২৫ এপ্রিল ২০২৪ / ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ / ভোর ৫:১০/ বৃহস্পতিবার
এপ্রিল ২৫, ২০২৪ ৫:১০ পূর্বাহ্ণ

৩ মে মুজাফরাবাদ গণহত্যা দিবস

     

বিপ্লব সেন
বাঙালি, বাংলাদেশ, মহান মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের অহংকার। আমাদের গৌরবের ও আবেগের জায়গা ১৯৭১ এর মহান বিজয় গাথার পরতে পরতে মিশে আছে অনেক রক্ত, ঘাম, অশ্রু, সহায়, সম্বল ও আত্মত্যাগ আর অস্ফুট আর্তনাদ। ২৫ মার্চ কালো রাত্রিতে পাক হানাদার বাহিনী বাঙালি নিধনে অপারেশন সার্চ লাইটের নামে যে নারকীয় গণহত্যার সূচনা করেছিল নির্বিচারে গুলি বর্ষন, হত্যা, লুন্টন, ধর্ষনের মাধ্যমে তার সুযোগ নিয়েছিল মুজাফরাবাদের স্থানীয় এক মুসলিম লীগ নেতা ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা। পাকিস্তানী হানাদারদের সাথে নিয়ে ৭১এর ৩ মে হিন্দু অধ্যুষিত প্রগতিশীল এ গ্রামটিকে জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে ছাড়খাড় করে দেয় ঐ পাকিস্তানী দোসর। ঐদিন ভোর ৬ টা হতে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চালানো তান্ডবে কেড়ে নেয়া হয় ৩০০ গ্রামবাসীর প্রাণ। অসংখ্য নারীর উপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। লুটে নেয়া হয় ধন, সম্পদ সবকিছু। পূর্বসূরীদের সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলাধীন আমাদের মুজাফরাবাদ ছিল তখন থেকেই শিক্ষা-সংস্কৃতিতে অগ্রগামী জনপদ। প্রায় ৯ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত গ্রামটিতে হাজারো হিন্দু পরিবাবারের বসবাস। সুশিক্ষায় শিক্ষিত এ গ্রামের শিক্ষক, ডাক্তার, বুদ্ধিজীবিরা ছিলেন এতদ অঞ্চলের শিক্ষার আলো বিস্তারের অগ্রপথিক। ১৯৭০ সালে এ গ্রামের একটি সমবায় ব্যাংক নিয়ে বিরোধের জের ধরে হিন্দুদের সাথে চরম শত্রুতা হয় স্থানীয় ঐ মুসলিম লীগ নেতার। হিন্দুদের উপর মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে গ্রেপ্তার, হুমকি দিয়েও কোন লাভ হয়নি তার। তাতে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে যায় ঐ মুসলিম লীগ নেতা। শিক্ষিত জনপদ হিসেবে পরিচিত মুজাফরাবাদের শিক্ষিত প্রগতিশীল যুবকদের অনেকেই অসহযোগ আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিল তাও ঐ পাকিস্তানী দালালের কাছে অজানা ছিলনা। তাই ৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সে তার সুযোগ নেয় প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য। পাকিস্তানী হানাদারদের মুক্তি বাহিনীর ঘাঁটি রয়েছে বলে ও নানান অনৈতিক প্রলোভন দেখিয়ে মুজাফরাবাদ আক্রমনের পরিকল্পনা করে ঐ নরপিশাচ। চট্টগ্রাম কক্সবাজার মহাসড়ক হতে মুজাফরাবাদ গ্রামে প্রবেশের জন্য ছিল তিনটি পথ। তিন দিক থেকেই ভারী অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে রাজাকারদের সাথে নিয়ে আক্রমনে ঝাঁপিয়ে পরে পাক হানাদার বাহিনী। তখন ভোরের আলো ফুটছে কেবল। পূজারীরা পূজার আয়োজনে নিমগ্ন, গৃহ বধুরা থালা বাসন মাজছে কেউ কেউ আর পুরুষ-যুবকদের অধিকাংশই গ্রাম পাহাড়া শেষে ঘুমোতে গিয়ে চোখের পাতা মুদেছে মাত্র। এমন সময় অতর্কিতে হামলায় হতচকিয়ে ওঠে সমস্ত গ্রামবাসী। এরই মধ্যে অনেককেই ধরে নিয়ে মুখের নল ঢুকিয়ে গুলি করে হত্যা করে হায়েনার দল। আর্তনাদ টুকু পর্যন্ত করার সুযোগ হয়নি নিরীহ মানুষগুলোর, নিমিষেই লুটিয়ে পরে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে তারা। যারা তা দেখে এবং গুলির আওয়াজ শুনে পলায়নের চেষ্টায় ছিল, তাদের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে পাখির মত মারা হয়। যারা প্রাণ বাঁচাতে ঝোঁপ-ঝারে লুকিয়ে ছিল, রাজাকারদের সহায়তায় খুঁজে বের করে তাদেরকেও সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে মারা হয়। তাদের পৈশাসিক হত্যাকান্ড হতে রেহাই পায়নি শিশু-কিশোর-বৃদ্ধরা পর্যন্ত। সারাদিন ভর নারীদের উপর চালানো হয় পৈশাসিক নির্যাতন, লুন্টন করা হয় কিশোরী নারীদের সম্ভ্রম। এভাবে প্রায় বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত চালানো হয় তান্ডব। ঘরের সমস্ত ধন, সম্পদ, খাদ্য শস্যাদি লুটে নিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয় বাড়ীর পর বাড়ী। প্রায় নয় বর্গকিলোমিটার জুড়ে কেবল আগুনের লেলিহান শিখা আর পুরো জনপদের এদিক সেদিন লাশের সারি। শরীরের সমস্ত রক্তের শেষ কনাটুকু পর্যন্ত শুষে নিয়ে ভিজে গেছে পবিত্র মাটি। গুলি অবস্থায় সেদিনের মত পালিয়ে গেলেও পরে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে আর টিকে থাকতে পারেনি কয়েকজন। এত লাশ কোথায় নিয়ে যাবে তারা, ফেলে রেখে যায় যত্রতত্র। পরের দিন গ্রামের কিছু যুবক যারা গ্রামের বাইরে অবস্থান করছিল, তারা এসে ছিন্ন ভিন্ন লাশগুলোর কিছু কিছু গর্ত করে মাটি চাপা দিতে সক্ষম হলেও রাজাকারদের আনাগোনার কারণে তাও সম্ভব হয়নি। বোবাকান্না বুকে চেপে ধরে যারা লুকিয়ে পালিয়ে বেঁচেছিল যারা সেদিন, তারা দিনটির কথা স্মরণে আসলেই এখনো গুমরে মরে। মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে শহীদদের স্মৃতিতে গ্রামের মধ্যভাগে স্থাপন করা হয় শহীদ স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয় । গ্রামে একাধিক সংগঠন থাকলেও সকল সংগঠনের যুবকদের সমম্বয়ে গঠন করা হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী সংগঠন ‘সমম্বয়’। এই সংগঠনটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমুন্নত, মহান আত্মত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত, শিক্ষা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান এই মুজাফরাবাদ এর ঐক্যের প্রতীক। নতুন প্রজন্মের কাছে মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরব গাথা ও আদর্শকে সঞ্চারিত করতে সংগঠনটি প্রয়োজনীয় সকল উদ্যোগ নিয়ে কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছে। স্থানীয় এমপি সামশুল হক চৌধুরী, সাবেক সংরক্ষিত মহিলা এমপি চেমন আরা ও উপজেলা প্রশাসনের বিশেষ সহযোগিতায় শহীদ স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন জায়গায় নির্মান করা হয় স্মৃতি সৌধ। বধ্যভূমিকে সংরক্ষন করে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে ও শহীদদের স্মৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের সুযোগ করে দিতে নেয়া সবিশেষ উদ্যোগ, গঠন করা হয় মুজাফরাবাদ বধ্যভূমি সংরক্ষন পরিষদ। সমম্বয় ও বধ্যভূমি সংরক্ষন পরিষদের সম্মিলিত পদক্ষেপের কারণে ১৯৭১ এর ৩মে হানাদার ও রাজাকারদের দ্বারা মুজাফরাবাদে সংগঠিত এ নারকীয় গণহত্যা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্বীকৃত। দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে এ বর্বরোচিত ঘটনাসহ গৌরবদীপ্ত ইতিহাস তুলে ধরতে ওয়েবসাইট খোলাসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহন করে সংগঠন দুটি। এ ব্যাপারে স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিক পত্রিকাসহ ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া সবিশেষ অবদান রেখে চলেছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। প্রতিবছর ৩ মে প্রতিপালন করা হয় দিবসটি। শহীদদের সদগতিতে সম্পন্ন করা হয় শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, প্রদান করা হয় গার্ড অব অনার, শ্রদ্ধাঞ্জলি । আয়োজন করা আরো নানান কর্মসূচী । তাছাড়াও জাতীয় দিবসগুলো প্রতিপালন করা হয় গুরুত্বের সাথে । মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষনে সরকারের বিশেষ উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় জেলা প্রশাসন চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় স্থান সমূহের সংরক্ষন ও উন্নয়নে বিশেষ বরাদ্দ অনুমোদন করে। এ বছর মার্চ মাসে অনুমোদিত এ বরাদ্দ থেকে মুজাফরাবাদ বধ্যভূমি সংরক্ষন ও উন্নয়নের জন্য সাড়ে ছয় লক্ষাধিক টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ৩ মে মুজাফরাবাদ গণহত্যা দিবস পালন করতে গিয়ে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি মহান মুক্তিযুদ্ধেও সকল শহীদ, বীর মুক্তিযোদ্ধ ও নির্যাতিতা মা বোনেদের। স্মরণ করছি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুসহ ৭৫ এর ১৫ আগষ্ট ঘাতকের হামলায় নিহত তার পরিবার, পরিজন ও জাতীয় চার নেতাকে। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়, স্থানীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ, জেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসন, উপজেলা পরিষদ ও প্রশাসন, ইউনিয়ন পরিষদসহ সকল পৃষ্টপোষক, উপদেশক, পরামর্শদাতা, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতি। ৩ মে ২০১৭ বুধবার সমম্বয় ও মুজাফরাবাদ বধ্যভূমি সংরক্ষন পরিষদ আয়োজিত সারাদিনব্যাপী পালিতব্য কর্মসূচী সকলের অংশগ্রহনে সার্থক ও সফল হোক এ প্রত্যাশা ব্যাক্ত করছি….

About The Author

শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply