসনটিতে এবার মোট ভোটার ৪ লাখ ১৮ হাজার ২১৭। তন্মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ২০ হাজার ৩৫৪ এবং নারী ১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৬৩ জন।
জেলা রিটানিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশিদ বলেন,আসন্ন ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাঙামাটি আসনে একটি সুন্দর, সুষ্ঠু, অবাধ,নিরপেক্ষ ও সবার গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে প্রস্তুত আমরা। জেলার মোট ১০ উপজেলার সমন্বয়ে গঠিত রাঙামাটি আসনটিতে এবার মোট ২০৩ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ করা হবে। ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেয়ার প্রস্তুতি চলছে। এসব কেন্দ্রের মধ্যে ৪ উপজেলার ২১টিতে মালামাল ও জনবল পরিবহনে হেলিকপ্টার ব্যববহার করা হবে।

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply