সাম্য ও সম্প্রীতির নিদর্শন ঈদ
মুহাম্মদ ইউনুছ কুতুবী
বছর শেষে খুশির বার্তা সাম্য ও মৈত্রীর বাণী নিয়ে বিশ্ব মুসলিমের দরজায় সমাগত হয় ঈদ। বহুমাত্রিক তাৎপর্য, বৈশিষ্ট ও ফজিলতময় শ্রেষ্ঠ মাস রমজানের শেষে রমজানের মহা উৎসব মানব প্রকৃতির বাস্তবতার স্বীকৃতি ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক আবহ ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত মহা পবিত্র দিন। এই দিন মুসলমান নর-নারী, ছোট-বড়, ধনী-গরীব, বাদশা-ফকির, সাদিক-রফিক, সাদা-কালো, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সকলে মিলে নতুন জামাকাপড় গায়ে দিয়ে আতর-সেন্ট মেখে ঈদের ময়দানে একত্রিত হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মহান আল্লাহর দরবারে হাজিরা দিয়ে সিজদায় পড়ে শুকরিয়া আদায় করে, ধৈর্য সহকারে ঈমাম সাহেবের খুৎবা শুনে বাকি এগার মাস চলার পথের পাথেয় নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। আমাদের ইমাম সাহেবগণ যদি এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ঈদের ময়দানে মহান আল্লাহর পুরস্কার লাভের আশায় উপস্থিত রোজাদার মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে দেয়া খুৎবায় যুগের চাহিদা পুরণসহ বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে অবগত হয়ে উম্মতে মুসলেমার সকল সমস্যার সমাধান কুরআন ও হাদিসের আলোকে দিতে পারেন তাহলে তো এই ঈদের ময়দান হতে সর্বস্তরের মুসলমান ইসলামের সঠিক পয়গাম নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারেন। পেতে পারে আগামী এগার মাস চলার পথের সঠিক সন্ধান।
ঈদ বিশ্ব মুসলিমের একটি বার্ষিক সম্মিলন ও উৎসবের দিন। এ দিন বিশ্ব মুসলিম পরস্পর হিংসা বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঈদগাহে গিয়ে ছোট-বড়, ধনী-নির্ধন, আমির-ফকির একই কাতারে এক বিশেষ ইবাদত করে থাকে। ঈদের পরশে ভ্রাতৃত্ব ও প্রেম ভালোবাসার স্বর্গীয় পরস্পরকে আবদ্ধ করে বলতে থাকে ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক, সবার মুখে মুচকি হাসির পরিষ্কার রেখা দূর হতে ফুটে উঠে। তবে বর্তমানে রোজার আগমনের সাথে বাসা-বাড়ি, দোকানপাটের সাজসজ্জা দৈনিক পত্রিকা ও টিভির বিভিন্ন চ্যানেলে নিত্যনতুন ডিজাইনের পোশাক-আশাকের বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে ঈদের আমেজ দেখা যায় সর্বত্র। ঈদের আনন্দ দশদিন পরেও চলতে থাকে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় কোলাকুলির মাধ্যমে। বিটিভিসহ বিভিন্ন চ্যানেলসমূহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ঈদের আমেজ ধরে রাখে।
পূর্ণ একমাস আল্লাহর হুকুমে তারই সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সিয়াম সাধনার পর ঈদের নামাজের উদ্দেশ্যে ঈদগাহে একে অপরের হাতে হাত বুকে রাখলে মানুষ ভুলে যায় সারা মাসের উপবাসের কষ্ট। প্রতিটি মুসলমান তার সামর্থ্য অনুযায়ী নতুন জামাকাপড় ও জুতা স্যান্ডেল, তা না হলে অন্তত পুরাতনকে নতুনের মতো করে গায়ে দিয়ে ঈদের ময়দানে গিয়ে হাজির হয়। সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠেন ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক। আহ্ কী আনন্দ কী সুন্দর পরিবেশ! যেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার কুদরাতের হাতে সকলকে বেহেশতী সাজে সাজিয়ে দিয়েছেন। কি চমৎকার মুসলিম সমাজ ও তাদের সামাজিক জীবন। আর তাই সবচাইতে দুঃখী মানুষটির মুখেও হাসি ফুটে উঠে। নিঃস্ব মানুষটিও আনন্দে মেতে উঠেছে আজ। ঘরের বিছানায় বা হাসপাতালে শুয়ে থাকা লোকটিও তার অসুখ ভুলে যাচ্ছে। চতুর্দিকে আনন্দের বন্যার কারণে সর্বত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার এক নব কিরণ ছড়িয়ে পড়েছে সবার দুয়ারে ও শহর বন্দর গ্রামগঞ্জের সকল রাস্তাঘাটে। তাই অসহায় লোকটি আজ অন্যদিনের তুলনায় বেশি পাওয়ার অধীর আগ্রহে সবখানে সহযোগিতা পাওযার আশায় হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। সর্বত্র সে সহানুভূতিও পেয়ে যাচ্ছে। শিশু-বৃদ্ধ, অফিসার-কর্মচারী, শ্রমিক-দিনমজুর, রাখাল, কৃষক, ছাত্র-শিক্ষক সবাই একই আনন্দে মেতে উঠে। আজ ইসলামের এ সুমহান শিক্ষা অন্যদেরকেও আন্দোলিত করে।
ঈদের মর্যাদা ও ফজিলত সম্পর্কে মহানবি (স.) এরশাদ করেছেন, “যে ব্যক্তি পুণ্য লাভের অদম্য স্পৃহায় দুই ঈদের রাতে জেগে ইবাদত বন্দেগিতে মশগুল থাকবে সেদিন তার অন্তর এতটুকু ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে না যেদিন অন্য সবার অন্তর ভীতসন্ত্রস্ত মৃতবৎ হয়ে পড়বে।” হাদিস শরীফে আছে, “যারা ঈদের নামাজ আদায় করার জন্য ঈদের ময়দানে একত্রিত হয় তাদের সম্পর্কে দয়াময় আল্লাহ তার ফেরেশতাদের জিজ্ঞাস করবেন, যারা স্বেচ্ছায় দায়িত্ব পালন করে আজ এখানে সমবেত হয়েছে তাদের কী প্রতিদান দেওয়া উচিত? ফেরেশতারা জবাবে বলেন, তাদের পুণ্যময় কাজের সম্পূর্ণ পরিশ্রম দেওয়া দরকার। এরপর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঈদের নামাজ সমাপনকারী নেক বান্দাদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করতে থাকেন, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছে। আর তোমাদের কৃত অতীত পাপকে নেকীতে পরিণত করে দিয়েছে।” এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (স.) এরশাদ করেন, “নামাজ সমাপনকারীরা নিষ্পাপ অবস্থায় ঈদের ময়দান থেকে গৃহে প্রবেশ করবেন, যেন তারা নবজাত শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ।”
ঈদ মূলত মাহে রমজানের বিনিময়ে পাওয়া উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য আল্লাহর দেয়া অতুলনীয় ও অকল্পনীয় একটি নেয়ামত ও মহা পুরষ্কারের ঘোষণা। কুরআন নাজিলের বর্ষপুর্তি উপলক্ষে মহান রাব্বুল আলামীন মুসলিম উম্মাহকে আনন্দের এ দিনটি দান করেছেন। কুরআন তিলাওয়াত, সালাতুল তারাবী ও রোজার বিনিময়ে আনন্দে ভার একটি চমৎকার উৎসব হলো ঈদুল ফিতর। এই ঈদ উৎসরের সন্ধিক্ষণে কে কত দামি এবং সুন্দর পোশাক পরলো বা কে কত উন্নতমানের পানাহার করল সেটা কখনো বিচার্য নয় বরং বিচার্য বিষয় হচ্ছে নিজ নফসকে কে কতটুকু নিষ্পাপ রাখতে পেরেছে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে ত্যাগ স্বীকার করে তার নৈকট্য লাভে কে কতটুকু ধন্য লাভ হয়েছে তা।
ঈদ আসে মুসলমানদের দ্বারপ্রান্তে বাৎসরিক আনন্দের বার্তা নিয়ে, আসে সীমাহীন প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা ও কল্যাণের সাওগাত নিয়ে। সেই ঈদকে যথাযথ মর্যাদায় উদযাপন করা আমাদের প্রত্যেকের অবশ্যই কর্তব্য। ঈদের দিনটি যেমন সার্বজনীন আনন্দ ও খুশির, তেমনি ত্যাগ ও তিতিক্ষার। ঈদের আনন্দ যাতে সর্বশ্রেণির মানুষ উপভোগ করতে পারে সে ব্যবস্থাও আল্লাহ পাক করে দিয়েছেন হীন দরিদ্র, নিঃস্ব, অনাথদের অর্থ বরাদ্দ করেছেন ধনীদের কোষ থেকে ফিৎরা ওয়াজিব করে। শরীয়তে ইসলামীয়াতে ঈদের নামাজের পূর্বে সদকাতুল ফিতর আদায় করার জন্য মুসলমানদের হুকুম দেয়া হয়েছে। ঈদের নামাজের সম্পর্ক আল্লাহর সাথে আর সদকাতুল ফিতরের সম্পর্ক সহানুভূতির সাথে। তাই এই দিনে রোজাদার ঈদের ময়দানে নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে এবং ফিতরা আদায়ের মাধ্যমে অভাবীর অভাব মোচন করে তাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি করে পরস্পরের প্রতি মায়ামমতার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনের রাস্তা উন্মুক্ত করে। ধনীদের সামান্য আর্থিক ত্যাগের মাধ্যমে অভাবীদের যে ভাগ্য পরিবর্তন করা যায় তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ হলো মুসলিম উম্মাহর ঈদ। এ দিন নতুন বা পরিচ্ছন্ন জামা কাপড় পরা সুগন্ধি ব্যবহার করা সুস্বাদু খাদ্য আহার করা সুন্নত। ধনীরা নিজেদের পকেট থেকে আর গরিবরা ধনীদের সাহায্যানুকূলে এসবের ব্যবস্থা করবে। তাই বলা যায় আমাদের কাছে এ ঈদ আল্লাহর একটি বিশেষ নেয়ামতও। এ দিন সবার মুখে থাকে হাসি। চারদিকে আনন্দ ও খুশির ঢেউ বয়ে যায়। সবার ঘরে ঘরে থাকে নানারকম মুখরোচক খাবার ফিরনি, সেমাই, পায়েস আর বিরিয়ানির ঘ্রাণে বাতাস হয় মুখরিত। সবার মন থাকে প্রফুল্ল, সবার দুয়ার থাকে উন্মুক্ত। আমাদের জাতীয় কবি নজরুলের ভাষায়: “সবার দুয়ার খোলা আজি কোথাও নাই মানা/ খাঞ্চা ভরে বিলাব আজ নানা রকম খানা।”
সামাজিক জীবন ও আনন্দ উৎসব এ দুটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত প্রকৃতপক্ষে সামাজিক জীবনের আত্মাস্বরূপ এ ঈদ উৎসব। ঈদের প্রকৃত আনন্দ ও উৎসব শুধু আপনার আমার নয় বরং ধনী-নির্ধন, সুখী-দুঃখী সকলের কাছে খুশির দিন। শুধু আমার ঘরে আমোদ-প্রমদো আমার সন্তান-সন্ততির মুখে হাসি, শুধু ব্যক্তিগত আনন্দই ঈদের মূল কথা নয়, বরং এ দিনে একাত্ম হৃদয়ে অনুভব করতে হবে সে সকল অন্নহীন বস্ত্রহীন অশ্র“সিক্ত শুষ্ক মুখমণ্ডলির। আমোদ, খুশি ও আনন্দের কিছুটা ত্যাগ করে হলেও ঐ সকল দীনহীন মানুষগুলোর মুখে একদিনের জন্যও যদি হাসি ফুটাতে পারি তবেই আমাদের ঈদের সার্থকতা। আমাদের মধ্যে কার পোশাক ঝলসানো বা কত দামি, কত সুস্বাদু খাদ্যদ্রব্যের ব্যবস্থা করেছি তা না দেখে, দেখতে হবে আজ কতজন বস্ত্রহীনের বস্ত্র জোগাড় হয়েছে, কতজন ক্ষুধার্তের খাদ্য জোগাড় হয়েছে। সকলের প্রতি এ আবেদন থাকলো। পরিশেষে বলতে চাই আনন্দের এ সুযোগ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে আমরা দোয়া করি, হে আল্লাহ, বিশ্বব্যাপী নির্যাতিত মুসলিম উম্মাহকে রক্ষা কর। সারা পৃথিবীর মজলুম মুসলিম উম্মাহ, যেন স্বাধীন হয়ে শান্তিপ্রিয় জাতি হিসেবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে তুমি তার ব্যবস্থা করো। আমিন।লেখক: শিক্ষাবিদ, গবেষক ও ইতিহাসবিদ।